বিহারে শেষ হল বিধানসভা নির্বাচন। কোভিড অতিমারির হানায় বিপর্যস্ত দেশে বিহারেই প্রথম ভোট হল। বেশ কিছুদিন ধরে যেন মহারণের দামামা বাজছিল। চতুর্থ বারের মুখ্যমন্ত্রীত্বের জন্য গরিবি, বেকারি, অশিক্ষা, চিকিৎসাহীনতায় আচ্ছন্ন বিহারের মানুষের সামনে প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিচ্ছিলেন নীতীশ কুমার। জোটসঙ্গী বিজেপিও পিছিয়ে ছিল না। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জনসভায় জনসভায় ভাষণে উগ্র হিন্দুত্ব আর উগ্র জাতীয়তাবাদের ফুলকি ছড়িয়েছেন। আবার তারই মধ্যে রাজ্যে নীতীশের জনপ্রিয়তায় ভাটার টান লক্ষ করে কৌশলী দূরত্ব বাড়িয়ে বিরোধী আরজেডির নতুন নায়ক তেজস্বী যাদবের বিরুদ্ধে বিজেপি সর্বশক্তি দিয়ে খাড়া করার চেষ্টা চালিয়েছে চিরাগ পাসওয়ানকে।
যথাসময়ে ভোটের ফল বেরোবে। কিন্তু সেই ফল যাই হোক রাজ্যের সাধারণ মানুষের জীবনের প্রধান সমস্যাগুলোর কি আদৌ কোনও সমাধান হবে? লালুপ্রসাদ যাদবের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগকে হাতিয়ার করে বিহারে ক্ষমতা দখল করেছিলেন নীতীশ কুমার। তাঁর ১৫ বছরের শাসনে কী পরিবর্তন এসেছে বিহারের জনসাধারণের জীবনে? খতিয়ে দেখলে ধরা পড়বে, ওপর ওপর কিছু চাকচিক্য ছাড়া রাজ্যের গরিব নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষের ঘরের অন্ধকার এতটুকুও কাটেনি নীতীশ সরকারের আমলে।
বিহারে ভোট-রাজনীতির কারবারিরা জাতপাতের বিভেদে উস্কানি দেওয়াটাকেই রাজনীতি বলে উপস্থিত করেন। তাঁরা এক-একজন এক-একটি জাতের স্বঘোষিত ত্রাতা সেজে বসে আছেন। নিজের ভোটব্যাঙ্ক জোরদার করতে তাঁরা অতি কদর্য বিভেদ শুধু নয়, সংঘাতের পথ নিতেও পিছপা হন না। দলিত ভোট নিয়ন্ত্রণ করত রামবিলাস পাসোয়ানের দল। সেই ভোট নিজের দখলে আনতে নীতীশ কুমার ওবিসির মধ্যে ইবিসি বলে আলাদা একটা শ্রেণি চালু করে দেন। তৈরি করেন মহাদলিত শ্রেণি। এই মহাদলিতদের মধ্যে আছে ২২টি উপ-জাত। লালুপ্রসাদের আরজেডির আমলে যাদবদের দাপট থেকে বাঁচতে মহাদলিতরা নীতীশের আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু গত ১৫ বছরে কতটা পরিবর্তন এসেছে তাঁদের জীবনে? বলতে গেলে সামান্যতমও নয়। এই মহাদলিতদের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা ‘ডোম’-দের ‘অস্পৃশ্য’ গ্রামগুলিতে ছোঁয়াছুঁয়ির ভয়ে এমনকি তা ভোটের প্রচার করতেও ঢোকেন না নেতারা। বহু স্কুলে, এমনকি সরকারি হলেও ঠাঁই পায় না ডোম-সন্তানরা। ঝুড়ি বুনে, বেচে ধুঁকে ধুঁকে দিন চলে তাঁদের। অতিমারি পরিস্থিতিতে তা-ও বন্ধ। ভরসা সরকারি রেশনটুকু। ধারদেনায় গলা পর্যন্ত ডুবে আছেন প্রান্তিক বর্গের এইসব অসংখ্য মানুষ। ভোটবাক্সের হিসাব কষতে বসার সময় ছাড়া এঁদের কথা কখনও মনে আসে না নেতাদের। জেএনইউ এবং আইআইটি-রুরকির সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা রিপোর্টে বেরিয়ে এসেছে, ‘বিহার মহাদলিত বিকাশ মিশন’ তৈরি করে যে সব প্রকল্প নীতীশ সরকার চালু করেছিল, সেগুলির সুফল দলিতদের কাছে পৌঁছয়নি। সমীক্ষায় দেখা গেছে, দলিত সমাজের বিরাট অংশ এখনও দারিদ্রসীমার নিচেই পড়ে রয়েছে, শিক্ষার সুযোগ নেই তাঁদের। প্রতি বছর প্রকল্পগুলির জন্য বরাদ্দ হয়েছে অন্তত ১১০ কোটি টাকা। প্রশ্ন উঠে গেছে– এই বিপুল টাকা তাহলে যাচ্ছে কোথায়? দুর্নীতি গ্রাস করেছে সরকারি প্রকল্পগুলিকে। নিজের ভোটব্যাঙ্ক বাঁচাতে মরিয়া হওয়া সত্তে্বও নীতীশকুমার এগুলি নিয়ে নীরবই থেকেছেন।
