কুখ্যাত ‘লাফিন আইল্যান্ড গণহত্যা’ নিয়ে তদন্তমূলক একটি তথ্যচিত্রের কাজ চলছিল আয়ারল্যান্ডের ব্রিটিশ অধিকৃত একটি এলাকায়৷ ‘নো স্টোন আনটার্নড’ নামের এই তথ্যচিত্র তৈরির কাজে সাহায্য করছিলেন সাংবাদিক ব্যারি মাকক্যাফার্টি ও ট্রেভর বার্নি৷ গত ৩১ আগস্ট পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে তাঁদের৷ বহু প্রশ্ন উঠেছে এই গ্রেপ্তার নিয়ে৷
১৯৯৪ সালে ব্রিটিশ অধিকৃত আয়ারল্যান্ডেরই একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের মদতপুষ্ট সন্ত্রাসী সংস্থা ‘উলস্টার ভলান্টিয়ার ফোর্স’ বা ইউভিএফ নির্বিচারে গুলি চালায়৷ নিহত হন ৬ জন, আহত ৫৷ এই ঘটনা ‘লাফিন আইল্যান্ড গণহত্যা’ নামে পরিচিত৷ হত্যাকারীদের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ অধিকৃত আয়ারল্যান্ডের ছ’টি কাউন্টির বাসিন্দা খ্রিস্টধর্মের ক্যাথলিক ধারায় বিশ্বাসী মানুষজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানো৷ এই হত্যাকাণ্ডের পর ওই অঞ্চলের বিরাট এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়া হিংসা ও সন্ত্রাসের বলি হন ৩ হাজার মানুষ৷ সে সংক্রান্ত নথিপত্র প্রকাশ করতে ব্রিটিশ সরকার এখনও রাজি নয়৷
স্বাধীন আয়ারল্যান্ডের যে অংশটি এখনও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ দখল করে রেখেছে, তা ১৯২২ সালে আয়ারল্যান্ডের মূল ভূভাগ থেকে সীমান্তরেখা টেনে আলাদা করে দেওয়া হয়৷ ‘উত্তর আয়ারল্যান্ড’ নামে পরিচিত এই ভূভাগটি ব্রিটিশ সেনা ও ব্রিটিশ আইনের অধীনে রয়েছে৷ সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ পূরণ করতেই এভাবে দেশের মধ্যে দেশ তৈরি করে রেখে এখানে বসবাসকারী মানুষকে আয়ারল্যান্ডের বাকি অংশের মানুষের কাছ থেকে আলাদা করে রেখেছে ব্রিটেন৷ শুধু তাই নয়, বছরের পর বছর ধরে এখানে তারা লাগিয়ে রেখেছে তীব্র সংঘর্ষের পরিবেশ৷ অবিরাম রক্তপাতের ঘটনা ঘটাচ্ছে৷ লাফিন আইল্যান্ড হত্যাকাণ্ড এরই অংশ৷
এই হত্যাকাণ্ডে যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের পরিজনদের অনেকেরই অনুমান, ঘটনার পিছনে রয়েছে ‘রয়্যাল উলস্টার কনস্টাবুলারি’ বা আরইউসি নামের সাম্রাজ্যবাদী পুলিশের হাত৷ ইউভিএফ–এর সঙ্গে ছক কষে এই আরইউসি হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে বলে মনে করেন তাঁরা৷ এই অনুমানের যথেষ্ট কারণ রয়েছে৷ দেখা যায়, ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এই হত্যাকাণ্ডের প্রমাণগুলি লোপ করতে খুবই সচেষ্ট৷ ঘটনার পরপরই আততায়ীরা যে গাড়ি চড়ে পালিয়ে গিয়েছিল, সেটি ধ্বংস করে ফেলা হয়৷ নষ্ট করে ফেলা হয় আরইউসি–র লোকজনকে এ বিষয়ে প্রশ্ণোত্তরের কাগজপত্র৷ এমনকী ডিএনএ প্রমাণগুলিও লোপাট করে ফেলা হয়৷ লাফিন আইল্যান্ড হত্যাকাণ্ডের পরেই আরইউসি নিজেদের নামও পাল্টে ফেলে৷ যদিও ভূমিকা তার একই থাকে– আগের মতোই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ রক্ষা করা৷ এসব বিষয় আরইউসি–র উপর মানুষের সন্দেহ আরও দৃঢ় করে৷ পরে আরও জানা যায়, হত্যাকাণ্ডের ২৪ ঘন্টার মধ্যেই সন্দেহভাজন খুনিদের নাম জানা গেলেও পুলিশের যোগসাজশেই তারা উধাও হয়ে যায় এবং ঘটনার পরবর্তী দু’মাসে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করেনি পুলিশ অভিযুক্ত হত্যাকারীদের একজন আবার ইউভিএফ–এর পাশাপাশি খোদ ব্রিটিশ পুলিশবাহিনীরও সদস্য৷ ক্যাথলিকদের উপর এর আগে বহু বার হামলা চালানোর অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে৷
তথ্যচিত্রটি তৈরি করা হচ্ছিল লাফিন আইল্যান্ড হত্যাকাণ্ডের তদন্তে এইসব সন্দেহগুলির সত্যতা যাচাই করতে এবং হত্যাকারীদের চিহ্ণিত করার কাজে আরও আলোকপাত করতে৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ কীভাবে সন্ত্রাসবাদীদের মদত দিয়ে শক্তিশালী করছে, অনুসন্ধানের আলো ফেলা হয়েছিল তার উপরেও৷ এই ব্যাপারেই বহু তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করছিলেন দুই সাংবাদিক ম্যাকক্যাফার্টি ও বার্নি৷ ব্রিটিশ পুলিশ এই স্পর্ধা সহ্য করবে কেন খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করেছে তাঁদের৷ গোটা দুনিয়া জুড়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্যাঙাৎ হিসাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ যে আক্রমণ, আগ্রাসন, গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে, আয়ারল্যান্ডের ব্রিটিশ অধিকৃত এলাকার এই কার্যকলাপের সঙ্গে তার বিশেষ গরমিল নেই৷
(৭১ বর্ষ ৯ সংখ্যা ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)