৭ ফেব্রুয়ারি, কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে স্থাপিত হয়েছে ‘মাইল স্টোন’, সাথে বিদ্যাসাগরের কাটআউট৷ সেই দৃঢ় পদক্ষেপের ছবির সামনে থমকে দাঁড়াচ্ছেন মানুষ৷ সেই ‘অজেয় পৌরুষ’, ‘অক্ষয় মনুষ্যত্ব’ সাধনার অনুশীলনের অঙ্গীকার, তাঁর চলার পথ ধরে এগিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে সুদূর শিলিগুড়ি থেকে ১ ফেব্রুয়ারি ‘অঙ্গীকার যাত্রী’রা রওনা হয়েছেন৷ আরও একদল ৪ ফেব্রুয়ারি বীরসিংহের পবিত্র মাটি ছুঁয়ে শুরু করেছেন হাঁটা৷ আর একদল আসছেন বিদ্যাসাগরের কর্মভূমি কর্মাটাঁড় থেকে৷ ৭ ফেব্রুয়ারি সকলেই এসে মিলিত হলেন কলেজ স্কোয়ারের বিদ্যাসাগর মূর্তির পাদদেশে৷
বিদ্যাসাগর মূর্তির দু–পাশে রেলিং জুড়ে প্রদর্শনী৷ একদিকে বিদ্যাসাগরের মূল্যবান উদ্ধৃতি৷ অন্যদিকে বিদ্যাসাগর সম্পর্কে অন্যান্য মনীষীদের উক্তি৷ এই মানুষটিকে চেনা যে আজ অত্যন্ত জরুরি৷ ভারতীয় সমাজ–সভ্যতাকে মেকি জাতীয়তাবাদের ধুয়ো তুলে যেভাবে পিছন দিকে ঠেলে দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে তার বিরুদ্ধে প্রগতির সংগ্রামে আজও তিনি পথ দেখান৷
সমবেত হয়েছেন রাজ্যের নানা স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা৷ সব মিলিয়ে প্রায় হাজার কিলোমিটার পথের মাঝে মাঝেই অঙ্গীকার যাত্রীদের সংবর্ধনা জানিয়েছেন অসংখ্য মানুষ৷ হুগলির দামোদরপুরে ছাত্রীরা পুষ্পবৃষ্টি করেছেন মিছিলের উপর৷ জনতার বিপুল অভ্যর্থনায়, নানা রঙের ফুল–মালায় ভরে উঠছে গোটা মিছিল৷ বিমুগ্ধবিস্ময়ে মানুষ একটাই কথা বলেছেন, ‘যারা বিদ্যাসাগরকে সঠিকভাবে চিনতে চায় সেই ছাত্রছাত্রীরাই তো অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়বে৷ যুগে যুগে অন্যায়–শোষণ–বঞ্চনার বিরুদ্ধে ছাত্ররাই তো সমাজকে জাগায়৷’
এমনই অভিজ্ঞতা হয়েছে বিদ্যাসাগরের অন্যতম কর্মস্থল ঝাড়খণ্ডের কর্মাটাঁড়েও৷ সাম্প্রদায়িক শক্তি আরএসএস–বিজেপি’র তীব্র বাধার মধ্যেই স্থানীয় জনসাধারণের গভীর ভালবাসা ও সমর্থনে ‘নন্দনকানন’–এ বিদ্যাসাগর–মূর্তিতে মাল্যদান, তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে কর্মাটাঁড় থেকে কলকাতা পর্যন্ত ‘অঙ্গীকার যাত্রা’র সূচনা হয়েছিল৷ আরএসএসের নিষেধ সত্ত্বেও ‘নন্দনকানন’–এর কেয়ারটেকার, স্থানীয় যুবক জিতেন্দ্র, তাঁর সুক্লপড়ুয়া সন্তানকে নিয়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেন৷ ছাত্রদের তিনি বলেন, ‘‘বিদ্যাসাগরের নামে অনেক অনুষ্ঠান হয়, কিন্তু আপনারা যে কথাগুলো বলছেন, যে আন্তরিকতা নিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছেন, এমন কখনও দেখিনি৷’’
