একটি প্রাচীন প্রবাদ ‘শূন্য কলসির আওয়াজ বেশি’৷ অথবা ‘যত গর্জায় তত বর্ষায় না’৷ কথাগুলি মনে পড়ছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কিছু প্রকল্পকে ঘিরে৷ ক্ষমতায় এসেই তিনি ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, ‘স্কিল ইন্ডিয়া’ ইত্যাদি নানা প্রকল্প ঘোষণা করেছিলেন৷ শুনে শিক্ষিত মানুষজনেরও একটা বিরাট অংশ ধন্ধে পড়েছিলেন, কী প্রসব করবে এই প্রকল্পগুলি? ‘বিশেষজ্ঞ’রা অনেক কসরৎ করে বিশ্লেষণ করে দেখানোর চেষ্টা করলেন এগুলি কর্মসংস্থান ঘটাবে৷ শুনে অনেকেরই ভিরমি খাওয়ার মতো অবস্থা৷ তাঁদের প্রশ্ন, কর্মসংস্থানই যদি লক্ষ্য হয়, তাহলে সরাসরি কর্মসংস্থান প্রকল্প বললেই তো হত, এসব গালভরা চমক দেওয়ার নামের কী প্রয়োজন ছিল?
প্রয়োজন ছিল দুটো কারণে৷ প্রথমত এই প্রকল্পগুলি ছিল কংগ্রেস পরিচালিত পূর্বতন ইউ পি এ সরকারের৷ বিজেপি, কংগ্রেসের কর্মসূচিই রূপায়ণ করছে এটা আড়াল করার রাজনৈতিক প্রয়োজন ছিল৷ দ্বিতীয়ত, কর্মসংস্থান নিয়ে বেকারদের মধ্যে একটা আশা জাগাতে প্রকল্পগুলির কিছু মধুমাখা নাম দেওয়ার দরকার ছিল৷ ২০১৪ সালে মেক ইন ইন্ডিয়া, ২০১৫ সালে স্কিল ইন্ডিয়া ঘোষণা করলেন প্রধানমন্ত্রী৷ অতি তৎপরতার সাথে ডজন ডজন বিদেশ সফর করলেন৷ রসিক লোকেরা তাঁকে ভারতের বিদেশমন্ত্রী বলে সম্বোধন করতে শুরু করলেন৷ বিদেশি বিনিয়োগ আসবে বলে কিছু ‘মউ’ স্বাক্ষরিত হল৷ বাস্তবে ক’টা বিনিয়োগ হয়েছে? ক’টা শিল্প হয়েছে? দেশের মানুষ জানেন না কোথায় শিল্প হয়েছে, তাতে কতজন চাকরি পেয়েছে৷ সবটাই একটা বাগাড়ম্বরের প্যাকেজ– যা প্রধানমন্ত্রী তাঁর সাড়ে তিন বছরের শাসনে দেশবাসীর সামনে বার বার উপস্থিত করেছেন৷
পুঁজিপতিরা, পুঁজিপতিদের দলগুলি এবং তাদের চিন্তার পরিমণ্ডলে থাকা অনেক মানুষই একটা কথা বলে থাকেন, চাকরি কী করে হবে, দক্ষতা আছে কি? প্রশিক্ষণ আছে কি? তাঁরা মনে করেন বেকার সমস্যার কারণ দক্ষতার অভাব৷ ২০০৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট পলিসি ঘোষণা করে৷ তাতে বলা হয় ২০২২ সালের মধ্যে দেশের মোট ৫০ কোটি মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে৷ এজন্য একটি মন্ত্রকও তৈরি হয়৷ কয়েক লক্ষ যুবক প্রশিক্ষিতও হয়৷ কিন্তু তার কত অংশ কাজ পেয়েছে? ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (এন এস ডি সি)–র হিসাব বলছে, স্ট্যান্ডার্ড ট্রেনিং অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড রিওয়ার্ড স্কিম–এর অধীনে প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের মধ্যে মাত্র ৮.৫ শতাংশের চাকরি শেষপর্যন্ত হয়েছে, অর্থাৎ প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের ৯১.৫ শতাংশেরই চাকরি হয়নি৷ প্রধানমন্ত্রী কৌশল বিকাশ যোজনার সরকারি ওয়েবসাইটের তথ্যও বলছে ২০১৬–’১৭ সালে প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের ৮৩.৪ শতাংশই চাকরি পায়নি৷
