70 Year 29 Issue 9 March 2018
শিল্পপতি এবং বড় বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলির সংগঠন অ্যাসোচেম আওয়াজ তুলেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি তাদের হাতে তুলে দেওয়া হোক৷এর ফলে নাকি ব্যাঙ্ক পরিচালকদের দায়বদ্ধতা ও দায়িত্ববোধ বাড়বে৷ ওই সংগঠন সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, ব্যাঙ্কগুলির ঝামেলার দায় কতটা নিজের কাঁধে নেবে সে–ক্ষেত্রে সরকারের একটা সীমা মেনে চলা উচিত৷ সরকারের মনে রাখা প্রয়োজন এই টাকা করদাতাদের৷
অ্যাসোচেম কর্তাদের কথাগুলি শুনলে মনে হতে পারে, ব্যাঙ্কে গচ্ছিত আমানতকারীদের টাকার নিরাপত্তা নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন এই সব পুঁজিপতিরা৷ সত্যিই কি তাই?
অ্যাসোচেম ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের আওয়াজ এমন একটা সময় তুলেছে যখন পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের ১১,৪০০ কোটি সহ প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা নিয়ে নীরব মোদি কোন বিদেশে পালিয়েছেন ভারত সরকার এখনও তার কোনও হদিশ করতে পারেনি৷ ব্যাঙ্কের অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা ব্যবস্থা কত ঠুনকো, প্রতারণার এই ঘটনায় তা প্রকাশ্যে এসে গেছে৷ সরকার এফআরডিআই বিল আনার পর এমন ঘটনায় সাধারণ মানুষ ব্যাঙ্কে তাদের গচ্ছিত টাকার ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছে৷ এই সময়েই ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছে শিল্পপতি–ব্যবসায়ীদের মুখপাত্র সংগঠনটি৷
২০১৭–র মার্চের হিসেব অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির মোট আমানতের পরিমাণ প্রায় ৮১ লক্ষ কোটি টাকা৷ পুঁজিপতিদের লক্ষ্য সেই বিপুল পরিমাণ অর্থ৷ কিন্তু এই ব্যাঙ্কগুলি তো ক’বছর আগেও লাভজনক ছিল, এখন লোকসান করছে কেন? লোকসানের কারণ, একদিকে বিপুল পরিমাণ অনাদায়ী ঋণ, অন্য দিকে ক্রমাগত বাড়তে থাকা জালিয়াতি৷ গত বছর জুন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৮ লক্ষ কোটি টাকা৷ ২০১৪ সালে যার পরিমাণ ছিল ২ লক্ষ ২৭ হাজার কোটি টাকা৷ এই বিপুল পরিমাণ টাকা ঋণ নিয়ে কারা শোধ দেয়নি? কৃষক, বেকার যুবক, ছোট দোকানদার কিংবা ছোট শিল্প–কারখানার মালিকরা? মোটেও না৷ তাদের ঋণ বাকি পড়লে ব্যাঙ্কের নির্দেশে পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে ছোটে কোমরে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে এনে হাজতে পুরতে৷ ঋণের নামে এই পুরো টাকাটাই মেরে দিয়েছে শিল্পপতি, পুঁজিপতি আর বড় বড় ব্যবসায়ীরা৷ এই ঋণের শতকরা ৭৮ ভাগই মাত্র ৫০টি কর্পোরেট মালিকের৷ বাকি ঋণটাও অন্য পুঁজিপতিদেরই৷ কিন্তু না, আজ পর্যন্ত কোনও ঋণখেলাপি পুঁজিমালিকের কোমরে দড়ি পড়েনি৷ তারা এই টাকা লোপাট করে দিয়ে বহাল তবিয়তেই আছে৷ তারাই আজ সাধু সেজে এসে সওয়াল করছে, ব্যাঙ্কগুলি তাদের হাতে তুলে দেওয়া হোক৷ দায়িত্ববোধের কী দারণ পরিচয়!
