বেকারত্ব চরমে অথচ সরকারি চাকরির দরজা বন্ধ

 

 

যুব সংগঠন এ আই ডি ওয়াই ও এর ডাকে হাজার হাজার যুবক ভোপালে সকল বেকারের কাজের দাবিতে এবং সরকারি শূন্য পদে অবিলম্বে নিয়োগের দাবিতে ১৮ আগস্ট কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল।

সত্তরের দশকের বিখ্যাত সিনেমা ‘জনঅরণ্য’ তুলে ধরেছিল স্বাধীন ভারতে বেকারত্বের ভয়াবহ সমস্যা। পঞ্চাশ বছর পরে আজও এই রাজ্য সহ সারা দেশ জুড়ে বেকার সমস্যার আরও ভয়াবহ রূপ দেখছি আমরা। অথচ সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত কেন্দ্র ও রাজ্যের সমস্ত সরকারি দলই দাবি করে এসেছে, তাদের আমলে প্রচুর চাকরি হয়েছে। প্রচুর চাকরি সত্যিই হলে এই ভয়াবহতম বেকার সমস্যা কি আকাশ থেকে পড়ল, না মাটি ফুঁড়ে উঠল?

প্রতিটি পদে চাকরির জন্য লাখ-লাখ আবেদনপত্র জমা পড়ে। পশ্চিমবঙ্গের ২৩০টি বন-সহায়ক পদে আবেদনপত্র জমা পড়েছিল ১ লক্ষ ৩০ হাজার। পুলিশের মাত্র ৬২টি পিয়ন পদের জন্য আবেদন পড়ে প্রায় এক লক্ষ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পিয়নের পদই হোক বা এনআরএস-এ ডোমের চাকরি অথবা রেলের গ্যাংম্যান– সব ক্ষেত্রেই আবেদন করেছেন স্নাতক, স্নাতকোত্তর, পিএইচডি, এম টেক, বি টেক-এর মতো উচ্চশিক্ষিতরাও। শুধু তাই নয়, এ রাজ্যে শিক্ষিত যুবককে বেঁচে থাকার জন্য বেসরকারি সংস্থায় ঘর মোছা বা হোটেলে বাসন মাজা অথবা ট্রেনে হকারির কাজ করতে হয়। চাকরি না পেয়ে বা যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ না পেয়ে আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছে অনেকেই এবং সেই সংখ্যা বাড়ছে প্রতি বছর। এ দেশে প্রতি বছর অন্তত ৪৫ হাজার আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে বেকারত্বের কারণে। সোনারপুরের এমএ পাস অতনু বা বালির স্নাতক বাপি, ঢাকুরিয়ার ইঞ্জিনিয়ার নীলাদ্রি অথবা ইংরেজিতে অনার্স বিএড পাস কালনার সন্ন্যাসী– এঁদের কথা আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি! এঁরা পড়াশোনা করেছিলেন চাকরি করে পরিবারের দায়িত্ব বহন করবেন বলে, জীবনটাকে একটু ভালো ভাবে কাটাবেন এই আশায়। বেঁচে থাকার অধিকার তাঁদের ছিল, কিন্তু বেকারত্ব তাঁদের বাঁচতে দিল না। কেন তাঁরা চাকরি পেলেন না? চাকরি নেই কেন?

পূর্বতন সিপিএম সরকারের আমলে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নথিভুক্ত বেকার প্রায় এক কোটিতে পৌঁছেছিল। বন্ধ হয়েছিল ছোট-বড় ৫৬ হাজার কল-কারখানা। হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যাল তৈরির সময় কয়েক লক্ষ চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সিপিএম সরকার। কিন্তু সর্বসাকুল্যে কাজ হয়েছিল ৯০০ জনের। ক্ষমতায় আসার পর তৃণমূল কংগ্রেস এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ তুলে দিয়ে চালু করল এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্ক। যে ব্যাঙ্কে নাম লিখিয়ে লক্ষ লক্ষ যুবক-যুবতী বছরের পর বছর বসে আছে, চাকরির দেখা নেই। চাকরি বলতে কিছু সিভিক ভলান্টিয়ারের কাজ, যার না আছে স্থায়িত্ব না উপযুক্ত বেতন! ২০১৩ সালে ঘটা করে যুবশ্রী প্রকল্প চালু হল। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন প্রতি বছর এক লক্ষ যুবশ্রীকে সরকারের নানা দপ্তরে কাজ দেওয়া হবে। পরবর্তী বছরে উঠে আসবে নতুন আর এক লক্ষ যুবশ্রী। কিন্তু আট বছর পরেও রাজ্যের প্রথম এক লক্ষ যুবশ্রীরই কাজ জোটেনি।

