সদ্য সমাপ্ত বিহার বিধানসভা নির্বাচনে হারতে হারতে খুব সামান্য ব্যবধানে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট জয়ী হয়েছে।
কেমন সব জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হলেন? এই নির্বাচনে জয়ী ৬৮ শতাংশ বিধায়কই মারাত্মক অপরাধে অভিযুক্ত। তার মধ্যে আছে খুন, ধর্ষণের মতো অভিযোগ। বিজেপি, জেডিইউ, আরজেডি, কংগ্রেস, এমআইএম কেউই এ ব্যপারে কম যায়নি। কুখ্যাত মাফিয়া থেকে এলাকার বাহুবলী ডন, সব ধরনের দুষ্কৃতীই আছে এই তালিকায়। সিপিআইএমএল লিবারেশনের বিধায়কদের বিরুদ্ধেও মারাত্মক অপরাধের অভিযোগ আছে। দুষ্কৃতিরাজ এতটাই গভীর যে, যিনি শিক্ষামন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে এমন সব সমাজবিরোধী রেকর্ড আছে তা নিয়ে রাজ্যে হইচই পড়ে যায়। ফলে শপথ নেওয়ার তিনদিন পরেই তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়েছে।
বিহারের মতো গরিব অধ্যুষিত রাজ্যে নির্বাচিত বিধায়কদের ৮১ শতাংশই বহু কোটি টাকার মালিক। দলগুলি এদেরই বেশি সংখ্যায় দাঁড় করিয়েছিল। টাকা, বাহুবল এবং প্রশাসনিক পক্ষপাতিত্ব যে কীভাবে নির্বাচনকে প্রভাবিত করে বিহার নির্বাচন তার একটা জ্বলন্ত উদাহরণ। এই বিধায়করা যে আইন করবেন তা কেমন গরিবের ভাল করতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। বিজেপি-জেডিইউ সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ যে কতটা ক্ষোভে ফুটছে তা নির্বাচনের ফলেও বোঝা গেছে। বিজেপি জোট জিতেছে, কিন্তু তাদের অতিবড় সমর্থকও এই জয়কে জনগণের সমর্থন বলতে পারবেন না। কার্যত বিরোধীদের সাথে তাদের ভোট পার্থক্য নেই বললেই চলে। ভোট রাজনীতির কৌশলে তারা সরকারটা কোনও রকমে গড়তে পেরেছে এই মাত্র। একই সাথে ভাবা দরকার, এটাকেই যাঁরা বিজেপির বিরুদ্ধে জয় হিসাবে দেখাতে চাইছেন তাঁরাও বিকল্প কোন রাজনীতিটা মানুষকে দিলেন? আদৌ তাঁরা বিজেপির নীতি আদর্শের বিরুদ্ধে কোনও সঠিক রাজনীতি তুলে ধরতে পারলেন কি?
