‘‘কমরেড শিবদাস ঘোষ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, নির্বাচন হল একটা বুর্জোয়া রাজনীতি। এখানে শাসক শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী দলের প্রচারের হাওয়ায় সাধারণ মানুষ উলুখাগড়ার মতো ভেসে যায়। এ বারের লোকসভা নির্বাচন তাঁর সেই কথা আবারও প্রমাণ করল। জনসাধারণের হাজার ক্ষোভ থাকা সত্ত্বেও শাসক বুর্জোয়া শ্রেণি যে দলকে ক্ষমতায় বসাতে চেয়েছিল, তাকেই যেনতেনপ্রকারেণ সরকারে বসাতে সক্ষম হয়েছে। সরকারি ক্ষমতার লোভে সংসদীয় দলগুলির নেতাদের একে অপরের বিরুদ্ধে কাদা ছোঁড়াছুড়ি, কদর্যতা প্রদর্শন সামনে এনে দিয়েছে আজকের দিনের বুর্জোয়া রাজনীতির ক্লেদাক্ত রূপটিকে। নির্বাচনের পরে মূল্যবৃদ্ধি সহ জনজীবনের বাড়তে থাকা সংকট ও সরকারের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা আবারও প্রমাণ করল যে, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের সমস্যার সমাধান করা যায় না। তার জন্য চাই ব্যাপক গণআন্দোলন। সদ্য বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ প্রাণ তুচ্ছ করা গণআন্দোলনে সামিল হয়ে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁরা আবারও প্রমাণ করেছেন, গণআন্দোলনই দাবি আদায়ের একমাত্র রাস্তা।’’– কলকাতায় রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ের বিশাল সমাবেশে কথাগুলি বলছিলেন এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ, ৫ আগস্ট।
৫ আগস্ট ছিল এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক, এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর প্রতিষ্ঠাতা কমরেড শিবদাস ঘোষের ৪৯তম স্মরণদিবস। সেই উপলক্ষে দলের ডাকে গত কয়েক দিনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে রাজ্যের সমস্ত জেলা থেকে সমাবেশে উপস্থিত হয়েছিলেন ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ। সমাবেশস্থল ছাপিয়ে মানুষের উপচে-পড়া ভিড় পৌঁছে গিয়েছিল ডোরিনা ক্রসিং পর্যন্ত। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড চিররঞ্জন চক্রবর্তী। উপস্থিত ছিলেন অন্যান্য কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতৃবৃন্দ।
সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের প্রতিকৃতিতে মাল্যদানের মধ্য দিয়ে সমাবেশের সূচনা হয়। একে একে ফ্রন্ট ও দলের নেতৃবৃন্দ সুসজ্জিত মঞ্চে রাখা তাঁর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করেন। দলের কিশোর বাহিনী কমসোমল গার্ড অব অনার প্রদর্শন করে। সভাপতি সংক্ষেপে তাঁর বক্তব্য রাখেন। এর পর শুরু হয় প্রধান বক্তা কমরেড প্রভাস ঘোষের ভাষণ।
কমরেড প্রভাস ঘোষ বাংলাদেশে চলমান ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনের প্রশংসা করে বলেন, এর পিছনে মৌলবাদী শক্তির ভূমিকার কথা যাঁরা বলছেন, তাঁরা ঠিক বলছেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা হোস্টেলে হোস্টেলে শেখ হাসিনা নামাঙ্কিত হলগুলির নাম পাল্টে নতুন নাম রেখেছেন শহিদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, শান্তি-সুনীতি কিংবা কৃষক আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রের নামে। আন্দোলনে ভারতবিরোধী স্লোগান উঠলেও, আন্দোলনকারী ছাত্ররা ভারতের জনগণের বিরুদ্ধে নয়। তাদের ক্রোধ ভারতের কর্পোরেট পুঁজিপতি, যারা বাংলাদেশে লুট চালাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে। তিনি দেখান, দেশে দেশে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের পতাকা আজ ভূলুন্ঠিত। যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক সময় সংসদীয় ব্যবস্থাকে ‘বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, অফ দ্য পিপল’ বলে অভিহিত করেছিল, আজ সে সাম্রাজ্যবাদী রূপ নিয়ে দেশে দেশে গণহত্যা চালাচ্ছে। সে দেশের সংসদ সেই জঘন্য কাজে মদত দিচ্ছে। যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদের একান্ত প্রয়োজন। তাই রুশ সাম্রাজ্যবাদও আজ ইউক্রেনে রক্ত ঝরাচ্ছে।
