সরকারি সার্কুলারের মূল্য সরকারের কাছেই নেই৷ নিয়মানুযায়ী সরকারি স্কুলে শিক্ষা অবৈতনিক হলেও কার্যক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত৷ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ ভর্তি ফি ২৪০ টাকা নেওয়ার কথা হলেও বাস্তবে স্কুলগুলি নিচ্ছে অনেকগুণ বেশি৷ নবম–দশম ও একাদশ–দ্বাদশ শ্রেণির ক্ষেত্রে অবস্থা আরও ভয়াবহ৷ প্রায় সমস্ত সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলেই এই চিত্র৷ কোথাও ১০০০, কোথাও ৩০০০ আবার কোথাও ৫০০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে৷
কেন ছাত্রদের থেকে টাকা নেওয়া হচ্ছে? কারণ সরকার শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করছে না৷ স্কুলের পরিকাঠামো উন্নয়নের দিকেও কোনও নজর নেই৷ স্কুলের বহু শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারী পদ শূন্য, উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে ধুঁকছে সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলি৷ আরও সর্বনাশ হয়েছে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ–ফেল তুলে দিয়ে৷ পড়াশোনার মান তলানিতে এসে ঠেকেছে৷ বহু সরকারি স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে৷ কলকাতায় ৭৫টি সরকারি স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার খবর সংবাদপত্রে বেরিয়েছে ইতিমধ্যে৷ সারা রাজ্যে সংখ্যাটা হাজার ছাড়াবে৷ পাশ–ফেল তুলে দিয়ে সরকারি শিক্ষাকে প্রহসনে পরিণত করার ফলে বাড়ছে বেসরকারি শিক্ষা ব্যবসা৷ এ রাজ্যের সাথে গোটা দেশেই এখন বেসরকারি স্কুলের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে৷ তথ্য বলছে– ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে সরকারি স্কুলে ১ কোটি ১০ লক্ষ ছাত্র কমে গিয়েছে৷ এই সময়ে বেসরকারি স্কুলে ১ কেটি ৬০ লক্ষ ছাত্র ভর্তি হয়েছে৷ বেসরকারি স্কুলের সংখ্যা ৮, ৩৩৭ থেকে বেড়ে হয়েছে ৯৬,৪১৬৷ অর্থাৎ বেসরকারি স্কুলের সংখ্যা ১১ গুণ বেড়েছে৷ (সূত্র : টাইমস অফ ইন্ডিয়া–১৭.০৪.২০১৭)
কিন্তু বেসরকারি স্কুলের ফি–ও লাগামছাড়া৷ ভর্তির সময় থেকে শুরু করে বছরের বিভিন্ন সময়ে নানা অজুহাতে ছাত্রছাত্রীদের থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা নেওয়া হয় বেসরকারি স্কুলগুলিতে৷
কলকাতার কিছু নামী বেসরকারি স্কুলের বার্ষিক খরচের পরিমাণ দেখলে আঁতকে উঠতে হয়৷ মডার্ন হাই স্কুল ফর গার্লস ৮২ হাজার টাকা, লা মার্টিনিয়ার ফর বয়েজ/গার্লস ২ লক্ষ ৪৭ হাজার টাকা, ফিউচার ফাউন্ডেশন ১ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা, সাউথ পয়েন্ট হাই স্কুল ৯০ হাজার টাকা৷ এইসব স্কুলে কারা ভর্তির সুযোগ পাবে?
গত বছর বেসরকারি স্কুলের এই অস্বাভাবিক ফি নিয়ন্ত্রণের জন্য মুখ্যমন্ত্রী একটি ‘সেল্ফ রেগুলেটরি কমিশন’ তৈরি করেছিলেন৷ স্কুল–শিক্ষা দপ্তর সূত্রে খবর এক বছর কেটে গেলেও এই কমিশনের কোনও কার্যকারিতা লক্ষ করা যায়নি৷ এ রাজ্যে ঘটা করে গঠিত আরও বহু কমিশন ও কমিটির ভূমিকা যেমন ঠুঁটো জগন্নাথের মতো, এই কমিশনের হালও তাই হয়েছে৷
সম্প্রতি দিল্লি সরকার বেসরকারি স্কুলের লাগামছাড়া ফি নিয়ন্ত্রণের জন্য উদ্যোগ নিলেও এ রাজ্যের সরকারের কোনও ভূমিকা লক্ষ করা যাচ্ছে না৷ বেসরকারি স্কুলের এই অনিয়ন্ত্রিত ফি–বৃদ্ধি রুখতে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন স্কুলে অভিভাবকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পথে নেমেছেন৷ এ আই ডি এস ও–র আন্দোলনের চাপে বেশ কিছু স্কুলে বর্ধিত ফি ফেরত দিতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ৷ এ বছর বাঁকুড়া জেলার ডি আই স্কুলের একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রে ফি নির্দিষ্ট করে দিতে সার্কুলার জারি করেছেন৷ ডিএসও–র আন্দোলনের চাপে ইতিমধ্যে কলকাতার কলিন্স ইন্সস্টিটিডট, শ্যামবাজারের পার্ক ইন্সস্টিটিউশন, ভবানীপুরের বেলতলা গার্লস, সাউথ সুবার্বন, বরানগরের জ্যোতি নগর বিদ্যাশ্রী নিকেতনে, পশ্চিম মেদিনীপুরের খালিনা হাইস্কুলে ফি কমাতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ৷
(৭০ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা ১৫জুন, ২০১৮)