৩০ আগস্ট দেশের অর্থমন্ত্রী নতুন করে দশটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে চারটিতে নামানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন৷ এর ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সংখ্যা কমে দাঁড়াবে ১২টিতে৷ পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের সাথে যুক্ত হচ্ছে ওরিয়েন্টাল ব্যাঙ্কফ কমার্স এবং ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, যার মোট ব্যবসার পরিমাণ দাঁডাবে ১৭,৯৪,৫২৬ কোটি টাকা৷ কানাড়া ব্যাঙ্কের সাথে যুক্ত হচ্ছে সিন্ডিকেট ব্যাঙ্ক, মোট ব্যবসা দাঁড়াবে ১৫,২০,২৯৫ কোটি টাকা৷ ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সাথে যুক্ত হবে অন্ধ্র ব্যাঙ্ক এবং কর্পোরেশন ব্যাঙ্ক৷ তাদের মোট ব্যবসা ১৪,৫৯,৪৩৪ কোটি টাকা৷ ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্কের সাথে যুক্ত হবে এলাহাবাদ ব্যাঙ্ক, মোট ব্যবসা ৮,০৭,৮৫৯ কোটি টাকা৷ এর আগে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সাথে সংযুক্ত হয়েছিল ভারতীয় মহিলা ব্যাঙ্ক সহ ছটি ব্যাঙ্ক৷ ব্যাঙ্ক অফ বরোদার সাথে সংযুক্ত হয়েছিল দেনা ব্যাঙ্ক এবং বিজয়া ব্যাঙ্ক৷ এখনও যে ব্যাঙ্কগুলি বাকি রইল সেগুলি হল, ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যাঙ্ক, ইউকো ব্যাঙ্ক, ব্যাঙ্ক অফ মহারাষ্ট্র এবং পঞ্জাব অ্যান্ড সিন্ধ ব্যাঙ্ক৷ সংযুক্তিকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে অবশ্য বহু আগেই৷ উদার অর্থনীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে সংস্কার করার উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত নরসিংহম কমিটির সুপারিশ মেনে ১৯৯৩ সালে সর্বপ্রথম রাষ্ট্রায়ত্ত পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের সাথে সংযুক্ত হয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত নিউ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া৷
এত বড় সংযুক্তির সিদ্ধান্ত ঘোষণা হওয়ার পর অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য হল, ‘অর্থনীতির ঝিমিয়ে পড়া দশা কাটাতে এবং ২০২৪–এ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ৫ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতির লক্ষ্য পূরণ করতে সরকার যে সব পদক্ষেপ করছে, এই সংস্কার তারই অঙ্গ৷ এর ফলে অনাদায়ী ঋণের (এনপিএ) বোঝায় দুর্বল হয়ে পড়া ব্যাঙ্কগুলিতে সরকার যে পুঁজি ঢালছে, তা আরও ভালভাবে কাজে লাগানো যাবে৷’ এর ফলে গ্রাহকদেরও যেমন কোথাও কোথাও অসুবিধা হবে তেমনি বহু কর্মচারীও যে উদ্বৃত্ত হবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ সে কারণেই অর্থমন্ত্রীর আশ্বাস, ‘অন্য ব্যাঙ্কের সঙ্গে মিশে যাওয়া ব্যাঙ্কে যাঁদের অ্যাকাউন্ট রয়েছে, তাঁদের চিন্তার কোনও কারণ নেই৷ কোনও কর্মীকে ছাঁটাইও করা হবে না৷’ প্রশ্ন হল, এই বক্তব্য বা আশ্বাসের ভিত্তিই বা কি, আর এর মূল্যই বা কতটুকু ? ইতিপূর্বে ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণের ক্ষেত্রে দেখা গেছে সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কগুলির কিছু শাখার অবলুপ্তি ঘটেছে৷ তার ফলে গ্রাহকরাই অসুবিধায় পড়েছেন৷ এবারের সংযুক্তিও স্বাভাবিক ভাবে বহু শাখাকে চিরদিনের মতো বন্ধ করে দেবে৷ অপরদিকে উদ্বৃত্ত কর্মীদের এই মুহূর্তে যদি ছাঁটাই নাও করা হয়, তাহলেও বেশ কিছুদিন ঐ ব্যাঙ্কগুলিতে নতুন কর্মী নিয়োগ যে বন্ধ থাকবে তাও পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না৷ ফলে এই পদক্ষেপের সাথে ব্যাঙ্কের সাধারণ গ্রাহক বা ব্যাঙ্ক–কর্মচারীদের স্বার্থ বিঘ্ণিত হওয়া ছাড়া অন্য কিছুর সম্ভাবনা নেই৷
শুধু তাই নয়, এত দিন গ্রাহকরা সুদের হার বা পরিষেবা মাশুল বিচার করে পছন্দ মতো ব্যাঙ্ক বেছে নেওয়ার যে সুযোগ পেতেন, তা সংকুচিত করা হল৷ স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার ক্ষেত্রে দেখা গেছে সংযুক্তির পর সেখানে জমা টাকার ওপর সুদের হার কমেছে, পাশাপাশি পরিষেবা মাশুলের ক্ষেত্রও সম্প্রসারিত হয়েছে এবং তার পরিমাণও বেড়েছে৷ সংযুক্তির পর অন্যান্য ব্যাঙ্কেও তেমন পরিণতিই স্বাভাবিক৷ কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী কথিত পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতিতে দ্রুত পৌঁছাতেই বৃহৎ এবং আন্তর্জাতিক মানের কয়েকটি ব্যাঙ্ক তৈরি করা হচ্ছে৷ এতে লাভ কার? দেশের সাধারণ মানুষের কোন মোক্ষ লাভটি এর দ্বারা সম্পন্ন হবে? দেখা যাচ্ছে এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা হতেই দেশের বৃহৎ পুঁজির মালিকরা একেবারে দুই হাত তুলে একে স্বাগত জানাতে ব্যস্ত৷ বোঝা যায় এর থেকে তারা বড়সড় লাভের আশা করছে৷ বাস্তবে ঘটনাও তাই৷ এদেশে ব্যাঙ্কগুলির অনুৎপাদক সম্পদ বা এনপিএ (দীর্ঘকাল শোধ না হওয়া ঋণ) দাঁড়িয়েছে ১২ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি৷ শুধু মাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতেই তা সরকারের অত্যন্ত রাখঢাক করা হিসাবেও ৭ লক্ষ ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি৷ এই টাকার বেশিরভাগটাই পড়ে আছে এ দেশের বড় বড় পুঁজি মালিকদের ঘরে৷ তার সাথে বিজয় মালিয়া, নীরব মোদি, প্রধানমন্ত্রীর ‘মেহুল ভাই’দের মতো লুঠেরাদের কারবারে ব্যাঙ্কের আরও কয়েক হাজার কোটি টাকা উধাও হয়ে গেছে৷ বিজেপি সরকারের গত পাঁচ বছরের আমলে ব্যাঙ্ক জালিয়াতি হয়েছে ১ লক্ষ ৭৪ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা৷ শুধু ২০১৮–১৯ অর্থবর্ষে এই জালিয়াতি ৭১ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকায় পৌঁছেছে৷ আর্থিক বৃদ্ধি যতই কমুক ব্যাঙ্ক জালিয়াতি বেড়েছে ৭৩ শতাংশ (এনডিটিভি, ২৯ আগস্ট ২০১৯)৷ ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির হাল খারাপ৷ এমনিতেই দেশের অর্থনীতিতে গভীর মন্দার লক্ষণ৷ হিসাবে অনেক কারচুপি করেও আর্থিক বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশে