নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (সিএবি) পাশ হওয়ার পরে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে রাজ্যে রাজ্যে৷ আগুন জ্বালিয়ে, ভাঙচুর এবং রাস্তা অবরোধ করে চলছে প্রতিবাদ৷ পরিস্থিতি সামলাতে জারি হয়েছে কার্ফু৷ বিক্ষোভ হঠাতে পুলিশের গুলিতে আসামে প্রাণহানিও ঘটেছে বেশ কয়েক জনের৷ দিল্লিতেও ছড়িয়েছে আগুন৷ পুলিশের হাতে মার খেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা৷ অন্যান্য রাজ্যেও প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর উঠছে৷ পশ্চিমবাংলাতেও মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে৷
প্রশ্ন উঠছে, বিজেপি একের পর এক এমন বিভাজন সৃষ্টিকারী পদক্ষেপ নিয়ে চলেছে কেন– যা দেশজুড়ে পরিবেশ–পরিস্থিতিকে এভাবে অশান্ত করে তুলছে? দেশের মানুষ তো বিজেপির কাছে নাগরিকত্ব সংশোধনীর মতো আইন আনার দাবি জানায়নি যে মানুষগুলি এ দেশে জন্মে, বড় হয়ে, পড়াশোনা করে, পরিশ্রম করে সমাজের উৎপাদনে অংশগ্রহণ করে চলেছে, ভোট দিয়ে একের পর এক সরকার গঠন করেছে, আজ তাদেরই কেন নাগরিকত্বের পরীক্ষা দিতে হবে? কেন বিজেপি নেতারা আনলেন এমন একটি আইন? বিজেপি সভাপতি তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, দলের ইস্তাহারেই বিলটি আনার কথা ছিল৷
ইস্তাহারে তো শুধু সিএবি (ক্যাব) আনার কথা ছিল না, ছিল আরও বহু প্রতিশ্রুতি যেগুলি দেশের মানুষের জীবনের সাথে সরাসরি জড়িত৷ সেগুলিকে সরিয়ে রেখে শুধুমাত্র ক্যাব কার্যকর করার জন্য বিজেপি নেতারা উঠেপড়ে লাগলেন কেন?
সারা দেশ মন্দার আগুনে পুড়ছে৷ প্রতিটি জিনিসের দাম আগুন৷ মানুষ একবেলা খেলে আর একবেলা কী খাবে তা ভেবে পাচ্ছে না৷ বেকারে দেশ ছেয়ে গেছে৷ গত পঁয়তাল্লিশ বছরে সর্বোচ্চ হারে পৌঁছেছে বেকারি৷ মানুষের কেনার ক্ষমতা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে৷ কারখানাগুলিতে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হচ্ছে না৷ মালিকরা উৎপাদন কমাতে লে–ফ করছে, শিফট কমাচ্ছে৷ ছাঁটাই হয়ে যাচ্ছে লাখ লাখ শ্রমিক–কর্মচারী৷ অথচ বিজেপির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল তারা জিনিসপত্রের দাম কমাবে৷ বছরে ২ কোটি বেকারকে চাকরি দেবে৷ কালো টাকা উদ্ধার করে কালো টাকার মালিকদের গ্রেপ্তার করে জেলে পুরবে৷ দুর্নীতি দূর করবে৷ সবার জীবনে ‘আচ্ছে দিন’ নিয়ে আসবে৷ সব কা সাথ, সব কা বিকাশ অর্থাৎ সমাজের সব অংশের মানুষের জীবনে বিকাশ ঘটাবে৷
এত প্রতিশ্রুতি, যার কোনও একটি কার্যকর হলেই মানুষের সংকট–জর্জরিত জীবনে কিছুটা হলেও সুরাহা আসত– সে–সব বাদ দিয়ে নরেন্দ্র মোদি–অমিত শাহরা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বেলাতেই শুধু ইস্তাহারের উল্লেখ করলেন কেন? আসলে বাকি প্রতিশ্রুতিগুলি ছিল ভাঁওতা– মানুষকে ঠকিয়ে ভোটে জেতার কৌশল৷ অনেকেরই মনে আছে, কালো টাকা উদ্ধার করে সবার অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ করে টাকা ভরে দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি এক সময় প্রধানমন্ত্রী দিয়েছিলেন, এই অমিত শাহ–ই তাকে জুমলা অর্থাৎ ভাঁওতা বলে নিজেই ঘোষণা করেছিলেন৷ তিনি একটি জুমলার কথা বলেছিলেন, বাস্তবে তাঁদের দেওয়া সবগুলি প্রতিশ্রুতিই জুমলা৷ ফলে এটা স্পষ্ট, বিজেপি নেতারা জেনে–বুঝেই মানুষকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতিগুলি দিয়েছিলেন৷
কিন্তু ভোটে জেতার পর মানুষের জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি সমাধানের পথ বাতলাতে পারেননি বিজেপি নেতা–মন্ত্রীরা৷ কারণ একই সঙ্গে পুঁজিপতিদের এবং সাধারণ মানুষের স্বার্থপূরণ করা সম্ভব নয়৷ বিজেপি শাসনে শিল্পপতি–পুঁজিপতিদের বিপুল সম্পদবৃদ্ধি এবং সাধারণ মানুষের জীবনের অভাবনীয় সংকটবৃদ্ধিই তার প্রমাণ৷ পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার ব্যর্থতা প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে৷ মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, ছাঁটাইয়ে জর্জরিত মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে৷ এই ক্ষোভ যে কোনও সময় সরকারের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগঠিত আন্দোলনের আকারে ফেটে পড়তে পারে৷ এই অবস্থায় বিজেপি একদিকে তার ক্ষমতার ভোগ–দখল, অন্য দিকে পুঁজিপতি শ্রেণির সেবার কাজ চালিয়ে যাবে কীসের জোরে?
