রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে বেসরকারিকরণের লক্ষে্য কেন্দ্রীয় সরকার বর্তমান শীতকালীন অধিবেশনে ‘ব্যাঙ্কিং রেগুলেশনস অ্যাক্ট’ এবং ‘ব্যাঙ্কিং কোম্পানিজ (অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ট্রান্সফার অফ আন্ডারটেকিংস) অ্যাক্টস’কে সংশোধন করে যে ব্যাঙ্কিং ল’জ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল ২০২১’ নিয়ে এসেছে তা পাশ করাতে চাইছে। একচেটিয়া পুঁজির মালিকানাধীন কর্পোরেট সংস্থাগুলির স্বার্থে রেল সহ বিভিন্ন সরকারি এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলিকে বেসরকারিকরণের যে প্রচেষ্টা কেন্দ্র জারি রেখেছে এটা তারই অঙ্গ। প্রবীণরা বেসরকারি ব্যাঙ্কের ইতিহাস জানেন। বিভিন্ন গল্প-উপন্যাস এবং তাকে ভিত্তি করে সিনেমাতে তার পরিচয় পাওয়া যায়। গত শতাব্দীর ৪০, ৫০ বা ৬০-এর দশকে ব্যাঙ্কে মাঝে মাঝেই লালবাতি জ্বলত। তখন সব ব্যাঙ্কই ছিল বেসরকারি ব্যাঙ্ক। আমানতকারীদের জমানো টাকার বা ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের চাকরির কোনও নিরাপত্তা ছিল না বললেই চলে। হঠাৎ করে ব্যাঙ্কগুলি ডুবে যাওয়ার ফলে গায়েব হয়ে যেত ব্যাঙ্কে গচ্ছিত সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ। কর্মচারীরা হারাত তাদের কাজ। ব্যাঙ্কবেসরকারিকরণ হলে আবারও দেশের মানুষকে যেতে হবে নিরাপত্তাহীনতার সেই অন্ধকার বলয়ে।
বিগত কয়েক বছরের মধ্যে দেখা গেল গ্লোবাল ট্রাস্ট ব্যাঙ্ক, লক্ষ্মীবিলাস ব্যাঙ্ক, ইয়েস ব্যাঙ্কের মতো বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলিকে ডুবে যেতে। দেখা গেল বেসরকারি আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে আর্থিক কেলেঙ্কারির নানা অভিযোগ উঠতে। লক্ষণীয় বিষয় হল, বহু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিই এগিয়ে গিয়েছে ডুবে যাওয়া ব্যাঙ্কগুলির বিপন্ন গ্রাহকদের উদ্ধার করতে। এরপরও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে বেসরকারিকরণের জন্য সরকার কোমর বেঁধে লেগেছে কার স্বার্থে?
গত কয়েক বছরে মোদি সরকার যে ভাবে ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণ ঘটাল তার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বেসরকারিকরণ। বিভিন্ন সময়ে ছোট-বড় বিভিন্ন সংযুক্তির মাধ্যমে ২৭টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক কমে ১২টিতে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে শুধু গত চার বছরে গ্রাহকদের সমস্যা বাড়িয়ে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের ৩৩২১টি শাখা অফিস বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কমে গিয়েছে প্রায় ৭৪ হাজার কর্মচারী। শাখার সংখ্যা এবং কর্মী সংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে পরিষেবা। যদিও পরিষেবা শুল্কের ক্ষেত্র এবং পরিমাণ, দু’টোই ক্রমবর্ধমান। স্থায়ী কাজে স্থায়ী কর্মীর বদলে নিযুক্ত করা হচ্ছে অস্থায়ী কর্মী। স্থায়ী কর্মী কমে যাওয়ার সাথে সাথে কন্ট্রাক্ট বা ক্যাজুয়াল কর্মীর সংখ্যা বাড়ছে। শিক্ষিত বেকার যুবকদের অল্প পারিশ্রমিক দিয়ে বেশি কাজ করিয়ে মুনাফা বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে প্রায় প্রতিটি ব্যাঙ্ক। এক্ষেত্রেও চলছে যথেচ্ছ ছাঁটাই, যাকে বলে ‘হায়ার অ্যান্ড ফায়ার’। একই উদ্দেশ্যে পার্ট-টাইম কর্মীদেরও সহজে ফুল-টাইম কর্মীতে পরিণত করা হচ্ছে না। বেসরকারিকরণ হলে এই সমস্যা আরও বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।
বেসরকারিকরণ হলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির ৩১ শতাংশ গ্রামীণ শাখার ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে পড়বে। অন্যান্য সমস্যাও বহুগুণ বাড়বে। গরিব এবং গ্রামীণ গ্রাহকদের বিরাট একটা অংশ ব্যাঙ্ক পরিষেবার বাইরে চলে যাবে। প্রান্তিক চাষি, ছোট ছোট দোকানদার, আর্থিক দিক থেকে সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির একটা বিরাট অংশও ব্যাঙ্ক-ঋণের অভাবে গ্রামীণ বিত্তশালীদের থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে সর্বস্বান্ত হবে।
দেশে মোট ব্যাঙ্ক আমানতের ৭০ শতাংশ রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে। বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে মোট জমা টাকার পরিমাণ ১০০ লক্ষ কোটি টাকার কাছাকাছি। সরকারের সহায়তায় এই বিশাল পরিমাণ টাকার নিয়ন্ত্রক হতে চাইছে এদেশের ধনকুবের গোষ্ঠী। এই টাকার উপর ভিত্তি করে ঋণ দেওয়া হয়। ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণ ক্রমবর্ধমান। এই ঋণ না আদায়ের ফলে এগুলি ব্যাঙ্কের অনুৎপাদক সম্পদ (নন-পারফর্মিং অ্যাসেট বা এনপিএ)-এ পরিণত হচ্ছে। এই সম্পদ ব্যাঙ্ক ব্যবস্থাকে দিনে দিনে দুর্বল করে দিচ্ছে। সরকার বহু ক্ষেত্রে বড় বড় কর্পোরেট ঋণ মকুব করে দিচ্ছে বা অনুৎপাদক সম্পদের বোঝা কমাতে ‘ব্যাড ব্যাঙ্ক’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ঘুরপথে জনগণের করের টাকায় সৃষ্ট সরকারি তহবিল থেকে ব্যাঙ্কগুলিকে অর্থ জোগান দিচ্ছে। ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের মধ্য দিয়ে জনগণের অর্থকে আরও যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে যাবে একচেটিয়া পুঁজির মালিকানাধীন কর্পোরেট সংস্থাগুলি।
কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের এই প্রচেষ্টা সফল হলে তা শুধু ব্যাঙ্ক কর্মীদের উপর আঘাত হানবে না, আঘাত হানবে ব্যাঙ্ক গ্রাহক সহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের উপর। দেশের আর্থিক দুরবস্থা আরও ত্বরান্বিত হবে। আর্থিক বৈষম্য সমাজের বুকে ভয়াবহ রূপে বাড়বে।