কেন চাকরি হল না? এক সময় শিল্প সংস্থাগুলি লোক নিয়োগ করে তাদের ট্রেনিং দিয়ে কাজের যোগ্য করে তুলত৷ এখন ব্যক্তিগত খরচে বা সরকারি খরচে প্রশিক্ষণ নিয়ে এলেও কেন শিল্প সংস্থায় চাকরি হচ্ছে না? এই অন্ধকার জায়গাটিতে কোনও সরকারই আলো ফেলার চেষ্টা করছে না৷
এই ভয়াবহ অবস্থার জন্য দায়ী ক্রমাগত শিল্প না হওয়া৷ সিঙ্গুরে ন্যানো গাড়ি কারখানা না হওয়ার জন্য কেউ কেউ চাষিদের প্রতিবাদ আন্দোলনকে দায়ী করে থাকেন৷ তাঁরা নিশ্চয়ই এ খবর রাখেন যে, গুজরাটের সানন্দে গড়ে ওঠা ওই ন্যানো কারখানার বর্তমান উৎপাদন দিনে মাত্র দু’টি গাড়ি৷ উৎপাদিকা শক্তির একটা বিরাট অংশ টাটাকে অলস করে রাখতে হচ্ছে৷ কারণ, বিক্রি হচ্ছে না৷ দেশের বেশির ভাগ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা ক্রমাগত কমছে৷ শিল্প পণ্য কিনবে কে? এই বাজার সংকটই শিল্পায়নের সামনে মূল বাধা এবং তা সৃষ্টি করছে পুঁজিবাদী অর্থনীতি৷ ফলে আপাতদৃষ্টিতে শিল্প না হওয়া বেকারত্বের কারণ হলেও প্রকৃত বিচারে এর কারণ বিদ্যমান পুঁজিবাদী অর্থনীতি৷ লক্ষণীয় বিষয় হল, এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) ছাড়া অন্য কোনও দলই এই বিষয়টিকে সুনির্দিষ্ট করে দেখায় না৷
কোটি বেকারের চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ কিন্তু প্রতিশ্রুতি পূরণে তাঁর আগ্রহ বা ইচ্ছা কোনওটাই নেই৷ সংবাদে প্রকাশ, ভারতীয় রেলে এই মুহূর্তে শূন্য পদের সংখ্যা আড়াই লক্ষের বেশি৷ সেখানে বেকারদের নিয়োগের পরিবর্তে সরকার পুনর্নিয়োগ করছে রেলের অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদেরই৷ সম্প্রতি রেলমন্ত্রক ঘোষণা করেছে ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত কর্মীদের চাকরি করতে হবে৷ কেন এই ঘোষণা? প্রথমত, ৬০ বছরে যাঁদের অবসর নেওয়ার কথা, ৬৫ হলে এই মুহূর্তে তাঁদের পেনশন দিতে হচ্ছে না৷ দ্বিতীয়ত, যে পাঁচ বছর এঁদের দিয়ে কাজ করানো হবে সেই সময়ের জন্য গ্র্যাচুইটি, পেনশন দিতে হবে না, শুধু মূল বেতনটুকু দিলেই হবে৷ সরকারের এই সিদ্ধান্ত বেকারদের স্বার্থের বিরোধী৷
সমস্ত বেকারের কাজ পেতে হলে বেকার সৃষ্টির অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বদলাতে হবে৷ অন্য কোনও টোটকাই কাজ দেবে না৷ দিতে পারে না৷