কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বেঁচে থাকলে বোধহয় আবার বলে উঠতেন তাঁর ‘সাগর তর্পণ’ কবিতার সেই বিখ্যাত লাইনগুলি– ‘স্মরণ-চিহ্ন রাখতে পারি শক্তি তেমন নাই“প্রাণ-প্রতিষ্ঠা নাই যাতে সে মূরৎ নাহি চাই।’
২৩ জানুয়ারি নেতাজি সুভাচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে দিল্লির ইন্ডিয়া গেটে এই মহান বিপ্লবীর হলোগ্রাম (লেজার রশ্মির সাহায্যে তৈরি) মূর্তি উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘স্বাধীন অসাম্প্রদায়িক ভারতের বিশ্বাস জুগিয়েছেন নেতাজি’। বলেছেন, ‘স্বাধীন ভারতের স্বপ্নপূরণ এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা’। প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, কিছুদিনের মধ্যেই ওই জায়গায় নেতাজির বিশাল আকারের গ্রানাইট পাথরের মূর্তি বসাবে কেন্দ্রীয় সরকার। প্রধানমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, এই সুবিশাল মূর্তি হবে জাতির প্রতি নেতাজির অবদানের প্রতীক।
সত্যিই কি তাই? নিষ্প্রাণ পাথরের মূর্তিই হবে নেতাজির প্রতীক, তাঁর স্বপ্নের, তাঁর উত্তরাধিকারের প্রতীক? দিল্লির বুকে দ্বিতীয় নেতাজি মূর্তিটি বসানোর কৃতিত্ব নিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দলের ছোট-বড় নানা স্তরের নেতারা যে উচ্চকণ্ঠের বাণী দিয়ে চলেছেন তাতে মনে হতে পারে এ ভূ-ভারতে তাঁদের মতো নেতাজি ভক্ত আর মিলবে না।
কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চালিত আজকের ভারতের চিত্র দেখলে কি মনে হয় এই মহান বিপ্লবীর এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের যথার্থ স্বপ্ন পূরণের জন্য এ দেশের বর্তমান শাসকদের আদৌ কোনও মাথাব্যথা আছে? তাঁদের হাত ধরে কি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর স্বপ্নে প্রাণ-প্রতিষ্ঠা কখনওই সম্ভব? এই মহান বিপ্লবীর স্বপ্ন ছিল শোষণমুক্ত ভারত। তিনি চেয়েছিলেন, এমন নতুন সামাজ যেখানে মানুষের উপর মানুষের শোষণ এবং ধনবৈষম্য থাকবে না। সেই পথেই কি চলছেন নরেন্দ্র মোদিরা? তাঁদের সরকারের সমস্ত নীতি পরিচালিত মুষ্টিমেয় ধনীর কল্যাণে। আজকের ভারতে হাতে গোনা কয়েকজন ধনকুবের ভোগ করে দেশের অধিকাংশ সম্পদ, অন্য দিকে পুঁজিবাদী শোষণে ছিবড়ে হয়ে অধিকাংশ জনগণ তলিয়ে যাচ্ছে অসীম দারিদ্রের খাদে। বর্তমান বিজেপি সরকারের নীতি এই বৈষম্যকে আরও প্রকট করে তুলেছে। নেতাজির মূর্তিতে এই রাষ্টে্রর কর্তারা যত বড় মালা চড়ানই না কেন, এই সমস্যাগুলির সমাধান না করে কি তাঁকে যথার্থ সম্মান প্রদর্শন?