‘অঙ্গীকার যাত্রা’ যখন আসানসোল শহরে ঢুকেছে সেখানকার এনআরসি–সিএএ বিরোধী লাগাতার অবস্থান আন্দোলনকারীরা ছাত্রদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, ‘‘আপনারাই সত্যিকার ভারতের রূপ তুলে ধরছেন৷’’ বীরসিংহে বিদ্যাসাগর স্মৃতিমন্দিরের পরিচালক অভিভূত হয়েছেন সমগ্র কর্মসূচিতে৷
সাত দিন ধরে প্রায় এক হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে ‘অঙ্গীকার যাত্রা’ যখন কলেজ স্কোয়ারে ঢুকছে, সে এক অসাধারণ অনুভূতি৷ বিদ্যাসাগরের পূর্ণাবয়ব ছবি বহন করে ড্রামের তালে তালে এগিয়ে আসছে অঙ্গীকার যাত্রীর দল৷ দু–পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী৷ পথ চলার ক্লান্তি ছাপিয়ে আশ্চর্য এক দীপ্তিতে উদ্ভাসিত অগণিত তরুণ–তরুণী৷ এ গুরু দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার নিচ্ছে যারা তাদের প্রতি সশ্রদ্ধ অভিবাদন তাঁদের দৃষ্টিতে৷ পতপত করে উড়ছে সাদা ধবধবে নিশান, সেখানেও বিদ্যাসাগর৷ রাস্তার দু’ধারে ছাত্র সংগঠন এআইডিএসও–র টকটকে লাল পতাকা৷
–এত দীর্ঘ এবং কঠিন কর্মসূচি কী জন্য?
উত্তর দিল উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার ছাত্র সঞ্জিত দেবনাথ, ‘‘না এসে পারলাম না৷ বিদ্যাসাগরের স্বপ্ন পূরণের কাজে যতটা পারি অংশ নিতে চাই৷’’
কোচবিহার ঠাকুর পঞ্চানন মহিলা মহাবিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের ছাত্রী চন্দনা ভুঁইমালীর মুখে হাসি, ‘‘আমি সেই শিলিগুড়ি থেকে টানা সাত দিন মিছিলে আছি৷ কোনও কষ্টকেই কষ্ট বলে মনে হয়নি৷’’ বাঁকুড়া ক্রিশ্চান কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের রাহুল শতপথী, সুদীপ পাইনরা দেশজুড়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন সিলেবাস দেখে নীরব থাকতে পারেননি, বিদ্যাসাগরের স্বপ্ন পূরণের কথা ভেবেছেন৷ হলদিয়া সিআইপিইটি–র ছাত্র জিৎ চট্টরাজের জোর ‘মানুষ হওয়ায়’৷ আধুনিক মানুষ– বিদ্যাসাগর যেমন মানুষ চেয়েছিলেন তেমন৷ দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার রায়দিঘি কলেজে বাংলা বিভাগের ছাত্রী রিয়া হালদারের সংযোজন, ‘‘শুধু মানুষ হওয়া নয়, মনুষ্যত্ব রক্ষারও অঙ্গীকার৷’’
বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের ছাত্র রাজেন্দ্র মণ্ডলের স্পষ্ট উচ্চারণ, ‘বিদ্যাসাগর ধর্মনিরপেক্ষ জীবনধারাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন৷ কিন্তু আজ দেশে ধর্ম–বর্ণ–জাতপাতে নামে মানুষকে আলাদা করার ষড়যন্ত্র চলছে৷ এর বিরুদ্ধেও আমাদের লড়াই৷’’ দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র সায়ন হালদার চায় প্রথম শ্রেণি থেকেই পাশ–ফেল৷ নিয়েছে লড়াইয়ের অঙ্গীকার৷ রানাঘাট কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র সুরজিৎ সরকার শিলিগুড়ি থেকে কৃষ্ণনগর পর্যন্ত পাঁচ দিন টানা মিছিলে হেঁটেছে৷ চেয়েছে বিদ্যাসাগরের ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার আদর্শে এনআরসি–সিএএ বিরোধী সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে৷