বিজেপি-জেডিইউ সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রবল ক্ষোভ
নির্বাচনের আগে বিজেপি-জেডিইউ সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ যেন ফেটে পড়তে চেয়েছে। এই সরকারের আমলে বেকারি, দারিদ্র, কৃষকের দুর্দশা মারাত্মক আকার নিয়েছে। বিগত ১০ বছরে রাজ্যে কোনও নতুন কলকারখানা তৈরি হয়নি বললেই চলে। রাজ্যের লক্ষ লক্ষ যুবক পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়াতে বাধ্য হন। বন্যা, খরা প্রতিরোধে কোনও ব্যবস্থা তো অনেক পরের কথা, এর প্রকোপ থেকে মানুষের কষ্ট কমানোর নূ্যনতম প্রচেষ্টা নেই সরকারের।
নীতীশ কুমার ২০০৫ সালে সরকারে বসে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ‘করাপশন’, ‘ক্রাইম’ এবং ‘কমিউনালিজম’-এর অবসান করবেন তিনি। কিন্তু বাস্তবে বিহারে করাপশন অর্থাৎ দুর্নীতি ক্রমাগত বেড়েছে। এমনকি মুখ্যমন্ত্রী সহ বিজেপি নেতা তথা উপমুখ্যমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীর নামও জড়িয়েছে ৮৮০ কোটি টাকার ‘সৃজন’ কেলেঙ্কারির সাথে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের ‘খাঁচার তোতা’ সিবিআই-এর দয়ায় তাঁরা বুক ফুলিয়ে ঘুরছেন। মুজফফরপুর ছাত্রী হোমের কেলেঙ্কারিতে জেডিইউ-বিজেপি দলের তাবড় নেতারা যুক্ত। ইন্দিরা আবাস যোজনা কিংবা বার্ধক্য ভাতার মতো সরকারি প্রকল্পের ন্যায্য টাকা পেতে গেলে দরিদ্র মানুষও সরকারি দাদাদের নজরানা না দিয়ে কিছুই পান না। খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি ইত্যাদি অপরাধ ভয়াবহ হারে বেড়েছে। জাতপাত ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ হানাহানি সারা দেশের মতো বিহারেও বেড়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিগত ৬ বছরে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের একের পর এক জনবিরোধী নীতির ধাক্কা। যার ফলে বিহারের মানুষের দুর্দশা আরও বেড়েছে। সম্প্রতি করোনা পরিস্থিতির মোকাবিলার নামে অপরিকল্পিত লকডাউন সারা দেশের মতোই বিহারের মানুষের দুর্দশা সীমাহীন বাড়িয়েছে। বিহারের পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার রাস্তা বন্ধ করে বিহার সরকার চরম নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছে। কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের কৃষি ও শ্রম সংস্কার দারিদ্র পীড়িত বিহারের জনগণের কাছে এক বিরাট ধাক্কা। এই সমস্ত কিছুর জন্যই বিহার নির্বাচনে সাধারণ মানুষের মধ্যে জেডিইউ-বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল ক্ষোভ ছিল।
‘মোদী ম্যাজিক‘!
মানুষের ক্ষোভ সত্ত্বেও বিজেপির এই জয় কি তাহলে মোদী ম্যাজিকে? বিহার ভোটের বাস্তব পরিসংখ্যান কি তাই বলছে? বাস্তব বলছে, ২১ খানা হেলিকপ্টার শত শত কোটি টাকা ঢেলেও বিজেপি একক ভাবে রাষ্ট্রীয় জনতা দলের চেয়ে ১টি কম আসন পেয়েছে। বরং তাদের হাত ধরে নীতীশ কুমারের দলের প্রায় ভরাডুবি হয়েছে। বিজেপির নিজের তথা এনডিএ-র ভোট প্রাপ্তির শতাংশও কমেছে। গত বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় এবার বিজেপির ভোট কমেছে ৫ শতাংশের বেশি। এনডিএ এবং তার বিরোধী মহাজোটের মোট প্রাপ্ত ভোটের পার্থক্য মাত্র ১২ হাজার ২৭০, শতাংশের হিসাবে ০.০৩ মাত্র। বহু আসনে ১০০ থেকে ৫০০ ভোটের ব্যবধানে জয়পরাজয় নির্ধারিত হয়েছে। এর জন্য প্রধানমন্ত্রী নিজে ছাড়াও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী সহ বিজেপির একঝাঁক শীর্ষ নেতাকে প্রায় বিহারে পড়ে থাকতে হয়েছে। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের পুরো মেশিনারিকে নিজেদের পক্ষে নামাতে প্রধানমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিজে হাত লাগাতে হয়েছে। মোদি ম্যাজিক তাহলে কোথায়?