সেই জোর হল রাজনীতি, শ্রেণিশোষণ সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতার অভাব৷ সেই জোর হল শোষিত মানুষকে বিভক্ত করে দুর্বল করার নীতির জোর– যে জোরে প্রতিক্রিয়াশীল, স্বৈরাচারী, জনবিরোধী শাসকরা ক্ষমতায় টিকে থেকেছে চিরকাল৷ তাই ধর্মে, বর্ণে বিভক্ত করে শোষিত মানুষকে একের বিরুদ্ধে অপরকে লড়িয়ে দেওয়ার চেনা রাস্তাটাই ধরেছে বিজেপি৷ মূল শত্রু পুঁজিবাদকে আড়াল করে নয়, শোষিত মানুষেরই এক অংশকে অপর অংশের শত্রু খাড়া করার অপচেষ্টা শুরু করেছে বিজেপি৷ তার জন্যই এনআরসি, ক্যাবের মতো সর্বনাশা আইন চালুর ষড়যন্ত্র, যাতে সমস্যায় বিপর্যস্ত মানুষের দৃষ্টি মূল সমস্যাগুলি থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়৷
ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে বিভক্ত করাই বিজেপির বরাবরের রাজনীতি৷ পরাধীন ভারতে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যখন দেশের মানুষ ধর্ম–বর্ণ–জাতি নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করছিল, জেলে যাচ্ছিল, ফাঁসিতে প্রাণ দিচ্ছিল, তখন বিজেপির পূর্বসূরি হিন্দু মহাসভার নেতারা ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের জিগির তুলেছিল, ভারতীয়ত্বের পরিবর্তে হিন্দুত্বের পরিচয়ই আসল পরিচয় বলে ধুয়ো তুলেছিল৷ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিবর্তে ব্রিটিশকে সহযোগিতা করার রাস্তা নিয়েছিল৷ সেদিন এই সব নেতারা দেশের মানুষের কাছে দেশবিরোধী হিসাবে প্রতিপন্ন হয়েছিলেন৷ সেই কালি আজও বিজেপি তার গা থেকে তুলতে পারেনি৷ বাস্তবে স্বাধীনতার এত দিন পরে যখন নানা অপ্রাপ্তির অসন্তোষে মানুষের মন ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে, যখন নানা কারণে বামপন্থী আন্দোলন কিছুটা দুর্বল হয়েছে তখন সেই ক্ষোভকে বিপথগামী করে আজ বিজেপি পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে৷ এবং তারপরই তারা তাদের পুরনো হিন্দুত্বের কর্মসূচি কার্যকর করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে৷ দীর্ঘ সত্তর বছরে দেশভাগের মর্মান্তিক স্মৃতি যখন দেশের মানুষ প্রায় ভুলতে বসেছে তখন এই হিন্দুত্বের কর্মসূচির ভিত্তিতে আবারও তা খুঁচিয়ে তুলে, হিন্দু–মুসলমানের মধ্যে বিরোধ বাধিয়ে, বিশেষত পশ্চিমবাংলায় যেখানে দুই ধর্মের মানুষের সম্প্রীতি সারা দেশে উদাহরণ তৈরি করেছে, সেই সম্প্রীতির পরিবেশকে ধ্বংস করে ভোট–রাজনীতির খেলায় নেমেছে বিজেপি৷
কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে একের পর এক পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী বুর্জোয়া দলগুলি দেশের অর্থনীতিকে যেভাবে খাদের কিনারায় পৌঁছে দিয়েছে, তাতে এই পথে চলে বিজেপি নেতারা মানুষকে ভোলাতে পারবেন না, খুব বেশি হলে সাময়িক ভাবে তাদের বিভ্রান্ত করতে পারবেন৷ যেমন নোট বাতিলের মধ্য দিয়ে যে ভাবাবেগ তারা তৈরি করেছিলেন, পুলওয়ামা করে যে উন্মাদনা তৈরি করেছিলেন, জীবনের কঠিন বাস্তব সে উন্মাদনা স্তিমিত করে দিয়েছে৷ জীবনের সমস্যাগুলিকে নিয়ে শ্রমিক কৃষক ছাত্র যুবক মহিলা সাধারণ মানুষ দেশের প্রান্তে প্রান্তে আন্দোলনে ফেটে পড়ছে৷ আজ একদিকে শাসক শ্রেণির মানুষকে ভাগ করার এই চক্রান্তকে পরাস্ত করতে, অন্য দিকে মানুষের রুটি–রুজি নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে বাধ্য করতে এই আন্দোলনগুলিকেই আরও শক্তিশালী করতে হবে৷ হিন্দু–মুসলিম ধর্ম নির্বিশেষে সব অংশের মানুষকে সেই আন্দোলনগুলিতে আজ এক সারিতে দাঁড়াতে হবে৷