এই কর্তারা সত্যিই করদাতাদের গচ্ছিত টাকা নিয়ে চিন্তিত হলে তো প্রথমেই তাদের চেম্বারের সদস্যদের সাবধান করত যে, তারা কেউ করদাতাদের টাকা এই ভাবে লোপাট করতে পারবে না কই, তা তো তারা একবারও বলেননি৷ বলেননি যে, করদাতাদের টাকা কেউ লোপাট করলে চেম্বার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে এরপরও কি বুঝতে অসুবিধা হয় যে, এই কপট দরদের একমাত্র উদ্দেশ্য যে কোনও প্রকারে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির দখল নিয়ে করদাতাদের জমানো বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করা৷
উল্লেখ করা দরকার, ব্যাঙ্কের এই টাকা কিন্তু এই সব শিল্পপতি–পুঁজিপতি– ব্যবসায়ীদের জমা নয়, এরা তাদের ঋণের শর্তের কারণ ছাড়া কখনও একটি টাকাও ব্যাঙ্কে জমা রাখে না৷ এই জমা টাকার ৮৫ ভাগই দেশের সাধারণ মানুষের৷ তা ছাড়া যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে অপদার্থ এবং দায়িত্বহীন বলে দেগে দিয়ে সেগুলিকে আত্মসাৎ করতে চাইছেন অ্যাসোচেম কর্তারা, তারা নিজেরা কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ ঋণ বেসরকারি ব্যাঙ্ক থেকে না নিয়ে সেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকেই নিয়েছেন৷ চতুরতার সীমা নেই এদের!
স্বাধীনতার পর থেকে বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলির দায়বদ্ধতা এবং দায়িত্ববোধের নজির দেখে চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল দেশের মানুষের৷ ১৯৬৮ সালে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ করার আগে পর্যন্ত ৭৩৬টি বেসরকারি ব্যাঙ্ক সাধারণ মানুষের জমানো টাকা লোপাট করে দিয়ে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেছিল৷ ’৬৮–র পরেও ৩৬টি বেসরকারি ব্যাঙ্ক তাদের ‘পরম দায়িত্বশীলতা’র কারণে দেউলিয়া হয়ে যাওয়ায় সরকারকে সেগুলি অধিগ্রহণ করতে হয়েছিল৷ আজ আবার সেই সব বেসরকারি সংস্থার পক্ষেই সওয়াল করতে নেমেছেন অ্যাসোচেম কর্তারা৷ বেসরকারি সংস্থাগুলি শুধু ব্যাঙ্কের ঋণ শোধ না করে তাদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে এমন নয়, স্বাধীন ভারতে যতগুলি বড় অঙ্কের আর্থিক কেলেঙ্কারি হয়েছে তার প্রত্যেকটির পিছনেও রয়েছে কোনও না কোনও ‘দায়িত্বশীল’ জালিয়াত পুঁজিপতির হাত৷ এদের হাতেই সরকারি ব্যাঙ্কগুলি তুলে দেওয়া কি বিড়ালকে মাছ পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া নয়?
কিন্তু এই ফেরেববাজি এইসব জালিয়াত পুঁজিপতিরা চালিয়ে যেতে পারছে কী করে? খুব সহজেই যে পারছে এটা তো পরিষ্কার৷ না হলে মাত্র তিন বছরে ঋণখেলাপির পরিমাণ এমন অবিশ্বাস্য পরিমাণে বাড়তে পারত না৷ দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতির দল এটা বুঝে গেছে যে, তারা যতই ব্যাঙ্কের টাকা লোপাট করুক, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বর্তমান বিজেপি সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেবে না, বরং এ ব্যাপারে তারা সরকারের পূর্ণ সহযোগিতাই পাবে৷ তাই দেশের তামাম সাধারণ মানুষ নীরব এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গদের জালিয়াতি নিয়ে যখন চরম উদ্বিগ্ন তখনও প্রধানমন্ত্রী পুরো ব্যাপারটা নিয়ে শুধু নীরবতাই পালন করে গেলেন৷ বিজেপির অন্য নেতা–মন্ত্রীরা এটা প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে ব্যাপারটা তেমন কিছু নয়, কয়েকজন অফিসার আর কেরানির গাফিলতি মাত্র৷ জালিয়াত পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে একটি কথাও তাঁরা কেউ উচ্চারণ করলেন না৷ একই সাথে দেশের মানুষ লক্ষ করল, বিজেপি সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রমানিয়ান কর্পোরেট কর্তাদের সাথে গলা মিলিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করলেন৷
