কেন্দ্রের বিজেপি সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ন্যাশনাল মেডিকেল কমিশন বিল ১ আগস্ট রাজ্যসভায় পাস করিয়ে নিয়েছে৷ চিকিৎসক সমাজের অভিমত–এই বিলের মধ্য দিয়ে মেডিকেল শিক্ষায় কেন্দ্রীয় সরকারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণই কায়েম হবে শুধু না, শিক্ষার মানের, চিকিৎসার মানের অবনমন ঘটবে এবং মেডিকেল শিক্ষার বেসরকারিকরণ ত্বরান্বিত হবে৷ চিকিৎসকরা দেশব্যাপী প্রবল প্রতিবাদে নেমেছেন৷ মেডিকেল সার্ভিস সেন্টার, সরকারি ডাক্তারদের সংগঠন সার্ভিস ডক্টরস ফোরাম, জুনিয়র ডক্টরস ইউনিটি এবং ছাত্র সংগঠন এ আই ডি এস ও এই বিলের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে৷
পূর্বতন মেডিকেল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এমসিআই)–কে ভেঙে দিয়ে এই কমিশন গঠন করা হয়েছে৷ ভাঙার পিছনে সরকারের যুক্তি হল এই সংস্থা নাকি দুর্নীতিগ্রস্ত৷ প্রয়োজন ছিল দুর্নীতি বন্ধ করা বা দুর্নীতিগ্রস্তদের সরিয়ে দেওয়া৷ কিন্তু তা না করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত একটি সংস্থাকে ভেঙে দিয়ে মূলত মনোনয়ন নির্ভর কমিটি গঠন কী উদ্দেশ্যে? কমিটির বেশিরভাগ সদস্যই হবে সরকারের দ্বারা মনোনীত৷ মাত্র ৫ জন সদস্য আসবেন রাজ্য মেডিকেল কাউন্সিল থেকে নির্বাচিত হয়ে৷ বিলে পরিষ্কার বলা আছে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ মতো কমিশনকে কাজ করতে হবে, না করলে ৬ মাসের মধ্যেই ভেঙে দেবে৷ এতেই স্পষ্ট, সরকার এক বিশেষ দূরভিসন্ধি নিয়ে এই কমিশন গঠন করেছে, তাকে নিজের রবার স্ট্যাম্পের মতো ব্যবহারের উদ্দেশ্যে৷
এই কমিশন ডাক্তার নয় এমন ব্যক্তিদেরও চিকিৎসার লাইসেন্স দেওয়ার কথা বলেছে৷ কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডার নামে ৬ মাসের ট্রেনিং প্রাপ্তদের চিকিৎসার লাইসেন্স দেবে৷ এর ফল কী দাঁড়াবে? মানুষ ভ্রান্ত চিকিৎসার স্বীকার হবেন৷ দেশে কি এম বি বি এস ডাক্তারের অভাব? বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা (হু)–র মানদণ্ড বলে, ১ হাজার মানুষ প্রতি একজন ডাক্তার৷ ভারতে বর্তমানে ১২৮৬ জন প্রতি ১ জন ডাক্তার রয়েছেন৷ দেশে যে পরিমাণ মেডিকেল কলেজ তৈরি হয়েছে তাতে ‘হু’ নির্ধারিত মানদণ্ডে যেতে খুব বেশি দেরি হবে না৷ আসল সমস্যাটা আছে ডাক্তারদের কাজে লাগানোর সরকারি দৃষ্টিভঙ্গিতে৷ ডাক্তারদের উপযুক্ত বেতন, সম্মান, কাজের জায়গায় নিরাপত্তা এবং চিকিৎসার প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো দেওয়া হলে, নিয়মিত নিয়োগ হলে সরকারি ক্ষেত্রে ডাক্তারের অভাব হওয়ার কথা নয়৷ সরকার এই দায়িত্ব পালন না করে ঘুরপথে কম বেতনের ডাক্তার দিয়ে জনচিকিৎসার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে প্রহসনে পরিণত করতে চাইছে৷
কেন্দ্রীয় সরকার চিকিৎসা ব্যবস্থা ক্রমাগত বেসরকারিকরণ করে চলেছে৷ দ্বিতীয় ও তৃতীয় জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি, এন আর এইচ এম, প্রাইভেট–পাবলিক পার্টনারশিপ (পি পি পি), আয়ুষ্মান ভারত বা বিমা নির্ভর চিকিৎসা ইত্যাদির মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যকে দ্রুত কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের মুনাফা লোটার যন্ত্রে পরিণত করছে এবং এরই পরিপূরক ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করতে চলেছে৷ যারা ডাক্তারির থেকে সেলসম্যানের কাজটা বেশি বুঝবে৷ বেসরকারিকরণ তীব্রতর করার লক্ষ্যেই সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করার চেষ্টা৷ এই লক্ষ্যেই নিম্নমানের ডাক্তার তৈরি করা৷
মেডিকেল কমিশন বলেছে, এম বি বি এস পাশের জন্য এবং ডাক্তারি লাইসেন্স পাওয়ার জন্য সকলকেই ‘নেক্সট’ (ন্যাশনাল এক্সিট টেস্ট) পরীক্ষা দিতে হবে৷ বিদেশ থেকে পাশ করে এলে তিনিও এই পরীক্ষা দিয়ে চিকিৎসার লাইসেন্স পাবেন৷ বিদেশ থেকে পাশ করে আসা ছাত্ররাও তাদের হাতে কলমে দক্ষতা আছে কিনা তার পরীক্ষা ছাড়াই কেবলমাত্র একটা এমসিকউ ভিত্তিক পরীক্ষা দিয়েই ডাক্তারির লাইসেন্স পেয়ে যাবেন এবং পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনে পড়ার সুযোগ পাবেন৷ ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কেবল টাকার বিনিময়ে মেডিকেল ডিগ্রি কেনাবেচার যে চক্র চলছে তা আরও সক্রিয় হয়ে উঠবে এবং তারাই অনেক বেশি লাভবান হবে৷ লাভবান হবে আমাদের দেশের বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলির মালিকরাও৷ এনএমসি–র দৌলতেই একেবারে পরিকাঠামোহীন কলেজ থেকে মেডিকেল সার্টিফিকেট কেনা ছাত্ররাও ‘নেক্সট’ পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ডাক্তারি লাইসেন্স পাবে এবং পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনে ভর্তির সুযোগ পাবে৷ এর ফলে বেসরকারি কলেজগুলির মেডিকেল শিক্ষার ব্যবসা আরও ফুলে ফেঁপে উঠবে৷ অত্যন্ত নিম্নমানের ডাক্তারে দেশ ছেয়ে যাবে, মার খাবে জনস্বাস্থ্য৷