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংসৃক্ত বিভাগের সুস্মিতা জোয়ারদারের অঙ্গীকার– ‘বিদ্যাসাগর নারীর অবমাননার বিরুদ্ধে আজীবন লড়েছেন৷ কত অপবাদ, নিন্দা সহ্য করেছেন৷ তাঁর মূর্তির নিচে দাঁড়িয়ে আমরা অঙ্গীকার করছি, নারী নির্যাতন চলতে দেব না৷’ সুস্মিতার পাশে তখন বাঁকুড়ার প্যারা–মেডিক্যাল ছাত্রী নিবেদিতা রায়৷ ওরা কেউ একা নয়৷ কলকাতার সেন্ট পলস স্কুলের দশম শ্রেণির বর্ষণ দাশগুপ্ত, সৌগত গায়েনরা এসেছে৷ সিএমও, মহম্মদ জান, এমএল জুবিলি সহ বহু উর্দুমাধ্যম স্কুলের ছাত্ররা এসেছে৷ তারা শিক্ষা আন্দোলনের পাশাপাশি জানছে বিদ্যাসাগরকে৷ সোনারপুরে বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র অনিমেষ সাঁই এত ছাত্র–ছাত্রীর সান্নিধ্যে শক্তি পায় আগামী দিনের পথ চলার৷ মুরলীধর গার্লস কলেজের সিমরন নিশার বলে ওঠেন ‘‘আমাদের এত বন্ধু আছে আগে জানতাম না৷’’
পশ্চিম মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিপুল জানা সাত দিনই মিছিলে ছিল৷ দেখেছে মায়েরা কীভাবে মেয়েদের নিয়ে এসেছেন মিছিলে৷ তার অনুভূতি ‘দলে দলে মানুষ আমাদের অভিনন্দন জানিয়েছে, জীবনে কোনও দিন ভুলব না৷ বুঝলাম লড়াইয়েই প্রকৃত আনন্দ৷ তাই, লড়াই ছাড়ব না৷’ কেন এই ‘অঙ্গীকার যাত্রা’, কীসের বিরুদ্ধে লড়াই, কোন আদর্শের ভিত্তিতে লড়াই সে কথা তুলে ধরলেন এআইডিএসও–র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক মণিশঙ্কর পট্টনায়ক৷ সমবেত সকলকে অভিনন্দন জানালেন সংগঠনের রাজ্য সভাপতি সামসুল আলম৷
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ডিএসও–র সর্বভারতীয় সভাপতি ডিএনআর শেখর, সাধারণ সম্পাদক সৌরভ ঘোষ৷ প্রধান অতিথি ছিলেন এসইউসিআই (কমিউনিস্ট)–এর সাধারণ সম্পাদক প্রভাস ঘোষ৷ তিনি বলেন, ‘‘তোমরা ছাত্রছাত্রীরাই সমাজের ভবিষ্যৎ৷ সত্যকে ভিত্তি করে উন্নত মনুষ্যত্ব অর্জনের মধ্য দিয়েই নতুন সমাজ তোমরা গড়ে তুলবে৷ তাই, অঙ্গীকার তোমাদের একদিনের নয়, আজীবন এই সত্যনিষ্ঠ পথে অবিচল থাক৷ হয়তো অনেক কষ্ট হবে, কিন্তু শেষপর্যন্ত জয় হবে তোমাদেরই৷’’
কমরেড প্রভাস ঘোষের আহ্বান তখনও অনুরণিত হচ্ছে উপস্থিত সকলের বুকে৷ উঠে দাঁড়ালেন ডিএসও রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যরা৷ সকলের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে তাঁরা পাঠ করলেন ‘অঙ্গীকার’৷ মনুষ্যত্বের পথে এগিয়ে যাবার অঙ্গীকার বুকে নিয়ে ঘরে ফিরে গেলেন ছাত্রছাত্রীরা৷