বিহারে বিজেপির সঙ্গে জোট ভেঙে বেরিয়ে এসে আরজেডি এবং কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করলেন জেডিইউ নেতা নীতীশকুমার। ফলে আপাতত বিজেপিকে রাজ্যের সরকার থেকে সরানো গেল। নীতীশ কুমারের এই চালকে কেউ কেউ মাস্টার স্টে্রাক বলছেন। হ্যাঁ, জোট রাজনীতি তথা ভোট রাজনীতির জন্য হয়ত তাঁর এই চাল মাস্টারস্ট্রোক। এই জোট বদলের দ্বারা নীতিশ কুমারের মুখ্যমন্ত্রীর গদি বাঁচল। তিনি অষ্টম বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর পদে শপথ নিলেন। কিন্তু তাতে রাজনীতিতে নীতি বাঁচল কি? বিহারের সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত, নিপীড়িত মানুষের কোনও লাভ হল কি?
নীতীশ কুমার বলেছেন, বিজেপি মহারাষ্টে্রর কায়দায় তাঁর দল ভাঙার চেষ্টা করছিল। হয়ত তাই-ই। নীতীশ কুমার কখনও নীতির রাজনীতি করেননি। সুবিধামতো কখনও আরজেডির সাথে আবার কখনও বিজেপির সাথে জোটে গিয়েছেন। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর দলের জনপ্রতিনিধিরাও যে বিজেপির টাকায় বা মন্ত্রীত্বের লোভে বিজেপির কাছে বিক্রি হয়ে যেতে পারেন, তাঁর এমন আশঙ্কা অস্বাভাবিক নয়। আর তা থেকেই তাঁর এই পদক্ষেপ। স্বাভাবিক ভাবেই নীতীশের এই চালে আদৌ কোনও নীতি আদর্শ কিংবা জনসাধারণের প্রতি দায়বদ্ধতার চিহ্নমাত্র কোথাও নেই। কোথাও নেই বিজেপির নীতিগত বিরোধিতা।
নীতীশের রাজনৈতিক ইতিহাস বারবার দলবদলের ইতিহাস। গত পাঁচ বছরে দু’বার জোট বদল করেছেন তিনি। ২০১৭-য় আরজেডির সঙ্গে জোট ভাঙার জন্য তেজস্বীর দুর্নীতিকে দায়ী করেছিলেন নীতিশ। আরজেডি নেতা তেজস্বী তো আজও দুর্নীতির অভিযোগ থেকে মুক্ত নন। তা হলে কোন নীতির ভিত্তিতে আবার তাঁর সাথে এই জোট গড়লেন তিনি?
লিবারেশন, সিপিএম প্রভৃতি দলগুলি নীতীশের এই জোটবদলকে বিজেপির অশ্বমেধের ঘোড়া আটকে দেওয়া বলে মত প্রকাশ করে নয়া জোটের সরকারকে সমর্থন জানিয়েছে। কিন্তু নীতীশ কুমারের এই নতুন জোটের মধ্যে নীতির কোন পরাকাষ্ঠা দেখলেন তাঁরা? নতুন জোটের কোন নীতির আকর্ষণে লিবারেশন-সিপিএম এই জোট-সরকারকে সমর্থন করলেন? আরজেডির রাজনীতি জাতপাত নিয়ে। নীতীশের রাজনীতি নীতিহীন। তা হলে এই জোট বিজেপির মতো একটি ধুরন্ধর দক্ষিণপন্থী দলকে আপাতত গদির লড়াইতে হারালেও আদর্শগত ভাবে তাকে রুখে দেবে, এই আশা তাঁরা কীসের ভিত্তিতে করছেন?
