রেলের এনটিপিসি ক্যাটেগরি (নন-টেকনিকাল পপুলার ক্যাটেগরি) এবং গ্রুপ ডি পদে নিয়োগে বিজেপি সরকারের দুর্নীতি ও চরম অনিয়মের বিরুদ্ধে বিহার- উত্তরপ্রদেশে ছাত্র-যুবরা আন্দোলনে ফেটে পড়েছে। পুলিশি নির্যাতন সত্তে্বও ২৪ জানুয়ারি থেকে এই আন্দোলন চলছে। ২৮ জানুয়ারি এআইডিএসও, এআইডিওয়াইও সহ বিভিন্ন বামপন্থী ছাত্র-যুব সংগঠনের ডাকে পালিত হয়েছে সর্বাত্মক বিহার বনধ। এই নিয়োগের নোটিস বেরিয়েছিল ২০১৯ সালে।
৩৫ হাজার ৪০০ পদের জন্য আবেদন করেন ১ কোটি ২৭ লক্ষ প্রার্থী। অর্থাৎ প্রতিটি পদে আবেদনকারী ৩৩০ জনের বেশি। পরীক্ষার্থীরা ৫০০ টাকা ফি-ও জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু পরীক্ষা নিয়ে টালবাহানা চলে। ২০২১-এর জুলাইতে রেল রিত্রুটমেন্ট বোর্ড কম্পিউটার ভিত্তিক পরীক্ষা নেয়। ৬ মাস পর ২৪ জানুয়ারি রেজাল্ট বের হলে তাতে বহু অনিয়ম দেখা যায়।
নিয়মানুসারে প্রতিটি পদের জন্য কুড়িজনকে ধরে ৭ লক্ষ ৮ হাজার প্রার্থীর মেধা তালিকা প্রকাশিত হওয়ার কথা। কিন্তু তালিকায় আছে তার অর্ধেক। অনিয়ম শুধু এখানেই নয়, নিয়োগের জন্য নির্দিষ্ট পদের যোগ্যতা অনুযায়ী লিখিত পরীক্ষা, ইন্টারভিউ ইত্যাদি হওয়ার কথা থাকলেও রিত্রুটমেন্ট বোর্ড জানিয়ে দেয়, তারা দ্বিতীয় দফায় কম্পিউটার ভিত্তিক সাধারণ পরীক্ষা আবার নেবে। গ্রুপ ডি-র জন্যও বাড়তি একটি পরীক্ষা চাপিয়ে দিতে চায় রেল।
এই নোটিস দেখেই ক্ষোভে ফেটে পড়ে ছাত্র-যুবরা। প্রথম দিন পাটনাতে বিক্ষোভে বিজেপি-জেডিইউ জোট সরকারের পুলিশ লাঠি চালিয়ে আন্দোলন ভাঙার ঘৃণ্য পথ নেয়। এতে ছাত্র-যুব শক্তির ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। পরদিন থেকে আন্দোলন মজফফরপুর, জাহানাবাদ, গয়া সহ বিহারের বহু স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদেও বিক্ষোভ শুরু হয়। এই বিক্ষোভ ভাঙতে বিজেপি সরকারের পুলিশ ব্যাপক অত্যাচার নামিয়ে আনে।
এলাহাবাদে ছাত্রাবাসগুলিতে ঢুকে পুলিশ ফ্যাসিস্ট কায়দায় ছাত্রদের টেনে বার করে প্রবল মারধোর করে। এই বর্বর অত্যাচারের প্রতিবাদ জানিয়ে এআইডিএসও-র সাধারণ সম্পাদক কমরেড সৌরভ ঘোষ ও এআই ডিওয়াইও-র সাধারণ সম্পাদক কমরেড অমরজিত কুমার বলেন, অবিলম্বে ছাত্র-যুবদের উপর পুলিশি নির্যাতন বন্ধ করে অত্যাচারের জন্য দায়ী পুলিশকর্তাদের শাস্তি দিতে হবে। এআইডিএসও এবং এআইডিওয়াইও উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারের রাজ্যপালের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি জানায় অবিলম্বে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।