তবে যে মোদি ম্যাজিক বলে একটা প্রচার চলছে, সেটা কোথায়? সেটা আছে, তবে মানুষের মনে নয়– আছে প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে ভোট মেশিনারি নিজের পক্ষে টানার কাজে, আছে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নামক বিষয়টিকে পুরো বিসর্জন দেওয়াতে পারার মুন্সিয়ানায়, আছে টাকার জোরে সমস্ত ধরনের প্রচারযন্ত্রকে কব্জা করায়। তিনি ম্যাজিক দেখিয়েছেন কোটি কোটি টাকা খরচ করে ফেসবুক ইত্যাদি সোস্যাল মিডিয়াতে ‘ফেক নিউজ’ ছড়ানোর কৌশলে। তাঁর ম্যাজিক থেকেছে মাসল পাওয়ার অর্থাৎ বাহুবলীদের এককাট্টা করে জনগণকে ত্রস্ত করে রাখায়। আর আছে একদিকে সরাসরি টাকা দিয়ে, নানা লোভ দেখিয়ে মদ দিয়ে ভোট কেনার ‘ম্যাজিক’। সর্বোপরি জাতপাত, সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করে ভোট দখলের ম্যাজিক। আর তার সাথে আছে প্রশাসনের সর্বস্তরে আরএসএসের লোক বসানোর কৌশল। এমন ম্যাজিকের বলেই প্রবল সরকার বিরোধী জনমতের ঠিক বিপরীত চিত্র দেখাল ভোট মেশিন। এবারের বিহার ভোটে রিটার্নিং অফিসারদের ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রেই ছিল শাসকদের পক্ষে। এমনকি হিলসা কেন্দে্র রিটার্নিং অফিসার আরজেডি প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণা করেও কিছুক্ষণ পরে ১২ ভোটে বিজেপি প্রার্থীকে জয়ী বলে দেন। পোস্টাল ব্যালট গণনা নিয়ে প্রায় সমস্ত কেন্দ্রেই অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
পাটনার ‘চন্দ্রগুপ্ত প্রবন্ধন সংস্থান’ ১১টি জেলার ২৫ আসন ধরে সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে ২০ শতাংশের বেশি ভোটার কোনও না কোনও প্রলোভনে পড়েই ভোট দিয়েছেন। এর মধ্যে আছে মদ থেকে শুরু করে টাকা, এমনকি দু’চারদিনের ভাল ভোজ। আর আছে কিছু সুযোগ-সুবিধার টোপ। দরিদ্র মানুষের অসহায়ত্ব এতটাই যে, এই সামান্য কিছু পেলেই তারা যেন বর্তে যায়। এই পরিস্থিতির সুবিধা নিয়েছে শাসক এনডিএ। কারণ এই মুহূর্তে করপোরেটদের আশীর্বাদের দৌলতে বিজেপির টাকার থলিটাই এখন সবচেয়ে মোটা। মানুষের দারিদ্র আর অসচেতনতার সুযোগ নেওয়ার ক্ষমতা তাই তাদেরই বেশি। ম্যাজিকের মানে যদি ধোঁকাবাজি হয়, তাহলে তা অবশ্যই ছিল।
জাতপাত-ধর্মই কি প্রধান ইস্যু!
