সাম্প্রতিক নিম্নচাপের বৃষ্টিতে রাজ্যের আলু চাষিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন জেলায় আলু খেত জলের তলায় চলে যাওয়ায় শুধু আলু নয়, ধানেরও বিরাট ক্ষতি হয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণা, গড়বেতা, শালবনি, মেদিনীপুর সদর, কেশপুর ব্লকে আলু সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত বর্ধমানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। জেলার কালনা, রায়না, মেমারি, জামালপুর, গলসি, ভাতার, মঙ্গলকোট, কেতুগ্রাম, খণ্ডঘোষ, আউশগ্রাম সর্বত্রই চাষির হাহাকার। হুগলি, পূর্ব মেদিনীপুর সহ দক্ষিণ বঙ্গের প্রায় সব জেলাই ক্ষতিগ্রস্ত। ঋণ করে চাষ করতে হয়েছে। অত্যধিক চড়া দামে বীজ-সার-কীটনাশক কিনে, অগ্নিমূল্যে ডিজেল বিদ্যুৎ কিনে চাষ করে চাষিরা একেবারে সর্বস্বান্ত। আশা ছিল, আলু বেচে ঋণ শোধ করবে। সবই গেল জলের তলায়। বাঁচার পথ নেই বুঝতে পেরে ১৭ ডিসেম্বর আত্মহত্যা করেছেন কালনার বড়ধামাস গ্রামের চাষি মানিক শেখ (৪৩)। তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ১৮ ডিসেম্বর রায়নার দেবীপুর গ্রামের চাষি জয়দেব ঘোষের (৪৮) ঝুলন্ত দেহ মেলে বাড়িতে। সেখান থেকে ১৫ কিমি দূরে বনতিয় গ্রামের কৃষক গণেশ নারায়ণ ঘোষ (৬৩) আত্মহত্যা করেন। আত্মঘাতী হয়েছেন চন্দ্রকোণার ধান্যঝাটি গ্রামের ঋণগ্রস্ত আলুচাষি ভোলানাথ গায়েন। কী করেছে সরকার? সরকার চাষিদের পক্ষে থাকলে এভাবে গভীর অনিশ্চয়তার কারণে আত্মহত্যা করতে হত না। সারা বাংলা আলু চাষি সংগ্রাম কমিটির পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রভঞ্জন জানা, প্রদীপ মল্লিক, তাপস মিশ্র, অসিত সরকাররা জানান, ২০১৯ সালে আলু ওঠার সময় অকাল বৃষ্টিতে আলু নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ২০২১ সালে আলুর দাম না থাকার কারণে আলু চাষিরা যখন ধুঁকছিল তখন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো এল এই অকাল বর্ষণ। জলের দরে ধান বিক্রি করে, মহাজনী ঋণ নিয়ে চাষ করে আলু চাষিরা আজ খাদের কিনারায়। তাঁরা ক্ষোভের সাথে বলেন, সরকার যদি অত্যন্ত তৎপরতার সাথে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করত, তা হলে এভাবে চাষিদের অকাল মৃত্যু ঘটত না। কমিটির স্বপন মাজি, বঙ্কিম মুর্মু, বীরেন মাহাতোরা বলেন, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার যুদ্ধকালীন গুরুত্ব দিয়ে আলু চাষি ও ভাগচাষিদের সরকারি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা না করলে এমন বিপর্যয় ও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
কী তাঁদের দাবি? তাঁরা বলেন, আমরা ৮ ডিসেম্বর পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক ও কৃষি আধিকারিককে ডেপুটেশন দিয়েছি, ৯ ডিসেম্বর দাবিপত্র পেশ করেছি চন্দ্রকোণা-২, মেদিনীপুর সদর, গড়বেতা-২ বিডিও-র কাছে।
১৫ ডিসেম্বর আলুচাষিদের ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করে জেলাশাসককে পুনরায় দাবিপত্র দিয়েছি। আমাদের দাবি, ক্ষতিগ্রস্ত আলুচাষি ও ভাগচাষিদের বিঘা প্রতি ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ধান, সবজি চাষিদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ক্ষতিগ্রস্তদের বিনামূল্যে বীজ-সার সরবরাহ করতে হবে, ব্যাঙ্ক ও সমবায় থেকে স্বল্প সুদে পুনরায় ঋণ দিতে হবে। রোধ করতে হবে সারের কালোবাজারি।
প্রশাসনের বক্তব্য কী? পূর্ব বর্ধমানের জেলাশাসক বলেছেন, চাষি মৃত্যুর খবর আসেনি, খোঁজ নিচ্ছি। তবে রায়নার বিডিও বলেছেন, ‘প্রাথমিক অনুসন্ধানে জেনেছি চাষের কারণে কেউ মারা যায়নি। অন্য কোনও কারণ রয়েছে।’ রায়নার তৃণমূল বিধায়ক বলেছেন, ‘চাষের কারণে কেউ আত্মহত্যা করেছেন বলে মনে হয় না।’ (আনন্দবাজার পত্রিকা-১৯.১২.২০২১)
জামানা বদল হলেও বক্তব্য একই। সিপিএম ফ্রন্ট সরকারের আমলে চাষির মৃত্যু হলে সরকারিভাবে যে অজুহাত দেওয়া হত, তৃণমূল আমলে সেটাই চলছে। পারিবারিক বিবাদ, প্রণয়ঘটিত ব্যাপার এ সব বলে সিপিএম মন্ত্রীরা নেতারা সেদিন কৃষি সঙ্কট ও সরকারের দায়িত্বহীনতাকে আড়াল করত। সেই ট্র্যাডিশন আজও চলছে। এক একটা মৃত্যু এই সব দলের চরিত্র উদঘাটিত করে দিচ্ছে।