বিহারে দীর্ঘদিন ধরেই হয় আরজেডি না হয় নীতীশ-বিজেপি জোট সরকার চালিয়েছে। উভয়েরই নীতি এবং কার্যক্রম বিহারবাসীর কাছে স্পষ্ট। বিহারের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বাস করেন। শিক্ষা-চিকিৎসা সহ সমস্ত মূল পরিষেবাগুলিতে জাতীয় সূচকের একেবারে নিচের দিকে বিহারের স্থান। বেকারি দারিদ্র কৃষকদের দুর্দশা মারাত্মক আকার নিয়েছে। দুর্নীতি সমাজের গভীর তল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। কাগজে-কলমে মদ নিষিদ্ধ হলেও বিষমদে মৃত্যুর ঘটনা প্রায়শই সংবাদমাধ্যমের অন্যতম খবর হয়ে যায়। ছাত্রীরা সাইকেল পেলেও স্কুলগুলির পরিকাঠামো বলে কিছু অবশিষ্ট নেই। শিক্ষার মানচিত্রে বিহারের স্থান একেবারে নিচের দিকে। নীতীশ-আরজেডির নতুন জোটের সাথে বিজেপি-নীতীশ পুরনো জোটের নীতিগত কোনও ফারাক নেই। তা হলে এই জোটের সরকারের থেকে মানুষের নতুন কী আশা করার থাকতে পারে? প্রতি বারই আলাদা আলাদা একটা জোট হয়েছে, সরকার হয়েছে, প্রত্যেকটি সরকার চূড়ান্ত পুঁজিবাদী নীতি নিয়ে সবকার চালিয়েছে। জনস্বার্থের বিষয়টা পিছনে চলে গেছে। এ বারও লিবারেশন-সিপিএমরা যে এই জোট সরকারকে সমর্থন দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন, তা কোনও নীতির ঘোষণা ছাড়াই। কিন্তু কেন তাঁরা এমন একটি জোট সরকারকে সমর্থন করলেন? আসলে এদের সবার লক্ষ্য ‘২৪-এর লোকসভা নির্বাচন। জোটে থেকে যদি দু-একটি এমপি সিট বাগানো যায়! এখানেও নীতির কোনও ব্যাপার নেই। একেবারেই বুর্জোয়া ভোট রাজনীতি।
বিজেপির সাম্প্রদায়িক তথা ফ্যাসিস্ট রাজনীতিকে পরাস্ত করা শুধুমাত্র তাকে রাজ্যের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে হতে পারে কি? তার জন্য তো প্রয়োজন আদর্শগত ভাবে তাকে পরাস্ত করা। মনে রাখা দরকার, ভোটে বিজেপির বিরোধিতা করা মানেই সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা বা ধর্মনিরপেক্ষতা নয়। ভোটের স্বার্থে যে-কোনও দলই, এমনকি আর একটি সাম্প্রদায়িক দলও বিজেপির বিরোধিতা করতে পারে। কংগ্রেস কি ধর্মনিরপেক্ষ? কংগ্রেসের বিজেপি বিরোধিতা কি বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতা? একেবারেই নয়। তবে সেই কাজটি কি তার সদ্য-অতীত জোটসঙ্গী নীতীশের দ্বারা কিংবা জাতপাতের রাজনীতির কারবারি আরজেডির দ্বারা সম্ভব? শুধু বিজেপিই নয়, আরজেডি কিংবা জেডিইউ যে দল থেকেই হোক, বুর্জোয়া রাজনীতিতে আজ যাঁরা জনপ্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচিত হচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই কোনও নীতি-আদর্শের বালাই নেই। ক্ষমতা এবং প্রচারের আলোয় থাকার জন্য কোনও নীতিহীন আচরণেই তাঁরা পিছু-পা নন। ফলে এমন একটি জোটের ক্ষমতায় বসার দ্বারা বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির রথকে আটকে দেওয়া গেল কী করে বলা যাবে!