যত নির্বাচন কাছে এসেছে সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি দলেরই ভোট প্রচারের প্রধান হাতিয়ার হয়েছে নানা জাতপাত ধর্মবর্ণ সংক্রান্ত বিভেদ। খোদ নরেন্দ্র মোদি একাধিকবার বিহারে গেছেন, কিন্তু না কর্মসংস্থানের কথা, না কৃষকদের কথা কিছুই উচ্চারণ করেননি। পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার কথা তো মুখে আনতেই তাঁর বারণ আছে মনে হয়! তিনি জানতেন দেশের মানুষের প্রকৃত সমস্যাগুলি যদি মানুষের মনে প্রধান ইস্যু হয়ে দেখা দেয়, তাহলে বিজেপি তথা তাদের আসল প্রভু পুঁজিপতি শ্রেণির মহা বিপদ। তাই নরেন্দ্র মোদীর প্রচারের মূল বিষয় ছিল মূলত রাম মন্দির নির্মাণ, হিন্দুত্ববাদী আস্ফালন। এরমধ্যেই সুকৌশলে তিনি আরজেডির শাসনকালে যাদবদের প্রাধান্যের ইঙ্গিত দিয়ে বিজেপির প্রধান ভোটব্যাঙ্ক উচ্চবর্ণের সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিয়েছেন। পাকিস্তানের সঙ্গে সুকৌশলে মুসলিম সমাজকে এক করে দেখানোর জঘন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তাঁর চীন-ভারত সীমান্ত বিরোধ নিয়ে উচ্চগ্রামের আস্ফালন শুনে মনে হতে পারে এটাই বোধহয় বিহারের প্রধান সমস্যা। এদিকে বিহারে যেহেতু তথাকথিত নিম্নবর্ণের ভোটের প্রশ্ন অনেকটাই বড, তাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বিহারে জনসভায় দাঁড়িয়ে নিজেকে তথাকিথত নিচু জাতের প্রতিনিধি হিসাবে তুলে ধরতে হয়েছে বারবার।
বিজেপি যখন দেখেছে মুসলিমদের বেশিরভাগ মহাজোটের পক্ষে গেলে তাদের সমূহ ক্ষতি, তারা মদত দিয়ে আসাদুদ্দিন ওয়াইসির দল এআইএমআইএম (অল ইন্ডিয়া মজলিস-এ ইত্তেহাদুল মুসলিমিন) কে বেশ কিছু সিটে খাড়া করে দিয়েছে। তারা মুসলিম ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক প্রচার যত করেছে তত বিজেপির সুবিধা হয়েছে হিন্দুত্ববাদী প্রচারকে তুঙ্গে তুলতে। ফলে একদিকে বিজেপি বিরোধী ভোট ভাগ হয়ে গেছে, অন্যদিকে বিজেপি হিন্দুত্ববাদের চাম্পিয়ান হয়ে ভোট কুড়োনোর কাজে খোলা মাঠ পেয়ে গেছে।
বিজেপির জোট সঙ্গী নীতীশ কুমারের জেডিইউ ২০১৫ সালে লালু প্রসাদ যাদবের দল আরজেডি-র সাথে জোট বেঁধে ‘পিছড়ে বর্গ’ অর্থাৎ পিছিয়ে পড়া জাত সমূহের প্রতিনিধি হয়ে উঠতে চেয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন বাদেই বিজেপি কেন্দ্রীয় ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে তাঁর ভোটব্যাঙ্কে ফাটল ধরাচ্ছে দেখে তিনি আবার বিজেপির হাত ধরে ফেলেন। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে নীতীশজি আবার ওবিসিদের মধ্যে অতি পিছড়ে বর্গ এক্সট্রিমলি ব্যাকওয়ার্ড কাস্ট (ইবিসি) ভাগ করে তাদের ত্রাতা বনবার চেষ্টা করতে থাকেন। জেডিইউ মূলত কুর্মি সমাজের ত্রাতা সেজে রাজনীতি করে। তাতে এই অংশের গরিব মানুষের কি কোনও উন্নতি হয়েছে? হওয়া কি সম্ভব? বিহারের ওবিসি, ইবিসিদের লক্ষ লক্ষ মানুষ রাজ্যে কোনও কাজ না পেয়ে পরিযায়ী শ্রমিকের দলে নাম লেখাতে বাধ্য হন। আরজেডি মূলত যাদব আর মুসলিমদের ত্রাতা সাজে। তাদের রাজত্বে এদের কী উন্নতি হয়েছে? বহুযুগ ধরে অত্যাচারিত, পদদলিত এই সব মানুষের যন্ত্রণা, দারিদ্রকে হাতিয়ার করে এইসব জাতপাত ভিত্তিক দলের নেতারা আখের গোছান। ৯০-এর দশক থেকে যে উদারিকরণ, বেসরকারিকরণের নীতি সরকারগুলি নিয়ে চলছে, এই দলগুলি কি তার বিরোধিতা কোনওদিন করেছে? নাকি যখনই নানা দলের সরকারে তারা কেন্দ্রীয় ক্ষমতার ভাগ পেয়েছে, এই নীতিগুলিই এগিয়ে নিয়ে গেছে। এ বিষয়ে জেডিইউ-আরজেডি-বিএসপি ইত্যাদি জাতপাত ভিত্তিক দলের কোনও পার্থক্য আছে? এদের নেতারা বিজেপি কিংবা কংগ্রেসের উচ্চবর্ণ ভিত্তিক ভোটব্যাঙ্কের দিকে আঙুল তুলে মনুবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন। আর ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সুযোগ পেলেই সেই বিজেপি কিংবা কংগ্রেসের সাথেই হাত মেলান। নীতিশ কুমার বিজেপির সাথে আছেন, লালুপ্রসাদ যাদব জুড়েছেন কংগ্রেসের সাথে। দলিত নেত্রী বলে খ্যাত মায়াবতী বিজেপির সাথে মিলে উত্তরপ্রদেশে সরকার চালিয়েছেন, এখন সিবিআই-এর হাত থেকে বাঁচতে আবার বিজেপির গা ঘেঁষে চলছেন? দরিদ্র, নিপীড়িত মানুষের সমস্যা যে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক, সেটাই এরা ভুলিয়ে দিতে চায়। ভোট রাজনীতির স্বার্থে এই জাতপাতের ভাগ গরিব খেটে খাওয়া মানুষের চরম ক্ষতি করছে।
কিছু ভোট বেশি পেলেই বামপন্থার শক্তি বাড়ে না
বিহারে সিপিআই (এমএল) লিবারেশন ১২টি এবং সিপিএম ও সিপিআই ২টি করে আসন পাওয়ার পর এ নিয়ে বেশ অলোচনা হচ্ছে। বুর্জোয়া সংবাদমাধ্যমও এই নেতাদের সাক্ষাৎকার ফলাও করে ছাপছে। তাঁদের সাফল্য এসেছে ভাল। কিন্তু এই প্রসঙ্গে বামপন্থী কর্মী সমর্থকদের কিছু বিষয় ভেবে দেখতে বলব। বিজেপি বিরোধী হিসাবে যে দলগুলিকে তুলে ধরে তাঁরা জোট করলেন, তাদের চরিত্র কী? ২০১৪ থেকে বিজেপি যে কুশাসন চালিয়ে আসছে, তার বিরুদ্ধে এই সমস্ত বুর্জোয়া পেটিবুর্জোয়া দলগুলি কোনও ভূমিকা পালন করেছে, আন্দোলন গড়ে তুলেছে? ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে হারের পর থেকে কংগ্রেসকে তো দেখাই যাচ্ছে না। ২০১৫ সালে নীতীশ কুমার ছিলেন প্রবল বিজেপি বিরোধী, আজ তিনি বিজেপির শরিক। কাল যদি তিনি আবার তেজস্বী যাদবদের হাত ধরেন, তিনি প্রবল প্রগতিশীল হয়ে যাবেন? এ ভাবে যারা বিজেপির মতো একটা ফ্যাসিস্ট শক্তির মোকাবিলার কথা ভাবে তারা ভোট রাজনীতির খোয়াবেই মশগুল। আরজেডি-র তেজস্বী যাদব, কংগ্রেস ইত্যাদি শক্তির সাথে সিপিআই-সিপিএম-লিবারেশন ইত্যাদিরা যখন ‘মহাগোঠ বন্ধন’ গড়ে তুলেছেন, তার উদ্দেশ্যের মধ্যে বিজেপির নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের কোনও কর্মসূচি আদৌ ছিল না। তাঁরা জাতপাত ভিত্তিক ভোট সমীকরণকেই পাখির চোখ করেছিলেন! এর দ্বারা আর যাই হোক বিজেপির মতো উগ্র দক্ষিণপন্থার শক্তিকে জনমানস থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। বামপন্থাও শক্তিশালী হয় না। ফলে কিছু আসনে বামপন্থী দলগুলির জয়কেই যদি কেউ বামপন্থার জয় বলে মনে করেন তাহলে আবার মারাত্মক ভুল করা হবে।
বিহারের মানুষের জীবনের গভীর সমস্যা নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা কি এই সব বামপন্থী দল করেছে? নির্বাচনকে সামনে রেখে কিছু মিটিং মিছিল করে লোকের ক্ষোভ জাগানো নয়, জনগণকে জড়িত করে গণকমিটি গড়ে তুলে দীর্ঘস্থায়ী গণআন্দোলনের কোনও উদ্যোগ তাঁরা নেননি। পরিযায়ী শ্রমিকদের যখন বিহার সরকার আটকেছে, তার বিরুদ্ধে কিছু বিবৃতি ছাড়া কোনও আন্দোলন তাঁরা করেননি। এস ইউ সি আই (সি) বামপন্থী দলগুলির কাছে বিহার সহ সারা দেশ জুড়ে যুক্ত আন্দোলনের প্রস্তাব দিয়েছিল। এই দলগুলির নেতারা কেউ কর্ণপাত করেননি। ফলে এস ইউ সি আই (সি)-কে কার্যত একাই আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়।
আরজেডি-কংগ্রেস ইত্যাদিরা ভোটের সময় করপোরেট একচেটিয়া মালিকদের বিরুদ্ধে যখন কিছু গরম স্লোগানও দেয়, তা কি আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য? নাকি মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য? একচেটিয়া মালিকদের বিশ্বস্ত দল হিসাবে কংগ্রেসই প্রথম ভারতে ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করার চেষ্টা করেছে। চিন্তা জগতে ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতি তারাই আনতে চেয়েছে। এই কংগ্রেসকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধ-শক্তি হিসাবে তুলে ধরতে পারে কোনও বামপন্থী দল? বামপন্থী রাজনীতির মধ্যে তো বামপন্থা থাকবে, ভোট জোগাড়ে যেখানে যাতে সুবিধা তা করলেই বামপন্থার শক্তি বাড়বে? নির্বাচনী সুবিধার নানা খেলার মধ্যেই ঘুরপাক খাবে বামপন্থী রাজনীতি?
সিপিএম সিপিআই সংসদীয় রাজনীতিটাকেই তাদের রাজনীতির একমাত্র লক্ষ্য করে নিয়েছে। ফলে তার জন্য যেখানে যেমন সুবিধা সে পথে হাঁটার লাইনই তাঁরা নিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছর ধরে সরকারি ক্ষমতায় থাকার পর আজ দলে দলে সিপিএম কর্মী সমর্থকরা বিজেপিতে লাইন দিচ্ছেন। কেমন বামপন্থা শিখিয়েছেন তাঁরা! কংগ্রেস-বিজেপি একচেটিয়া পুঁজির এই দুই প্রধান সেবাদাস দলের বিরুদ্ধেই এস ইউ সি আই (সি) ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনের লাইন তুলে ধরছে। তাই সিপিএম-সিপিআই নেতৃত্ব এই দলকে এড়িয়ে চলছেন।