দেশের পরিযায়ী শ্রমিকদের একটা বড় অংশ বিহারের বাসিন্দা। লকডাউনে তাঁদের অবর্ণনীয় দুর্দশার কথা কারওরই অজানা নয়। দূর-দূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে নিজের রাজ্যে ফিরতে চেয়ে সীমান্তে আটকে থাকতে হয়েছে তাঁদের। রাজ্যে ঢোকার অনুমতি দেয়নি নীতীশ সরকার। পরিযায়ীদের এক হাজার টাকা করে দেওয়ার সরকারি প্রতিশ্রুতি ছিল। বেশিরভাগ শ্রমিকেরই তা জোটেনি। রেশনের নামে অত্যন্ত নিম্ন মানের চাল-গম দেওয়া হয়েছে। লকডাউন উঠে যাওয়ার পরে কাজ-হারানো লাচার পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য নীতীশ সরকার কাজের কোনও বন্দোবস্ত করার উদ্যোগ নেয়নি। কেন্দে্রর যে বিজেপি সরকারের আচমকা লকডাউন ঘোষণায় প্রাণ বিপন্ন হয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের, সেই বিজেপি-র সঙ্গে নীতীশকুমারের জোটে আস্থা রাখতে রাজি নন তাঁরা।
দেশের আর পাঁচটা রাজ্যের মতো বিহারও দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছে ভয়ঙ্কর বেকার সমস্যায়। অথচ গত পাঁচ বছরে সরকারি পদে কোনও কর্মসংস্থান হয়নি। বিরোধীদের দাবি, খালি রয়েছে চার থেকে পাঁচ লক্ষ সরকারি পদ। স্বাস্থ্য কিংবা শিক্ষা ব্যবস্থাও পড়ে রয়েছে অন্ধকারে। সর্বশেষ দফায় ফের সরকারে বসে নীতীশ কুমার যে সাত দফা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার অন্যতম ছিল ঘরে ঘরে পানীয় জল পৌঁছে দেওয়া। সেই প্রতিশ্রুতিও বাস্তবায়িত হয়নি। বড়রাস্তা বরাবর জলের লাইন গেলেও পানীয় জল পৌঁছয়নি গ্রামের ভিতরে। এ বছরের বন্যায় বিপুল ক্ষতি হয়েছে রাজ্যের। পরিবারপিছু ৬ হাজার টাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার। খাতায়-কলমে কয়েক কোটি টাকা খরচ হয়ে গেলেও বেশিরভাগে বন্যাদুর্গত মানুষই সাহায্যের মুখ দেখেননি। দুর্নীতির দুর্গন্ধে ভরে গিয়েছে বিহার।
আর এসব নিয়ে মানুষের ক্ষোভকে কাজে লাগাতে নেমেছে বিরোধী দলগুলি, যারা অতীতে ক্ষমতায় বসে প্রতারণা, দুর্নীতি আর লুঠ ছাড়া মানুষকে অন্য কিছু দেয়নি। ভোটপ্রার্থীদের একটা বড় অংশ কোটিপতি। এছাড়া আছেন ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, খুনের চেষ্টার মতো চরম অপরাধে অভিযুক্ত প্রার্থীরা। বিজেপি ভোট প্রচারে গিয়ে রামমন্দির নির্মাণ আর কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানোর অপচেষ্টা চালিয়েছে। পুলওয়ামা আর বালাকোটের নামে উগ্র জাতীয়তাবাদের ঢাক পিটিয়েছে। এই অবস্থায় মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলার কথা যে বাম দলগুলির, তারা ভোটের হিসাব কষতে ব্যস্ত। লড়াই আন্দোলন শিকেয় তুলে সিপিএম, সিপিআই, সিপিআই-এমএলের মতো ‘বাম’ নামধারী দলগুলি নীতীশকুমারের জেডিইউ-বিজেপি জোটের বিরুদ্ধে হাত মিলিয়েছে লালুপ্রসাদের আরজেডি আর কংগ্রেসের সঙ্গে। সকলেই ক্ষমতায় এলে লক্ষ লক্ষ চাকরি দেওয়া সহ প্রতিশ্রুতির পর প্রতিশ্রুতির প্রাসাদ বানিয়েছে শূন্যে। বিহারের ক্ষুধার্ত, নিরন্ন, কাজ-হারানো, বন্যায় সব-খোয়ানো মানুষকে প্রতারণায় ভুলিয়ে রেখে ক্ষমতার দাবার ছক সাজিয়েছে এইসব ভোটবাজ রাজনৈতিক দল।
এমনি করেই ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দলগুলির প্রতারণা আর লুঠের চক্রে পাক খেয়ে মরছে সাধারণ মানুষ। আজ এ কথা তাঁদের বোঝার সময় এসেছে যে, শুধু ভোট দিয়ে সরকার পাল্টে জীবনের অন্ধকার ঘোচানো যাবে না, বরং তা বাড়তেই থাকবে। ঘরে সামান্য আলো জ্বালতে হলেও তার জন্য গণআন্দোলনের জ্বালানি চাই। তাই জীবনের দাবিগুলি নিয়ে লাগাতার সংগঠিত আন্দোলন গড়ে তোলাই আজ একমাত্র পথ।