নেমেছে বলে স্বীকার করতে সরকার বাধ্য হয়েছে৷ শিল্প উৎপাদন তলানিতে বললে ভুল হবে, তার সূচক ছুটছে শূন্যের নিচের দিকে৷ সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নামতে নামতে এমন জায়গায় যে করপোরেট মালিকরাও বলছে, পাঁচটাকার বিস্কুট, কিংবা দু’টাকার শ্যাম্পুর পাতা কিনতেও লোকে ইতস্তত করছে৷ এই পরিস্থিতিতে দেশের বৃহৎ পুঁজি মালিকদের জন্য ব্যাঙ্ক–রূপী কামধেনুর ব্যবস্থা করে দিতেই এই ব্যবস্থা৷ যাতে দেশের অর্থনীতিতে যতই সংকট থাকুক আম্বানি, আদানি, টাটা, বিড়লাদের গায়ে তার এতটুকু আঁচ না পড়ে৷ কেন্দ্রীয় সরকার জনগণের ট্যাক্সের টাকায় গড়া কোষাগার থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকা নতুন করে ব্যাঙ্কগুলিকে দিচ্ছে, যাতে এনপিএ–র ধাক্কা সামলে ব্যাঙ্কগুলি আবার পুঁজিপতিদের ঋণ দিতে পারে৷ কিন্তু যে ব্যাঙ্ক সামান্য কয়েক হাজার টাকা ঋণ আদায়ের জন্য সাধারণ মানুষকে হেনস্থা করে, তারা পুঁজিপতিদের কাছ থেকে পুরনো ঋণ আদায়ের কথা তুলছেই না৷ সরকার নতুন দেউলিয়া আইনের অজুহাতে ব্যাঙ্কগুলিকে ঋণ আদায়ের জন্য পাঠাচ্ছে জাতীয় কোম্পানি আইন ট্রাইবুনালে৷ বিজেপি সরকারের নির্দেশে ট্রাইবুনাল ব্যাঙ্কগুলিকে বাধ্য করছে ঋণের বড় অংশ ছেড়ে দিয়ে পুঁজিপতিদের সাথে একটা সমঝোতা করে নিতে৷ ব্যাঙ্কে থাকা গরিব জনসাধারণের কষ্টার্জিত টাকা এই পথে বেশি বেশি করে ঢুকছে পুঁজিপতিদের সিন্দুকে৷ এর ফলে যে এনপিএ–র ভারে নুব্জ্য দুর্বল ব্যাঙ্কগুলির দায়ের বোঝায় অপেক্ষাকৃত সবল ব্যাঙ্কগুলিও ডুবতে পারে এই আশঙ্কাও প্রকাশ করছে ব্যাঙ্ককর্মী সংগঠনগুলি৷ সরকারের তাতে কী? তারা যাদের সেবাদাস হিসাবে কাজ করে সেই একচেটিয়া মালিকদের লাভ হলেই সরকারের দায়িত্ব শেষ৷ দেশের অধিকাংশ মানুষের সঞ্চয়কে সরকার ভারতের একচেটিয়া মালিকদের হাতে পুঁজি হিসাবে তুলে দিতে চাইছে৷ এই একজোট করা পুঁজির জোরে এদেশের একচেটিয়া মালিকরা তাদের সাম্রাজ্যবাদী নখ–দাঁত আরও তীক্ষ্ণ করে এশিয়া আফ্রিকার দুর্বল দেশগুলির উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে৷ বড় সাম্রাজ্যবাদীদের দোসর হিসাবে যুদ্ধ এবং যুদ্ধাস্ত্র ব্যবসায় তারা বিপুল লাভ ঘরে তুলবে৷ বিনিময়ে গোটা ভারতের জনগণ বিশ্বের শোষিত শ্রমজীবী মানুষের দীর্ঘশ্বাস আর অভিশাপের ভাগী হবেন৷ বিজেপির উপহার দেওয়া তথাকথিত ‘শক্তিশালী ব্যাঙ্ক’ দেশের মানুষের কোনও উপকার করবে না, করবে এদেশের পুঁজিপতি শ্রেণির৷ তাছাড়া এই পথেই একদিকে সরকার ব্যাঙ্কে তার নিজের শেয়ার কমাতে কমাতে ব্যাঙ্কগুলিকে পুরোপুরি বেসরকারি হাতে দিয়ে দেবে৷ ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে সরকারি শেয়ার ৫১ শতাংশ নেমেছে৷ আরও নামবে বলে ঘোষণা আছে৷ বিজেপি সরকার এই পথেই এফআরডিআই (ফিনান্সিয়াল রেজোলিউশন অ্যান্ড ডিপোজিট ইন্সিওরেন্স)–এর মতো মারাত্মক বিলকেও ওই সংযুক্তিকরণের পর সংস্কারের অজুহাতেই চালু করার চেষ্টায় আছে৷ এই অপচেষ্টারই অপর নাম ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণ৷