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন নকশালপন্থী রাজনীতির ধারায় চলে। যে ধারা একসময় পার্লামেন্টকে শুয়োরের খোঁয়াড় বলে নির্বাচনই বয়কট করে বসেছিল। বুর্জোয়া সংসদীয় নির্বাচন সম্বন্ধে লেনিনীয় নীতির শিক্ষাকে তারা তখন গুরুত্বই দেয়নি। এখন আবার সংসদীয় নির্বাচনে অংশ নিতে গিয়ে তাঁরা সংসদীয় রাজনীতির পাঁকেই ফেঁসে যাচ্ছেন। তাঁরা বিহারের তথাকথিত নিম্ন বর্ণের মানুষ, দলিত ইত্যাদি অংশের দরিদ্র মানুষের অপরিসীম দুর্দশাকে কেন্দ্র করে থাকা প্রবল বিক্ষোভকে সামনে রেখে কিছু লোক জড়ো করতে পেরেছেন। কিন্তু শত্রু-মিত্রের প্রশ্নটা জাতপাতেই আটকে গেছে। এই নিয়ে কিছু লড়াইও হয়েছে। কিন্তু মূল শত্রু পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং তার রক্ষক রাজনীতির বিরুদ্ধে মানুষের সচেতনতা গড়ে তোলার কঠোর কঠিন সংগ্রামটা এড়িয়ে গিয়ে গরম গরম কিছু স্লোগান দিলেই যে দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়ার শক্তিকে হারানো যায় না, সেই সত্যটা আবার প্রমাণিত হয়েছে। ‘কাস্ট ইজ ক্লাস’ অর্থাৎ জাতভিত্তিক লড়াইটাই শ্রেণি সংগ্রাম, এই ভ্রান্ত তত্ত্ব দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষের ঐক্যকে দুর্বলই করেছে। ‘বিজেপি মূল শত্রু’ এই কথাটা তাঁরা এখন বলছেন। কিন্তু তার অর্থ যদি অন্যত্র বিজেপি বিরোধী ভোটের জন্য নতুন কোনও বোঝাপড়া হয়, তা কি বিজেপির রাজনীতিকে মোকাবিলা করার শক্তি জোগাবে? এই সূত্রে তাঁরা পশ্চিমবঙ্গ বা অন্য কোথাও আরও কিছু আসনের বন্দোবস্ত হয়ত করতেও পারেন, তাতে বামপন্থী আন্দোলনের কোনও লাভ নেই। ঐক্য হবে আন্দোলনের জমিতে দাঁড়িয়ে। গণআন্দোলনকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ঐক্য না হলে সে ঐক্য ভোটে যাই ফল দিক, জনগণের কোনও উপকার হয় না।
আজকের পুঁজিবাদী গণতন্তে্রর এই সার্বিক অবক্ষয়ের দিনে কোনও বামপন্থী কমিউনিস্ট দল নির্বাচনী লড়াইকে কোন দৃষ্টিতে দেখে তা মহান নেতা লেনিনের শিক্ষার ভিত্তিতে ভারতের মাটিতে দেখিয়েছিলেন মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক শিবদাস ঘোষ। তিনি দেখিয়েছেন, কোনও যথার্থ সাম্যবাদী দল যখন এই বুর্জোয়া ব্যবস্থার মধ্যে নির্বাচনে লড়ে, তারা এই ব্যবস্থার প্রতি মোহ তৈরি করার জন্য চেষ্টা করে না। বরং গণআন্দোলন বিপ্লবী আন্দোলনকে শক্তিশালী করা এবং জনগণের মধ্য থেকে এই নির্বাচনের প্রতি মিথ্যা মোহ কাটানোটাই থাকে তার লক্ষ্য। এমনকি যদি তারা সরকারেও চলে যায় সরকারি ক্ষমতার প্রতি মোহ তৈরি নয়, তার সুযোগ নিয়ে আন্দোলনকে শক্তিশালী করাই তাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।
বিহার নির্বাচনের শিক্ষা দেখিয়ে গেল বামপন্থা-রহিত ভোট-রাজনীতি প্রগতির শক্তিকে বাড়ায় না। বরং তাকে আরও দুর্বল করে। যে দুর্বলতার সুযোগ বিহারে নিয়েছে বিজেপি। এ শিক্ষা ভুলে গেলে সর্বনাশ।