ভারতের জনসাধারণের দুর্বিষহ পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, দেশ আজ ভয়ঙ্কর বেকার সমস্যায় ধুঁকছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রবল আকার নিয়েছে। শ্রমজীবী শ্রেণি সমস্ত সম্পদের স্রষ্টা হওয়া সত্ত্বেও আজ দেশের ৪০ শতাংশ সম্পদ জমা হয়েছে মাত্র ১ শতাংশ পুঁজিপতির হাতে। আর দেশের সবচেয়ে নীচের ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে মাত্র ১ শতাংশ সম্পদ। সম্প্রতি ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের পয়লা নম্বর শিল্পপতি আম্বানির পুত্রের বিবাহ অনুষ্ঠানে সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলির নেতানেত্রীদের ভিড়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই শিল্পপতি-পুঁজিপতিরাই দেশে রাজত্ব চালায়। রাজনৈতিক দলগুলি বাস্তবে এদের ম্যানেজার মাত্র। ভোটের প্রচারের বিপুল খরচ জোগায় এই পুঁজিপতিরাই। সেবাদাস দলগুলি সরকারে বসে এই পুঁজিপতিদেরই স্বার্থ রক্ষা করে চলে।
দেশের সর্বাত্মক সংকট প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি দেখান, আরএসএস-বিজেপি দেশপ্রেমের আলখাল্লা পরে কী ভাবে রামমোহন-বিদ্যাসাগর-জ্যোতিরাও ফুলে সহ নবজাগরণের চিন্তানায়কদের শিক্ষাকে ধূলিসাৎ করে দিচ্ছে। সিলেবাসে মনুসংহিতা, বেদ-বেদান্তের কথা এনে ছাত্রছাত্রীদের ধর্মান্ধ করে তুলতে চাইছে, যাতে প্রশ্ন করার মন, প্রতিবাদ করার মন গড়েই না উঠতে পারে। ধর্মের নামে মানুষে মানুষে যাতে বিভেদ বাধে, যাতে তাদের ঐক্য ধ্বংস হয়, তেমন পরিবেশ গড়ে তোলাই তাদের লক্ষ্য। তিনি দেখান, বিজেপির মতো কংগ্রেসও বুর্জোয়া শ্রেণির বিশ্বস্ত দল। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীও হিন্দু দেবদেবী নিয়ে ভোটের লোভে ধর্মের রাজনীতি করছেন, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস শাসনে নেতা-মন্ত্রীদের ব্যাপক দুর্নীতির উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই দলটিও লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, যুবশ্রীর মতো প্রকল্প চালু করে, ক্লাবগুলিকে পূজা উপলক্ষে হাজার হাজার টাকা অনুদান দিয়ে ভোট কেনার ব্যবস্থা করছে। আগের সরকারের পথ অনুসরণ করে এরাও সিন্ডিকেট-তোলাবাজি-প্রোমোটারির মাধ্যমে দাপটের রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে।
সিপিএম দল সম্পর্কে কমরেড প্রভাস ঘোষ বলেন, ৩৪ বছর ধরে রাজ্যে শাসনক্ষমতায় থেকে বামপন্থাকে তারা কলঙ্কিত করেছে। তারা শ্রমিক-কৃষকের উপর গুলি চালিয়েছে। নন্দীগ্রাম আন্দোলনে দুষ্কৃতীদের দিয়ে তারা নারীধর্ষণ পর্যন্ত করিয়েছে। আজ যখন শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে ব্যাপক বামপন্থী গণআন্দোলন গড়ে তোলাই সবচেয়ে জরুরি ছিল, তখন দু-চারটি সিটের় লোভে এই দলটি কংগ্রেসের লেজুড়বৃত্তি করে চলেছে! সিপিএম যে মার্ক্সবাদের চর্চা কোনও দিনই সঠিক ভাবে করেনি, দলটির সৎ কর্মীদের অন্ধতামুক্ত হয়ে তা বিচার করে দেখার আবেদন করেন তিনি।
জনসাধারণের প্রতি রাজনীতি বোঝার আবেদন জানিয়ে কমরেড প্রভাস ঘোষ বলেন, ভারতের মতো শ্রেণিবিভক্ত একটি দেশে প্রতিটি দলই– হয় শোষক পুঁজিপতি শ্রেণির, নয়তো শোষিত মেহনতি শ্রেণির দল। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রই যে রাজনীতি দ্বারাই নির্ধারিত হয়, তা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, বিজ্ঞানসম্মত বিচারপদ্ধতি অর্থাৎ মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-মাও সে তুং ও শিবদাস ঘোষ চিন্তাধারার ভিত্তিতে সঠিক ভাবে বিচার করে শ্রেণিদল চিনে নিতে হবে মানুষকে। তিনি দেখান, বিদ্যমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটি আজ অচল হয়ে পড়েছে। সর্বোচ্চ মুনাফা লুটের নেশায় পরিবেশ বিপন্ন করে পৃথিবীকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতেও সে দ্বিধা করছে না। মরতে বসা এই ব্যবস্থা সমাজে মূল্যবোধ-নৈতিকতার চরম অধঃপতন ঘটাচ্ছে। এ থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র রাস্তা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আঘাতে এই ব্যবস্থার উচ্ছেদ। সেই লক্ষে্য এলাকায় এলাকায়, পাড়ায় পাড়ায় গণকমিটি গড়ে তুলে জনজীবনের সমস্যাগুলি নিয়ে প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলার উপর জোর দেন তিনি, যে গণকমিটিগুলি আগামী দিনে হয়ে উঠবে জনসাধারণের সংগ্রামের হাতিয়ার। পাশাপাশি এলাকার শিশু-কিশোরদের নৈতিক অধঃপতন থেকে রক্ষা করতে তাদের নিয়ে মনীষী চর্চা ও খেলাধূলার পাশাপাশি সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার অনুরোধ জানান তিনি।