নেতাজির স্বপ্ন ছিল, ‘… দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতার ক্যানসার নির্মূল করা’। সাম্প্রদায়িকতার ক্যানসার নির্মূল করার চেষ্টা স্বাধীনতার পর থেকে কোনও শাসক দল করেছে? আজকের শাসকদের ভূমিকা কী? তারাই কি এই ‘ক্যানসারের’ সবচেয়ে বড় বাহক নয়? প্রধানমন্ত্রী নিজে সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশে ভোট প্রচারে গিয়ে যে ভাষায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি নানাভাবে বিষোদগার করেছেন, বিজেপি দলটাই যেভাবে সাম্প্রদায়িকতা এবং সংখ্যালঘু বিদ্বেষের প্রতীকে পরিণত হয়েছে, সত্য বলতে হলে প্রধানমন্ত্রীকে নেতাজির মূর্তির তলায় দাঁড়িয়ে তাঁর দলটিকে ভারতীয় সমাজের ‘ক্যানসার’ হিসাবে ঘোষণা করতে হত। তিনি কি তা করতে প্রস্তুত? আরএসএস-বিজেপি নেতারা আজ দাবি তুলছেন ভারতকে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ বানানোর। সেকুলার ভারতকে মুছে ফেলতে তাঁরা বদ্ধপরিকর। সুভাষচন্দে্রর বক্তব্য ঠিক এর বিপরীত। তিনি বলছেন, ‘‘… হিন্দুরা ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে ‘হিন্দুরাজের’ ধ্বনিশোনা যায়। এগুলি সর্বৈব অলস চিন্তা। … শ্রমসিক্ত জনসাধারণ যে সব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন, সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি তার কোনওটির সমাধান করিতে পারিবে কি? কী ভাবে বেকারত্ব, নিরক্ষরতা, দারিদ্র প্রভৃতি সমস্যার সমাধান হইবে সে সম্বন্ধে তাহারা কোনও পথনির্দেশ করিয়াছে কি?’ (১৪ জুন ১৯৩৮, কুমিল্লায় ভাষণ)
নেতাজির কথায়–‘আমাদের দেশের হিন্দু–মুসলমান এই দুই প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধের কোনও চিরন্তন কারণ থাকতে পারে না– এটা নেই। … এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী লোক ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত স্বার্থের লোভে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কলহ ও মনোমালিন্য সৃষ্টি করে বেডাচ্ছে… স্বাধীনতা সংগ্রামে এ শ্রেণির লোককেও শত্রু রূপে গণ্য করা প্রয়োজন।”(ওই) তিনি সাম্প্রদায়িকতার প্রচারকদের দেশের শত্রু গণ্য করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলুন–উত্তরাখণ্ডের আপনার দলের ঘনিষ্ঠরা সংখ্যালঘুদের হত্যার ডাক দেওয়ার পর আপনি অথবা অপনার সরকার কি প্রতিবাদ করেছেন? না করে থাকলে, নেতাজি থাকলে আপনাদের কী বলতেন?
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, তিনি ‘ঢাক ঢোল পিটিয়ে’ ইতিহাসকে বদলে দিতে চান। বলেছেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের ‘সঠিক ইতিহাস’ তাঁরাই লিখবেন। আসলে তিনি ঢাকা দিতে চাইছেন সেই ইতিহাসকে, যে ইতিহাস তুলে ধরে বিজেপির আদর্শগত অভিভাববক আরএসএস এবং বিজেপি দলটির পূর্বসূরি ‘হিন্দু মহাসভা’র স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে বিশ্বাসঘতকতার কর্মকাণ্ডকে। ইতিহাসের পাতায় ধরা আছে এদের যে সব কীর্তি, তাতে স্পষ্ট, আরএসএস-হিন্দুমহাসভার আদর্শ মানলে নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে মানা অসম্ভব। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আরএসএস চেয়েছে, ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিবর্তে সংগ্রাম হোক মুসলমানের বিরুদ্ধে। তাদের গুরু গোলওয়ালকর তাঁর ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড’ সহ নানা রচনায় এই কথাই বারবার তুলে ধরেছেন। তাদের অন্যতম আইকন বিনায়ক দামোদর সাভারকর চেয়েছিলেন, ভারতকে ধর্মভিত্তিক জাতিতে বিভক্ত করতে। তিনি উপস্থিত করেছেন, চরম অবৈজ্ঞানিক এবং সাম্প্রদায়িক ধর্মভিত্তিক জাতিতত্ত্বের ধারণা। ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার দেখিয়েছিলেন, সাভারকরের এই ফরমুলাই পাকিস্তানের দাবিকে জোরদার করতে মুসলিম লিগকে সাহায্য করেছিল।