পুঁজিপতিদের সাথে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল তথা নেতাদের এই কুৎসিত বোঝাপড়ার রূপটাকেই আধুনিক অর্থনীতির ভাষায় বলা হচ্ছে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’৷ পুঁজিবাদের এই স্তরে পুঁজিপতিরা আর আগের মতো উৎপাদন করে, ব্যবসা করে মুনাফা করার উপর নির্ভর করে না৷ একদিকে তীব্র বাজার সংকট, অন্য দিকে পুঁজির বিপুল কেন্দ্রীভবন হল বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি৷ এই পরিস্থিতিতে নেতা–মন্ত্রীদের সাথে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে, পারস্পরিক লেনদেনের ভিত্তিতে জাতীয় সম্পত্তি তথা জনগণের সম্পদের অবাধ লুঠতরাজ চালানোটাই এই পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য৷ জাতীয় ব্যাঙ্কগুলি থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার এই অবাধ লুঠতরাজ, গ্যাস, তেল, কয়লা সহ খনিগুলির বেসরকারিকরণ এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়া এর অন্যতম নজির৷ কংগ্রেস আমলেও নেতা–মন্ত্রীদের সাথে পুঁজিপতিদের এই বোঝাপড়া ছিল৷ কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, তত এটা আরও নগ্ন এবং আরও মারাত্মক আকার নিচ্ছে৷ সরকার এবং প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি হু হু করে ছড়িয়ে পড়ছে৷ এর ফলে জনস্বার্থ ভয়ঙ্কর ভাবে বিঘ্ণিত হচ্ছে৷ অন্য দিকে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির হাতে দেশের সমস্ত সম্পদ গিয়ে জমা হচ্ছে৷ এটা কত মারাত্মক আকার নিয়েছে তা উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হবে৷ গত মাসেই আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফ্যাম প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ২০১৭ সালে ভারতে মোট সম্পদের ৭৩ শতাংশ কুক্ষিগত রয়েছে দেশের ১ শতাংশ ধনকুবেরের হাতে৷ গত বছর ছিল ৫৮ শতাংশ৷ এক বছরেই অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ সম্পদ কুক্ষিগত করেছে এই ধনকুবেররা৷ ২০০০ সালে মোট সম্পদের ৩৬.৮ শতাংশ ছিল সব থেকে ধনী ১ শতাংশের হাতে৷ দুর্নীতি কী মারাত্মক আকার নিয়েছে তা প্রকাশ পেয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল প্রকাশিত ২০১৭–র করাপশন পারসেপশন ইনডেক্সে৷
স্বাভাবিক ভাবেই এর ফল হিসাবে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে ধনী–দরিদ্রের বৈষম্য৷ কংগ্রেস আমলে বোফর্স, টু জি, কয়লা সহ অসংখ্য বিশাল মাপের দুর্নীতি ঘটেছে৷ বিজেপি শাসনে দুর্নীতির ঢাকনা সবে খুলতেই কুৎসিত চেহারা বেরিয়ে আসছে৷ কেন্দ্রীয় সরকারে বিজেপির আসীন হওয়ার এটাই ছিল শর্ত যে, তারা একচেটিয়া শিল্পপতি–পুঁজিপতি–ব্যবসায়ীদের জন্য এই লুঠতরাজের ব্যবস্থা করে দেবে এবং তা চালাতে দেবে৷ তাই গত লোকসভা নির্বাচনে একচেটিয়া পুঁজিপতিরা বিজেপির হয়ে প্রচারে হাজার হাজার কোটি টাকা ঢেলেছে৷ এখনও দলের বিপুল বৈভব এবং নেতা–মন্ত্রীদের বিলাস–ব্যসনের ব্যয়ের জোগান দিয়ে চলেছে তারা৷
বিনিময়ে তার বহুগুণ উশুল করছে জনগণের উপর বিপুল বোঝা চাপিয়ে, দেশের সম্পদ লুঠ করে৷ বিজেপির এই জনবিরোধী চরিত্র দেশের শ্রমিক–কৃষক সহ সাধারণ মানুষের কাছে যত স্পষ্ট হচ্ছে তত তার বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে৷ এই অবস্থায় পুঁজিপতিরা যখন বুঝবে বিজেপিকে আর ক্ষমতায় রাখলে এই ক্ষোভ গণবিস্ফোরণের আকার নিতে পারে তখন আবার কংগ্রেস বা পুঁজিপতিদেরই স্বার্থরক্ষাকারী অন্য কোনও দল বা জোটকে ক্ষমতায় নিয়ে আসবে৷ পুঁজিপতিরা এভাবেই দ্বিদলীয় ভোট রাজনীতিতে জনগণকে ফাঁসিয়ে দিয়ে পুঁজির শোষণ অব্যাহত গতিতে চালিয়ে যাচ্ছে৷ ভোট রাজনীতির এই গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে এসে সংঘবদ্ধ হয়ে এই লুঠেরা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ালে এর হাত থেকে মুক্তি নেই৷