লাগাতার ২৬ বছর গুজরাটে ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি। দেশ জুড়ে বিজেপি নেতারা কথায় কথায় উন্নয়নের গুজরাট মডেলের ঢাক পেটান। অথচ তা যে কতখানি ভাঁওতা, তা সে রাজ্যের মানুষ হাড়ে হাড়ে জানেন।
আশির দশকের শেষে ধর্মীয় মেরুকরণকে হাতিয়ার করে গুজরাটে ক্ষমতার ভিত পাকা করতে নেমেছিলেন বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানি। সোমনাথ থেকে রথযাত্রা শুরু করে শুধু রাজ্যে নয়, গোটা দেশে সাম্প্রদায়িক হাওয়া তোলার চেষ্টা করেছিলেন। কংগ্রেসের অপশাসন এবং তাদের জাতপাতের রাজনীতির পাল্টা সমীকরণে নানা যোগ-বিয়োগ কষেই রাজ্যে কংগ্রেসকে হারিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল বিজেপি। ১৯৮৫ সালে সংরক্ষণবিরোধী আন্দোলনে প্যাটেল সম্প্রদায় ছিল প্রথম সারিতে। সেই অশান্ত সময়ের সুযোগ নিয়ে বিজেপি তাদের সমর্থন আদায় করে। ফলে কংগ্রেসের ক্ষত্রিয়, হরিজন, আদিবাসী এবং মুসলিম মোট ভোটব্যাঙ্কের বিপরীতে প্যাটেল এবং পাতিদাররা সমর্থন করে বিজেপিকে। একদা কংগ্রেসের গড়ে একচ্ছত্র ক্ষমতায় চলে আসে তারা। কিন্তু শুধু তো জাতপাত দিয়ে চলবে না। মানুষের রুটি-রুজি না থাকলে, শিক্ষা-চিকিৎসার সুযোগ না থাকলে কতদিন জাত-পাত নিয়ে মানুষকে ভুলিয়ে রাখা যায়? অতএব উন্নয়নের মডেল আনতে হল বিজেপিকে– ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাট’। সেখানে নাকি শিল্পের জোয়ার বইবে, বেকার যুবকদের কাজ নিয়ে ভাবতে হবে না, কৃষকরা ফসলের ন্যায্য দাম পাবে ইত্যাদি। সেই মডেলই হল ‘গুজরাট মডেল’। বিপুল অর্থ ব্যয়ে সারা দেশে সেই গুজরাট মডেলের প্রচার শুরু হল। কিন্তু বাস্তবে কী দেখা গেল? উন্নয়ন কাদের হল? সংখ্যা গরিষ্ঠের উন্নয়ন দূরের কথা, নারী পাচার-নারী ধর্ষণে সামনের সারিতে অবস্থান গুজরাটের। চাকরির অবস্থা খুব খারাপ। শিক্ষার বেহাল দশা। সরকারি চিকিৎসা পরিষেবা বলতে প্রায় কিছুই নেই। প্রতি ১০০০ জনের জন্য রয়েছে ০.৩৩টি বেড, জাতীয় গড় যেখানে ০.৫৫। ‘উন্নয়ন’ এমন হয়েছে যে করোনা অতিমারির সময়ে ২০২০ সালে দেশের মধ্যে মৃত্যুহারে শীর্ষে ছিল গুজরাট– ৭.৮৮ শতাংশ (দ্য ওয়ার-৯ এপ্রিল ২০২০)।
গুজরাটের একদা মুখ্যমন্ত্রী, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের আমলে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ মাত্রাছাড়া হয়। গুজরাট গণহত্যা, গোধরা ট্রেন অগ্নিকাণ্ডকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘুদের নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়। মানুষে-মানুষে অবিশ্বাসের ভিত তৈরি হয়। প্রকৃত পরিস্থিতি চাপা দিয়ে রাজ্যের ঝাঁ চকচকে ওপরের চেহারাটা মানুষের কাছে পরিবেশন করা হল বিজ্ঞাপনের পিছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করে। কিছু স্মার্ট সিটি তৈরির কথা ঘোষণা করে ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাট’-এর প্রচারে ছেয়ে গেল দেশ। ভিতরটা কিন্তু অন্ধকারই থেকে গেল।
এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা বিজ্ঞাপনেই দেখেছে ‘ভাইব্রান্ট’ গুজরাটকে। বাস্তবে কলেজ পাশ করে চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে বাধ্য হচ্ছে তারা। কাজ নেই। অসংখ্য রোজগার মেলা হচ্ছে প্রতি বছর, কিন্তু ভাইব্রান্ট গুজরাটের লম্বা দাবি সত্ত্বেও রাজ্য সরকার যুবকদের কাজ দিতে ব্যর্থ। বেকার ক্রমশ কমছে বলে সরকারের দাবির সাথে বাস্তবের কোনও মিল নেই। বিজেপি-ঘনিষ্ঠ হাতে গোনা কয়েকজন শিল্পপতির সম্পদ আকাশছোঁয়া হলেও সাধারণ মানুষ রয়েছে সেই তিমিরে।