ইতিহাস দেখিয়েছে, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু যখন আজাদ হিন্দ বাহিনীকে নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াইতে নেমেছেন, সেই সময় হেডগেওয়ার, গণেশ দামোদর সাভারকর (বিনায়ক দামোদর সাভারকরের ভাই) প্রমুখ আরএসএস ও হিন্দু মহাসভার নেতারা ব্রিটিশকে সাহায্য করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। হিন্দু মহাসভার নেতা বিনায়ক দামোদর সাভারকর ১৯৪১ থেকে শুরু করে একাধিকবার সওয়াল করেছিলেন, ব্রিটিশের সাহায্যার্থে হিন্দুত্ববাদী মিলিশিয়া বাহিনী গড়ে তুলতে। সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ বাহিনী যখন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়ছে, সেই সময় তিনি চাইছেন সুভাষচন্দ্রকে পরাস্ত করতে হিন্দু যুবকরা ব্রিটিশের পাশে দাঁড়াক।
দেশে থাকতেই এদের এই ভূমিকা নিয়েছিলেন নেতাজি। তাই ১৯৪০ সালে ঝাড়গ্রামের ভাষণে তিনি হিন্দু মহাসভাকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে চিহ্নিত করে, তাদের থেকে দেশবাসীকে সাবধান থাকতে বলেছেন। আজ বিজেপির হাতে দেশপ্রেমের ঠিকাদারি দিতে গেলে প্রধানমন্ত্রীকে এই ইতিহাস তো মুছতেই হবে! ইতিহাস বলছে,সাম্প্রদায়িক হিন্দু মহাসভাকে নেতাজি শুধু বিশ্বাসঘাতক নয়, দেশের শত্রু বলছেন– ‘‘… আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের শত্রু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং যারা সেই সাম্রাজ্যবাদকে সমর্থন করে তারা আমাদের শত্রু এবং ভারতের জাতীয়তার শত্রু। আজকে হিন্দু মহাসভা মোসলেম বিদ্বেষের দ্বারা প্রণোদিত হয়ে অবলীলাক্রমে ইংরাজের সাথে মিলতে পারে, মুসলমানকে জব্দ করতে যেনতেন প্রকারেণ।… মনে রাখতে হবে আমাদের শত্রু হল বিদেশি সাম্রাজ্যবাদ এবং যে সমস্ত ভারতবাসী এবং ভারতীয় প্রতিষ্ঠান তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করে তারাও। (১৫মে ১৯৪০, ২৪ পরগণার যুব সমাবেশে ভাষণ)
প্রধানমন্ত্রীর সুবিধা করে দিয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে কংগ্রেসের গান্ধীবাদী আপসকামী নেতৃত্ব এবং কমিউনিস্ট বলে দাবি করা অবিভক্ত সিপিআই নেতৃত্বের সুভাষচন্দ্রের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনা। তিনি এটাকে দেখিয়ে এখন নিজের নেতাজি ভক্তির ভেকটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে চাইছেন। এতে তাঁর ভোটপ্রচারের সহায়তা হতে পারে কিন্তু তার সাথে নেতাজির আদর্শের কোনও সম্পর্ক নেই। বরং বলা যেতে পারে, বিজেপি, কংগ্রেস আর মেকি কমিউনিস্ট শক্তি সিপিএম-সিপিআই এরা সকলে নেতাজির প্রতি কতবড় বিশ্বাসঘাতকের ভূমিকা পালন করেছে তারই প্রতিযোগিতা চলছে যেন!
আজকের দিনে নেতাজির স্বপ্ন পূরণের সাথে জড়িয়ে আছে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কর্তব্য পালনের প্রশ্ন। বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক শক্তি তো বটেই, এছাড়াও যারা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়, আর ভোটের সময় জাতপাত-ধর্মকে সংকীর্ণ স্বার্থে ব্যবহার করে, এই শক্তিগুলিও আজ নেতাজির প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে পারে না। আজকের ভারতে শোষণহীন নতুন সমাজ গঠনের লড়াইকে বাদ দিয়ে সুভাষচন্দ্রকে যথার্থ শ্রদ্ধা জানানো যায় না। পুঁজিবাদী শোষণ-যন্ত্রকে টিকিয়ে রেখে তার চালক হওয়ার প্রতিযোগিতায় একে অপরের ভোট-প্রতিদ্বন্দ্বী বুর্জোয়া পেটিবুর্জোয়া দলগুলি সকলেই দেশের মানুষের নেতাজির প্রতি আবেগকে পুঁজি করে জনগণের চোখে নিজেদের হীন কার্যকলাপকে আড়াল করতে চায়। তাই এরা নেতাজি-ভক্ত সাজে। যেমন সেজেছেন প্রধানমন্ত্রী।
বিপ্লবী বারীন ঘোষকেলেখা চিঠিতে নেতাজি বলছেন, – ‘‘এতকাল স্বাধীনতা বলতে আমরা শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতার কথাই বুঝিয়েছি। কিন্তু এখন থেকে আমাদের ঘোষণা করতে হবে যে, আমরা জনসাধারণকে শুধু রাজনৈতিক দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে চাই না, সমস্ত প্রকার বন্ধনথেকেই মুক্ত করতে চাই। স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক এই তিন ধরনের শোষণেরই অবসান। যখন সকল শৃঙ্খলের অবসান ঘটবে, তখনই আমরা সাম্যবাদের ভিত্তিতে একটি নতুন সমাজ গড়তে অগ্রসর হতে পারি। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান লক্ষ্য একটি মুক্ত এবং শ্রেণিহীন সমাজ গড়ে তোলা”। এই স্বপ্নপূরণে ব্রতী হলে তবেই নেতাজির উত্তরসাধক হওয়া সম্ভব। তা তো আর বিজেপি নেতাদের দিয়ে হতে পারে না।