বিজেপি নেতা তথা বিহারের প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী সুশীল মোদি বেকার যুবকদের বিভ্রান্ত করার জন্য বলেন, রেলমন্ত্রীর সাথে তাঁর কথা হয়ে গেছে। রেলমন্ত্রক চাকরিপ্রার্থীদের সব দাবি মেনে নিয়ে দ্রুত নিয়োগ শুরু করে দেবে। কিন্তু এটা যে কত বড় ধোঁকা, তা ধরতে কারও অসুবিধা হয়নি। ফলে আন্দোলন থেকে সরে না গিয়ে এআইডিএসও, এআইডিওয়াইও সহ বামপন্থী ছাত্র-যুব সংগঠনগুলি ২৮ জানুয়ারি বিহার বনধের ডাক দেয়। সরকারের সমস্ত রক্তচক্ষু এবং বাধা উপেক্ষা করে বিহারের সাধারণ মানুষ এই বনধকে সর্বাত্মক সফল করেন। ওইদিন পাটনা সহ সারা বিহারেই ছাত্র-যুবরা পথ অবরোধ, রেল রোকোতে সামিল হন। মিছিলে অংশ নেন শত শত মানুষ। চাকরিপ্রার্থী যুবক-যুবতীদের সাথে মিলে রাজ্যের সর্বস্তরের মানুষ আন্দোলনের প্রতি তাঁদের সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দেন।
বেকারদের কার্যত প্রতারণা করে চাকরির বিষয়টি দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রেখেছে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার। রেলে প্রায় চার লক্ষ পদ খালি হলেও এবং তার জন্য পরিষেবা বিঘ্নিত হলেও নিয়োগ হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় সরকারের ২৪ লক্ষ পদ খালি, অথচ রেল সহ কোনও ক্ষেত্রেই সরকার নিয়োগ করছে না। রেলের এই এনটিপিসি ক্যাটেগরির নিয়োগকেও এ কারণেই যতদিন সম্ভব ঝুলিয়ে রেখে বেশিরভাগ কাজই আউটসোর্সিং করে বেসরকারি হাতে তুলে দিতে চাইছে বিজেপি সরকার। সে জন্যই নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে তারা টালবাহানা করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই রেলকে ধাপে ধাপে বেসরকারি হাতে বেচে দেওয়ার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর। শূন্যপদ পূরণও করছে না তারা। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসে বলেছিলেন বছরে দুই কোটি বেকারের চাকরির ব্যবস্থা করবেন তিনি। কিন্তু সাত বছরে ১৪ কোটি চাকরি দূরে থাক বিজেপি সরকারের আমলে বেকারত্বের হার ৪৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। কেন্দ্রীয় সরকারের হাউসহোল্ড সার্ভে বলছে, এ দেশের কর্মক্ষম মানুষের ৫৩ শতাংশের কোনও রোজগার নেই। উত্তরপ্রদেশে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের ২১ শতাংশ বেকার, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমাধারীদের ৬৬ শতাংশ এবং ডিগ্রিধারীদের ৪৬ শতাংশ বেকার। যে কারণে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে লড়তে গিয়ে বিজেপি নেতাদের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে ভোট জোগাড়ের চেষ্টা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকছে না।
বিহার-উত্তরপ্রদেশের এই আন্দোলন নতুন করে দেখিয়ে দিল আজ কী ভয়াবহ বেকারত্বের পরিস্থিতি। আজ ছাত্র-যুবদের বুঝতে হবে বিজেপি সরকারের বেসরকারিকরণ নীতির কারণে যতটুকু চাকরি আছে সেটাও থাকবে না। এর বিরুদ্ধেই শুধু নয়, আন্দোলন পরিচালিত হতে হবে কর্মনাশা এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও। ১৯৭০-এর দশকে বিহারে দুর্নীতি বিরোধী সংগ্রাম ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। আজকে বিহার, উত্তরপ্রদেশ সরকারি দুর্নীতির বিরুদ্ধে ধিকিধিকি জ্বলছে।