গত ১০ বছরে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি চাকরির নিয়োগ একদম তলানিতে। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে যতটুকু নিয়োগ হয়েছে, তা চুক্তিভিত্তিক। সিএমআইই-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাজ্যে বেকারত্বের হার বর্তমানে ২২.১৪ শতাংশ। চটকল সহ বহু কলকারখানা বন্ধ, ক্ষুদ্র ব্যবসা সংকটগ্রস্ত। গ্রামে কাজ নেই। জনসংখ্যার ২০-৩০ শতাংশ কাজের সন্ধানে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে। গত পাঁচ বছরে মহিলা বেকার লাফিয়ে বেড়েছে। রাজ্যে কর্মক্ষম মহিলাদের ৪১ শতাংশই বেকার। গত সাত বছরে শিক্ষক নিয়োগ সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি চাকরির বিজ্ঞপ্তিই প্রকাশ হয়নি। রাজ্যের মানুষ গত কয়েক বছর ধরে দেখছেন, শিক্ষক, গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি সহ বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষায় পাশ করে বসে থাকা চাকরিপ্রার্থীরা নিয়োগের দাবিতে আন্দোলন করতে বাধ্য হচ্ছেন। শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী, ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, খাদ্য দপ্তর, পুলিশের চাকরি, গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তর এবং আরও নানা বিভাগ ধরলে রাজ্যে শূন্যপদের সংখ্যা ৫ লক্ষেরও অধিক। বছরের পর বছর নিয়োগ ঝুলে রয়েছে। নিয়োগের নামে দুর্নীতি, তাকে ভিত্তি করে মামলা আর নিয়োগ আটকে যাওয়া– চক্রাকারে এমনই চলছে।

বিশ্বে সব থেকে বেশি যুবকের বাস ভারতবর্ষে। কিন্তু সেই যুবসম্প্রদায়কে নিয়ে কোনও সরকারের কোনও ভাবনা নেই! চাকরির দাবিতে রাস্তায় নামলে জুটছে পুলিশের লাঠি-অত্যাচার। কেন্দ্র হোক বা রাজ্য– দুই সরকারই ‘পকোড়া ভাজো, তেলেভাজা ভাজো’– এ সব উপদেশ দেওয়া ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি। সারা দেশে বেকারত্ব ১৪ শতাংশেরও বেশি। কিন্তু কর্মক্ষম মানুষের ক্ষেত্রে এই হিসাবটা আরও ভয়াবহ। সমগ্র ভারতবর্ষে কর্মক্ষম ৭৭ কোটি জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ বেকার।

