একদিকে যখন আর জি করের নৃশংস ঘটনার বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারের দাবিতে রাজ্য তথা দেশ জুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের আন্দোলন চলছে, সেদিকে কর্ণপাত না করে মুখ্যমন্ত্রী তখন ফিতে কেটে শারদ উৎসবে রাজ্যবাসীকে মেতে ওঠার আহ্বান করছেন। নির্যাতিতা অভয়া এবং প্রতিবাদে মুখর লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রতি একে বিদ্রুপ ছাড়া আর কি বলা যাবে? সেই আবহে রাজ্য প্রশাসনের চূড়ান্ত অবহেলা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় ঘটল এক ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা। ৭ অক্টোবর বীরভূমের খয়রাশোল ব্লকের গঙ্গারামচক খোলামুখ কয়লা খনি এলাকায় সকালে এই ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে সরকারি ঘোষণা মতে মৃত ৮ জন এবং আহত বেশ কয়েকজন। বেসরকারি মতে হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি। বিস্ফোরণের অভিঘাত এতটাই তীব্র ছিল যে কয়েকজন শ্রমিকের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, ডিএনএ টেস্ট ছাড়া যা শনাক্ত করা অসম্ভব। একটু দূরে কিছু শ্রমিক কিছুক্ষণের জন্য সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। যে গাড়িটিতে বিস্ফোরক ছিল তা দুমড়ে মুচড়ে যায়। আহত হয়ে যারা সিউড়ি সদর হাসপাতালে ভর্তি হন তার মধ্যে ছাড়া পেয়েছেন একজন শ্রমিক খাঁদু মারান্ডি, তিনি সম্পূর্ণ বধির হয়ে গেছেন। এখনও পর্যন্ত এই ভয়াবহ বিস্ফোরণের প্রকৃত কারণ অজানা।
গঙ্গারামচক খোলামুখ কয়লা খনি পিডিসিএল-এর লাইসেন্সপ্রাপ্ত এবং তারই পরিচালনাধীন। কিন্তু কয়লা উত্তোলন করার জন্য ‘গঙ্গারামচক মাইনিং প্রাইভেট লিমিটেড’ নামক একটি বেসরকারি কোম্পানিকে পিডিসিএল বরাত দিয়েছে। তারা ২০১৮ সাল থেকে এখানে কয়লা উত্তোলন করছে এবং বিপুল হারে মুনাফা করে চলেছে। বেসরকারি সংস্থাগুলির মুনাফার পাহাড় গড়ার জন্য সুকৌশলী পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। খয়রাশোল ব্লকের কাঁকরতলা থানা, লোকপুর থানার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে কয়লার ভাণ্ডার রয়েছে। আর একই কায়দায় সেই ভাণ্ডার লুট করছে নানা কোম্পানি। কেন্দ্র এবং রাজ্যের শাসক দল ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদতে সুদীর্ঘ বছর ধরে এখানে গড়ে উঠেছে একদল কয়লা মাফিয়া। এটা তাদেরই রাজত্ব। সিপিএম পরিচালিত বামফ্রন্ট সরকারের আমল থেকে এখনও পর্যন্ত একই ভাবে চলছে। কয়লার দখলদারি, এলাকার দখলদারি নিয়ে বোমাবাজি, খুন-সন্ত্রাস এখানে মানুষের নিত্যসঙ্গী। শ্রমিক সাধারণ মানুষের টুঁ শব্দ করার উপায় নেই।
গঙ্গারামচক খোলামুখ খনি তৈরি করার সময় থেকেই বাস্তবপুর আদিবাসী পাড়া, দেবগঞ্জ, কৃষ্ণপুর, ভাদুলিয়া প্রভৃতি গ্রামে বসবাসরত আদিবাসী ও গরিব মানুষেরা প্রতিবাদ আন্দোলন করেছিলেন। শাল, মহুয়া অন্যান্য গাছগাছালির পাতা এবং নানা বনজ সম্পদের উপর নির্ভর করে এই সহজ সরল আদিবাসী পরিবারগুলো দিনযাপন করত। তাই স্বাভাবিকভাবে বন ধ্বংস করে পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে তাদের ছিল প্রতিবাদ। কিন্তু প্রশাসন এবং ওইসব দুষ্কৃতীরা মানুষের প্রতিবাদকে আমল দেয়নি। তারা স্বপ্ন দেখিয়েছিল খনি হলে কাজ পাবে, রোজগার বাড়বে, তাদের জীবনে কতই না স্বাচ্ছন্দ্য আসবে! মিথ্যা প্রতিশ্রুতি আর জোর খাটিয়ে তারা এই খোলামুখ খনি চালু করে। মালিক দক্ষ শ্রমিক নিয়োগ না করে, অতি মুনাফার লোভে স্থানীয় শ্রমিকদের ট্রেনিং না দিয়েই বিপদের ঝুঁকির মধ্যে তাদের দিয়ে কয়লা উত্তোলন শুরু করে। অদক্ষ শ্রমিক দিয়ে গর্ত করে ডিটোনেটার এবং জিলোটিন স্টিক দিয়ে তারের সাহায্যে দূর থেকে নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ ঘটানো হয় নিয়মিত। বাড়িগুলিতে মাঝে মাঝেই ফাটল ধরে এবং ইতিপূর্বে কিছু কিছু দুর্ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু জঙ্গলে ঘেরা ওই সমস্ত এলাকায় বাইরের লোককে ঢুকতে না দিয়ে জোর করে তা চাপা দিয়েছে মালিকরা। প্রশাসনের কিছুই অজানা নয়। এখানে শ্রমিকদের সেফটি, সিকিউরিটি কিছু নেই। মাস্ক, সেফটি স্যু, হেলমেট, বার্ন প্রুফ কিটস (জামা কাপড়) কিছুই নেই। ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হাই পাওয়ার কমিটির ঘোষণা অনুযায়ী কয়লা খনি শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন যেখানে ৩৭০০০ টাকা, এখানে দেওয়া হয় ১৩৫০০-১৬০০০ টাকা। কোনওরকম শ্রমবিধি মানা হয় না। নেতা মন্ত্রী আর সরকারি অফিসাররা নানা অনুষ্ঠানে ঘটা করে শ্রমবিধি, শ্রমিক সুরক্ষার যে কথাগুলো বলেন তা যে কত হাস্যকর এই সমস্ত এলাকায় এলেই বোঝা যায়। বিস্ফোরণের পর পরই প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের ক্ষতিপূরণ বাবদ ৩২ লক্ষ টাকা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে এই টাকা তারা ধার্য করলেন? একজন কর্মরত শ্রমিক যা বেতন পাবেন তার বাকি কর্মজীবন এবং অন্যান্য বেনিফিটগুলি ধরেই তো তার হিসাব হবে। সে রাস্তায় তারা যাচ্ছেন না। সে ক্ষেত্রে একেকজন শ্রমিকের প্রাপ্য এক এক রকম হবে এবং তা নিশ্চয়ই ওই ৩২ লক্ষ টাকা মাত্র নয়।
এই ভয়ঙ্কর ঘটনার পর দিনই এসইউসিআই (সি)-র পক্ষ থেকে জেলা সদরে বিক্ষোভ মিছিল সংগঠিত হয়, জেলাশাসকের কাছে ডেপুটেশনে দলের নেতৃবৃন্দ এই দাবিগুলো উত্থাপন করেন। তাঁরা দাবি করেন, যাদের অবহেলা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় এই বীভৎস ঘটনা ঘটতে পারল উপযুক্ত তদন্ত করে সেই সব দোষীদের কঠোর শাস্তি, মৃতদের পরিবারকে ৫০ লক্ষ টাকা এবং একজনের সরকারি স্থায়ী চাকরি, আহতদের ২৫ লক্ষ করে টাকা, সুচিকিৎসা, শ্রমিক সুরক্ষা এবং ন্যূনতম মজুরি চালু করা সহ প্রাথমিকভাবে ৭ দফা দাবি জানানো হয়। দলের জেলা কমিটির পক্ষ থেকে একটি টিম পরদিন ৯ অক্টোবর বিস্ফোরণস্থল সহ এলাকা পরিদর্শন করে। তাঁরা গ্রামগুলিতে যান, দুর্ঘটনাগ্রস্ত পরিবারগুলিতে গিয়ে তাদের সমবেদনা জানান, পাশে থাকার বার্তা দেন। এ আই ইউ টি ইউ সি-র রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকেও প্রতিনিধিরা ওই এলাকাগুলিতে একাধিকবার গিয়েছেন। গ্রামবাসী এবং শ্রমিকদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। তাদের ক্ষতিপূরণ, ন্যায্য মজুরি ও সেফটি সিকিউরিটি চালু করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেন। এলাকায় ভয়-ভীতি, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এলাকার মানুষকে সংগঠিত করে আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে আমাদের দল ব্যাপৃত আছে।