প্রথমে টাকা জমা করতে হবে হাসপাতালের অ্যাকাউন্টে, তারপর রোগীর চিকিৎসা। মরণাপন্ন রোগী ধুঁকতে ধুঁকতে বাইরে পড়ে থেকে মরে যাবে। আমরা সভ্য সমাজে বাস করি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অভূতপূর্ব অগ্রগতির বড়াই করি, কয়েক ফুট দূরত্বে অি’জেন সিলিন্ডার, সামান্য অি’জেন দিলে মানুষটার প্রাণ বাঁচে। কিন্তু না, এমনটা হওয়ার নয়– আগে অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করতে হবে। আপনি হয়ত ভাবছেন, এ হাসপাতাল না কসাইখানা?
হ্যাঁ, এটা হাসপাতাল। বেসরকারি হাসপাতাল। করোনা অতিমারি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেসরকারিকরণের বিষময় ফল কত মারাত্মক হতে পারে! তবে এ তো আর হঠাৎ করে হয়নি! বহু দিন ধরে এই বিষবৃক্ষ ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে আজ ফুলে-ফলে পল্লবিত হয়ে সমাজের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। কীভাবে এমন হতে পারল? কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি জনসাধারণের চিকিৎসার দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে মালিকদের অবাধে ছাড় দিয়ে গেছে স্বাস্থ্য নিয়ে ব্যবসা করার জন্য। সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে পরিকল্পিত ভাবে, যাতে অসহায় মানুষ যেতে বাধ্য হয় বেসরকারি কর্পোরেট হাসপাতালগুলিতে। চিকিৎসা একটা অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা, যে কোনও সভ্য দেশে যা জনগণের বিনামূল্যে পাওয়ার কথা, তাকে আজ সম্পূর্ণ রূপে একটা লাভজনক পণ্যে পরিণত করা হয়েছে। আমরা আগেও দেখেছি, বেসরকারি হাসপাতালে টাকা না মেটালে মৃতদেহ আটকে রাখা, চিকিৎসা না করে লক্ষ লক্ষ টাকার বিল করা– এসব ছিলই। এই করোনা পরিস্থিতিতে আমরা দেখছি এর নৃশংস নগ্ন রূপ।
অথচ এখনও পর্যন্ত সরকার কোনও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারল না। একটার পর একটা দুর্নীতির খবর আসছে, একটার পর একটা দুঃখজনক মৃত্যু– সরকার নির্বিকার। বেসরকারি হাসপাতালের এই ব্যবসা বন্ধ করার জন্য আজ পর্যন্ত কোনও সরকারি নির্দেশ জারি হল না। একটার পর একটা অনুরোধের বার্তা গেল শুধু। কোনও অপরাধীর কোনও শাস্তি হল না। মানুষ যখন তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ল সরকারের বিরুদ্ধে, বিগত দিনের অনেক ঘটনার মতোই, মালিকদের দুর্নীতি আড়াল করার জন্য আবারও একটা কমিটি করে দেওয়া হল। মনে রাখতে হবে একই রকম ভাবে বেসরকারি স্কুলগুলিতে লাগামছাড়া ফি-এর প্রতিবাদে রাজ্য জুড়ে অভিভাবকরা যখন তীব্র আন্দোলনে ফেটে পড়েছেন, লকডাউনেও স্কুলের বিদ্যুতের বিল, স্কুল বাসের ভাড়া, ডেভেলপমেন্ট ফির নামে স্কুল-মালিকরা লুট করছে লক্ষ লক্ষ টাকা, রাজ্য জুড়ে অভিভাবকরা প্রতিবাদে পথে নেমে এসেছেন, সেই সময়ও ক্ষোভ সামাল দিতে কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে, অধিকাংশ এইরকম কমিটিই অশ্বডিম্ব ছাড়া আর কিছুই প্রসব করে না। এবারেও তার কোনও ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না।
আজ বেসরকারি হাসপাতালের বেআব্রু লালসার কুৎসিত রূপ দেখে, মানুষের জীবন বাজি রেখে মালিকের মুনাফা লোটার নির্মমতায় হয়ত মনে হচ্ছে, বেসরকারি হাসপাতাল ভাল নয়, কিংবা মনে হচ্ছে, লাভ করুক, তাই বলে এত! তিন লাখ নাকি পঞ্চাশ হাজার– এ নিয়ে বিতর্কে আসর গরম করছে কেউ কেউ। কিন্তু বিড়ালকে মাছ পাহারা দিতে বললে তার ফল যা হওয়ার তা হবেই। বেসরকারিকরণ হবে, আর ব্যবসা হবে না, এ তো সোনার পাথরবাটি! পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত নিয়মই হল, মালিক ব্যবসা করে সর্বোচ্চ মুনাফার জন্য। সরকারগুলি এইসব মালিকের সেবাদাস, তাই স্বাস্থ্য, শিক্ষা থেকে শুরু করে রেল, কয়লা, বিদ্যুৎ সবকিছুরই বেসরকারিকরণ করা হচ্ছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে অবাধে চলছে লুট। হাসপাতালের করিডোরে পড়ে পড়ে মৃত্যু চোখে দেখা যায়, বাকি ক্ষেত্রগুলিতেও মালিকের লাভ করার উন্মত্ত লোভ কত লক্ষ লক্ষ দরিদ্র মানুষের জীবন কেড়ে নেয়, তার হিসেব কে রাখে! কোটি কোটি বেকার দেশ জুড়ে। তার উপর করোনার দুর্বিষহ অবস্থার সুযোগ নিয়ে সরকার মালিকের স্বার্থে শ্রম আইন সংশোধন করল, শ্রমের সময় বাড়ল, মজুরি কমালো, রেল সহ সমস্ত ক্ষেত্রে অসংখ্য ছাঁটাই। না খেতে পাওয়া মানুষের সামনে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও পথ খোলা রইল না। এই করোনা অতিমারি দেখিয়ে দিল, বিশ্বের কোনও পুঁজিবাদী দেশই জনস্বার্থ দেখে না। মানুষ বাঁচল কি মরল তাতে কোনও মালিকের কিছু আসে যায় না, তাদের মুনাফা হলেই হল, কোনও সরকারেরও কিছু আসে যায় না, মালিকের সেবা করে ক্ষমতায় টিকে থাকাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য।
তাই অসহায় মানুষের মৃত্যু যে বিবেক-যন্ত্রণা সৃষ্টি করে, তা উপশমের একমাত্র উপায় সমস্ত রকম বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে আরও উন্নত করে বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলনই পারে এই নির্মম মৃতুস্রোতকে আটকাতে।