সরকারি বেকারত্বের হিসেবে থাকে অনেক কারিকুরি। মূলত নথিভূক্ত বেকারদের যত শতাংশ কাজ পেল না তা দিয়ে তৈরি হয় বেকারের হিসাব। বাস্তবে নথিভুক্ত নয়, এমন বেকারের সংখ্যাটা নথিভুক্ত বেকারের থেকে অনেক বেশি। যে কোটি কোটি মানুষ, শিক্ষিত যুবক সামান্য মজুরিতে যে কোনও একটা কাজ করছে, তাদের বেকার হিসাবে ধরা হয় না। কায়িক পরিশ্রমের কাজ তবুও সামান্য কিছু জুটছে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে শিক্ষাগত যোগ্যতা যেখানে যত বেশি, বেকারত্ব সেখানে তত বেশি। গ্রামে কোনও রোজগার নেই। মানুষ কাজের আশায় শহরমুখী। শহরেও কর্মসংস্থানের হার সমগ্র দেশে ৪ শতাংশ থেকে সর্বাধিক ২৫ শতাংশ। শুধুমাত্র কোর ইন্ডাস্ট্রি নয়, প্লাস্টিক ও কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি- হেলথ সেক্টর-আইটি-টেলিকম সেক্টর, ব্যাঙ্ক-ফিনান্সিয়াল সার্ভিস-ট্রান্সপোর্ট- রিয়েল এস্টেট-ট্রেড-হোটেল ম্যানেজমেন্ট-রেস্তোরাঁ– প্রায় সর্বক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের হার ঋণাত্মক, -১০ শতাংশ থেকে -৫০ শতাংশ পর্যন্ত। অর্থাৎ নতুন করে কোনও কাজ সৃষ্টি হচ্ছে না, উল্টে কাজ হারাচ্ছে মানুষ। সরকার নিজেই বলছে এপ্রিল ২০২০ থেকে ২০২১ এই এক বছরে দেশে কাজ হারিয়েছে ১৮ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ। এ কথা ঠিক যে করোনা অতিমারির সময় বেকার সমস্যা ভয়াবহ রূপ নিলেও পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিয়মে মানুষ কাজ হারাচ্ছিলই (সারণি দেখুন)।

সাল

কাজ আছে
২০১৬-১৭ ৪০.৭৩ কোটির
২০১৭-১৮ ৪০.৫৯ কোটির
২০১৮-১৯ ৪০.০৯ কোটির
২০১৯-২০ ৪০ ৩৫ কোটির
২০২১ জানুয়ারি ৪০ কোটির

অর্থাৎ, এই কয়েক বছরে ৭৩ লক্ষ লোক কমেছে। তেল কোম্পানি, রেল, বিএসএনএল সহ সরকারি দপ্তরে নতুন নিয়োগ বন্ধ। লক্ষ লক্ষ সরকারি কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে। ইস্পাত-খনি-সার-সিমেন্ট শিল্পে চলছে ছাঁটাই। সরকারি শূন্যপদ তুলে দেওয়া হচ্ছে।

দেশের জনসংখ্যা যখন ৫০ কোটি ছিল তখন দেশের মানুষকে পরিষেবা দিতে বা তার প্রয়োজন মেটাতে সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্রে যত শ্রমিক-কর্মচারীর প্রয়োজন হত, আজ ১৩৯ কোটি দেশবাসীকে সেই একই পরিষেবা পৌঁছে দিতে সরকারি-বেসরকারি শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তব চিত্র ঠিক তার উল্টো। মুনাফা বাড়াতে সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। বাড়ছে কাজের সময়। চাকরির সুযোগ তৈরিতে সরকারকে বাধ্য করতে হলে চাই দুর্বার আন্দোলন। ইতিমধ্যেই সারা দেশ জুড়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রের যুবকরা চাকরির দাবি আদায়ের লক্ষ্যে নিজেদের লড়াইয়ের মঞ্চ গড়ে তুলেছেন।

প্রাইমারি-আপার প্রাইমারি, গ্রুপ ডি-গ্রুপ সি,পুলিশ বিভাগে চাকরিপ্রার্থী, যুবশ্রী, পার্শ্বশিক্ষক, প্যারাটিচার, প্রাইভেট টিউটর, বাইক-ট্যাক্সি চালক, ডেলিভারি বয় সহ আরও নানা ক্ষেত্রের যুবকরা লড়াইয়ের মঞ্চ গড়ে আন্দোলন করছেন। এআইডিওয়াইও-র উদ্যোগে অনলাইন জাতীয় কনভেনশনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে বেকার যুবকদের দেশব্যাপী আন্দোলনের মঞ্চ ‘আনএমপ্লয়েড ইউথ স্ট্রাগল কমিটি’। তারই ধারাবাহিকতায় রাজ্যে বেকার যুবকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মঞ্চ আনএমপ্লয়েড ইউথ স্ট্রাগল কমিটি গড়ে উঠেছে। বেকাররা অধিকার বুঝে নিতে রাস্তায় নামছে– এটাই স্বস্তির এবং আশার।

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ৪ সংখ্যা