বর্তমান পরিস্থিতিতে এই সুবিধাবাদী বুর্জোয়া তথা ভোট রাজনীতিকে কিছুটা হলেও রুখতে দরকার বিকল্প বামপন্থী আদর্শ এবং রাজনীতি। বিকল্প হিসাবে দরকার এই জাতপাত সাম্প্রদায়িকতা দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটা প্রবল আদর্শগত সংগ্রাম। দরকার জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলিকে নিয়ে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলা। দরকার বামপন্থীদের লাগাতার নিজস্ব কর্মসূচি। তবেই মানুষের কাছে বুর্জোয়া ভোট রাজনীতির বিকল্প উপস্থিত করা যাবে। সিপিএম-লিবারেশন কি বিহারে সেই রাজনীতির চর্চা করছে? তাদের চর্চিত রাজনীতিতে বিহারের মানুষ সেই রাজনীতির হদিশ পাননি। অথচ বুর্জোয়া রাজনীতির চুরি-দুর্নীতি, সরকারি সম্পত্তির অবাধ লুঠপাটের বিকল্প লাগাতার আন্দোলনের কর্মসূচি ছাড়াই এই সব বামেরা নতুন জোট সরকারের কাছে ‘অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি’ চাইছেন এবং তা তারা বাস্তবায়িত করাবেন, এমন আকাশকুসুমের কথা হাওয়ায় ছেড়ে দিচ্ছেন। যারা এক সময় লেনিন থেকে প্রসঙ্গহীন ভাবে বিচ্ছিন্ন কিছু উদ্ধৃতি দিয়ে পার্লামেন্টকে শুয়োরের খোঁয়াড় আখ্যা দিয়ে নির্বাচন বয়কট করার কথা বলেছিল, তারাই আজ আপাদমস্তক বুর্জোয়া ভোট এবং জোট রাজনীতির পাঁকে পাক খাচ্ছে।
সিপিএম-সিপিআইয়ের মতো বামপন্থী নামধারী দলগুলিও আজকের পচা দুর্গন্ধময় ভোট রাজনীতিতে পার্লামেন্ট-বিধানসভাগুলিতে কিছু সিট পাওয়ার উদগ্র বাসনায় নির্বিচারে বুর্জোয়া, জাতপাতবাদী দলগুলির সঙ্গে জোট করছে, তাদের জোট সরকারকে সমর্থন করছে। বামপন্থার যে স্বীকৃত রাজনীতি–শ্রেণিসংগ্রাম এবং গণসংগ্রামগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, শক্তিশালী করা, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে তারা এখন এমএলএ-এমপি-র সংখ্যার নিরীখে নিজেদের অগ্রগতি প্রমাণে ব্যস্ত। এর সঙ্গে বামপন্থার কোনও সম্পর্ক নেই, লেনিনবাদের তো নেই-ই। সেই জন্যেই পশ্চিমবঙ্গে ভোটে একবার হারার পরেই একদা মহাপরাক্রমী সিপিএম নেতারা সোসাল মিডিয়ায় আস্ফালন ছাড়া জনগণকে সংগঠিত করে আন্দোলনের কথা ভাবতেই পারেন না।
বুর্জোয়াদের নিজস্ব নীতিতে চলা কোনও সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন করে বামেরা তাদের নীতিকে কখনও প্রভাবিত করতে পেরেছে? কেন্দ্রে প্রথম ইউপিএ সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন করেছিল সিপিএম এবং তার সহযোগী দলগুলি। অনেকেরই স্মরণে আছে, এ রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ব্রিগেডের এক সভায় বলেছিলেন, তাঁরা বসতে বললে ইউপিএ সরকার বসবে, উঠতে বললে উঠবে। দেশের মানুষের অভিজ্ঞতা, বাস্তবটা ছিল ঠিক তার বিপরীত। তাদের সমর্থন ইউপিএ সরকারের একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থরক্ষাকারী নীতি গ্রহণে, পদক্ষেপে কোনও ব্যাঘাত ঘটাতে যেমন পারেনি, তেমনই দুর্নীতিতেও লাগাম পরাতে পারেনি। অবশ্য শ্রমিক শ্রেণির শ্রেণি সংগ্রামকে শক্তিশালী করার লক্ষ্য ছাড়াই সিপিএম নেতৃত্বাধীন বাংলা কেরালা ত্রিপুরা– প্রতিটি সরকারই জনগণের স্বার্থ রক্ষার নামে শেষ পর্যন্ত দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থই রক্ষা করেছে। বিহারেও এর কোনও অন্যথা হওয়ার কারণ নেই।
বামপন্থা বর্জিত জোট রাজনীতি তথা ভোট রাজনীতি শোষিত মানুষের মুক্তি আন্দোলনের শক্তিকে বাড়ায় না, বরং তাকে আরও দুর্বল করে। এই দুর্বলতার পথ বেয়েই বিহারে সাম্প্রদায়িকতাবাদী বিজেপি জায়গা করে নিয়েছে। এই অবস্থায় বিজেপিকে শায়েস্তা করা গেল বলে নতুন জোটের পক্ষে যতই গলা ফাটানো হোক, বাস্তবে এর দ্বারা বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে পরাস্ত করা যাবে না। সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে চাই বামমনস্ক সমস্ত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে গণআন্দোলনের জোয়ার। ভোট রাজনীতির সুবিধাবাদ ছেড়ে লিবারেশন-সিপিএমরা সেই রাস্তায় হাঁটবেন কি?