দক্ষ বেকার যুবক কম নেই। কিন্তু সরকারি চাকরি অত্যন্ত নগণ্য। গত দু’বছরে গুজরাটে যেখানে চাকরির আবেদন করেছেন ২.৩৮ লক্ষ যুবক, এর মধ্যে সরকারি চাকরি পেয়েছেন মাত্র ৩২ জন। সরকারি হিসেবে নথিভুক্ত বেকারের সংখ্যা ২ কোটি ৩৮ লক্ষ ৯৭৮ জন (দ্য উইক-১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)। এর সাথে রয়েছে ভয়ঙ্কর নিয়োগ দুর্নীতি, যা প্রকৃত মেধাবী দক্ষ যুবকদের চাকরির পথে অন্যতম বাধা। বিত্তবান অনেকেই আমেরিকা, কানাডা ও ইংল্যান্ডে পাড়ি দিচ্ছে ভাল চাকরির প্রত্যাশা নিয়ে। যাদের আর্থিক ক্ষমতা নেই, তারা কোনওরকমে দিন গুজরানের জন্য পরিযায়ী শ্রমিক, হকারির কাজ করছে।
রাজ্যে শিক্ষার অবস্থা করুণ। বিরাট সংখ্যক সরকারি গুজরাটি মাধ্যম স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। বেশিরভাগ সরকারি স্কুলে শিক্ষকের অভাব। ২০২৩ সালে বিধানসভায় দেওয়া সরকারের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, মাধ্যমিক স্কুলে ৩২ হাজার ৬৭৪টি শিক্ষক পদ শূন্য। সরকারি এবং অনুদানপ্রাপ্ত ৪০ হাজার প্রাথমিক স্কুলে সাড়ে ১৭ হাজার পদ ফাঁকা। গত দু’মাস ধরে ৭৫ হাজারের বেশি শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারী ধর্মঘট করছেন সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত স্কুলে। তাদের অন্যতম দাবি, শূন্য পদ পূরণ (ইন্ডিয়া টুডে-১০ অক্টোবর ২০২৩)। ব্যাঙের ছাতার মতো রাজ্যের সর্বত্র গজিয়ে উঠেছে সেল্ফ ফিনান্সিং কলেজ। এর ফলে ইঞ্জিনিয়ারিং ও অন্যান্য ক্ষেত্রে শিক্ষা হয়ে উঠেছে ব্যয়বহুল, তা সাধারণের আয়ত্তের বাইরে।
জাতপাত ভিত্তিক বৈষম্য এবং অত্যাচারের ঘটনা বেড়েই চলেছে। বিয়েতে ঘোড়ায় চড়ার অপরাধে উচ্চবর্ণের হাতে দলিত বরের মার খাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে কয়েকটি জায়গায়। এ সব ঘটনায় সরকার নিষ্পৃহ। বিলকিস বানোর ধর্ষকরা মুক্তি পাওয়ায় ‘নারীশক্তির জয়গান’ গাওয়া বিজেপি নেতাদের মুখোশ খুলে গিয়েছে। যদিও পরে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে তাদের পুনরায় জেলে যেতে হয়েছে। গত তিন বছরে গুজরাটে ৬ হাজার ৬১৯টি নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে (গুজরাট সমাচার-৩ মার্চ, ২০২৪)। শিশু ও নারী পাচারের রমরমা ব্যবসা গুজরাটে (দ্য হিন্দু-১ জুন ২০২৩)।
সার-বীজের অগ্নিমূল্য, ফসলে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য অত্যন্ত কম এবং বন্যার সময় চাষিদের ক্ষেত্রে সরকারের চরম অসহযোগিতা কৃষিকে অলাভজনক করে তুলেছে। কৃষকরা জমি বিক্রি করে গ্রাম থেকে উৎখাত হয়ে শহরে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
কেন্দে্র ও রাজ্যে একই দল সরকারে থাকলে ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকারের কল্যাণে নাকি রাজ্যের উন্নয়ন আকাশছোঁয়া হয়– বিজেপি নেতারা এমন দাবি করে থাকেন। কিন্তু গুজরাটে ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকার হওয়া সত্ত্বেও মানুষের দুর্দশার এই চিত্রকে আড়াল করতে পারছে না তারা। ২৬ বছর তো উন্নয়নের পক্ষে কম সময় নয়। তা হলে তা হল না কেন– এই প্রশ্ন তাড়া করছে বিজেপিকে। ফলে ধোঁকা দিতে তাদের নতুন পথ খুঁজতে হচ্ছে।
এই অবস্থায় ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন বিজেপির কাছে সমস্যাসঙ্কুল। সাম্প্রদায়িক জিগির তুলেও মানুষকে বিভ্রান্ত করা সহজ হচ্ছে না। তাই বিজেপি মানুষের সমর্থন হারানোর আশঙ্কায় ভুগছে। জেতার জন্য যে কোনও হীন কৌশল নিতেও তারা পিছপা নয়। সুরাটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতার জন্য বিরোধী দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করাতে নানা হীন কৌশল নেওয়ার মতো ন্যক্করজনক ঘটনা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সাধারণ মানুষ ভাল চোখে দেখছে না বিজেপির এই সব কু-কীর্তিকে।
সূত্রঃ দ্য টেলিগ্রাফ – ১ মে, ২০২৪