‘‘ আমি প্রতি মুহূর্তে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে বোঝাব It is not an imaginary story বা আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসিনি’’– ‘সহজপাঠের গপ্পো’ দেখতে বসে মনে পডছিল ঋত্বিক কুমার ঘটকের এই প্রত্যয়ী উচ্চারণ৷ হাতে গোনা কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে আমাদের বাংলা ছবিতে বিগত বেশ কিছু বছর ধরে উচ্চবিত্ত সমাজের সাজানো ড্রইংরুমের চকচকে দৃশ্যের জন্ম হয়৷ বাজারচলতি ভাল থাকা এবং ভাললাগার বোধ বা সংজ্ঞার সাথে মিলিয়েই নির্মাণ করা হয় এসব আরামদায়ক বিনোদনের উপকরণ, যেগুলো আমাদের ভুলেও কোনও চিন্তা বা অস্বস্তির সামনে দাঁড করায় না৷ স্রোতে গা ভাসানো জীবন ও যাপনের বোধ কোনও গভীর প্রশ্নের সম্মুখীন হয় না৷
আনকোরা নতুন পরিচালক মানসমুকুল পাল আমাদের নিয়ে গেলেন এক সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতে, খিদে যেখানে প্রতি মুহূর্তে কামড় বসায় ছোটু আর গোপালের কচি পেট দুটোয়৷ ভ্যান দুর্ঘটনায় আহত বাবা ছেঁড়া চটের বিছানায় শুয়ে কাতরায়, অমানুষিক খাটনি আর দুশ্চিন্তায় ক্লিষ্ট মা ভাত চাইতে গেলে বকে, কোনও ভাবে দুটো পয়সা জোগাড়ের জন্য আট–দশ বছরের দুই ভাই এর ওর বাড়ি উঠোন পরিষ্কার করে, কুয়োর গায়ে জমা শ্যাওলা ঘষে, জলকাদা ভেঙে তাল কুডিয়ে হাটে বেচে৷ পড়শির বাড়ির পান্তা আর বাসি আলুচচ্চডি অমৃতের মতো লাগে সারাদিনের উপোসি মুখে৷ সাপখোপে ভরা জলাজমি থেকে কুড়িয়ে আনা কলমিশাক সেদ্ধ আর মুড়িই পাতে পড়ে রোজ, গরম ভাতের গন্ধ মেলে ক্বচিৎ কদাচিৎ৷ গ্রামের প্রান্তে বর্ধিষ্ণু জমিদার পরিবারে তালনবমীর পার্বণের খবর পেয়ে দুই ভাই ছুট লাগায়৷ তাল বিক্রি হবে, পেটপুরে দুটো খাওয়াও জুটবে নিশ্চয়৷ কিন্তু তাল বেচে পয়সা নিলে কি আর নেমন্তন্ন পাবে? দাদার ওপর ভরসা করতে না পেরে নিজেই ভোরবেলা বৃষ্টিতে ভিজে তাল কুড়িয়ে এক্কেবারে বিনা পয়সায় দিয়ে আসে ছোটু৷ নেমন্তন্ন পাওয়ার ব্যাকুল অপেক্ষায় রাত কাটে, মায়ের ডাকে সকাল হয়৷ ছোটুর স্বপ্নে দেখা পোলাও–মিষ্টি–তালপিটুলির দিকে রওনা হয় সম্পন্ন বাড়ির ছেলেমেয়ে–বুড়োর দল– তার চোখের সামনে দিয়েই৷ রাগে, অভিমানে চোখ ফেটে আসা জল ঝরে পড়ে ভাত আর শাকসেদ্ধর থালায়৷ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিন পাতার ছোটগল্প তালনবমীর মূল কাহিনীর প্রতি সম্পূর্ণ সৎ থেকেই মানসমুকুল ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছেন ছবিতে৷ এ ছবি শুধু হতদরিদ্র দুটি ছোট্ট ছেলের তালনবমীকে ঘিরে তৈরি হওয়া স্বপ্নভঙ্গের কাহিনি বা বিভূতিভূষণের সিগনেচার গ্রামবাংলার প্রকৃতির কোণে কোণে ছড়িয়ে থাকা অপার সৌন্দর্যের গল্প নয়৷ দুই ভাইয়ের খুনসুটি, অমূল্য রত্নের মতো একখানা ডিম ভাগ করে খাওয়ার আনন্দ, দাদার গলা জড়িয়ে ছোটুর আদর, মায়ের ওপর রাগ করে মুড়ির থালা সরিয়ে দেওয়ার পরেই মায়ের কষ্টে চোখ দিয়ে জল পড়া, স্কুল ছেড়ে মহাদেবের দোকানে কাজে ঢোকার কথা ভেবে রাতের বিছানায় গোপালের চাপা বুকফাটা কান্না, ক্লান্ত চোখের পাতায় বাবার মৃত্যু আর মায়ের রেললাইনে মরতে যাওয়ার ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন মিলেমিশে গেছে শৈশবের গন্ধমাখা সহজপাঠের আদলে সাদাকালো টাইটেল কার্ড, তালদিঘি, বৃষ্টিভেজা বাঁশবন, শাপলা–কচুরিপানায় ভরা ডোবার ধারের ঘাসঝোপ, ভেঙে পড়া মাটির দাওয়া, নিভে আসা হারিকেনের আলো, দিগন্তবিস্তৃত ধানখেত আর মেঘলা আকাশে ভেসে চলা বকের সারির ধূসর ক্যানভাসের সাথে৷ খিদেয় অবসন্ন শরীরে ছোটু দাদাকে বলে– চুরি করলে ঠাকুর পাপ দেয় দাদা, মা বলেছে৷ গোপালের মন বিদ্রোহ করে– কই, খিদে পেলে ঠাকুর খাবার এনে দেয় না তো? এই অমোঘ প্রশ্নের জবাব নেই ওদের কাছে৷ গ্রামের হাটে হিসেবি খদ্দের ওদের ঠকিয়ে কুড়ি টাকার তাল আট টাকায় নিয়ে যায়, বৃষ্টিভিজে তাল নিয়ে আসা ছোট্ট ছেলেটিকে পয়সা ছাড়াই ফিরিয়ে দিতে এতটুকু কুণ্ঠিত হয় না ধনী পরিবারের ‘ঐতিহ্য’, গোপাল–ছোটুর আনা তাল দিয়ে রান্না করা হরেক নৈবেদ্য সাজিয়ে মহা ধূমধামে মাটির গোপালের পুজো হয়, সেই পুণ্যলগ্নেও পেটভরা ভাত পড়ে না দুই ভাইয়ের পাতে৷ তবু চুরি করা বা ঠকানোর কথা কক্ষনো ভাবতে পারে না ওরা৷ ছেলেদের পাতে ভাত দিতে না পারা যে মা চুরি করে আনা সন্দেহে ডিম ছুঁডে ফেলে দেন, বিনা পয়সায় তাল দিয়ে আসার বোকামির জন্য গোপাল ভাইকে মারতে গেলে সেই মা–ই থামিয়ে বলেন ‘ও সরল মনে দিয়েছে, মারতে আছে?’ স্বপ্নদৃশ্যে বাবার মৃতদেহ শুইয়ে রেখে মায়ের পিছনে ছুটে চলা গোপালের আর্ত চিৎকার বুকে কাঁপন ধরায়, অবুঝ সারল্যে বেড়ার জানালায় মুখ রেখে যখন ছোটু বাতাসে পোলাওয়ের কল্পিত সুবাস পায়– চোখ ভিজে যায় অজান্তেই৷
– দাদা, ওরা কী খেতে দেবে রে?
– মুড়িটুড়ি দেবে হয়তো৷
– সে তো তোকে দেবে৷
– যা দেবে দুজন মিলে খাব৷
– সত্যি বলছিস?
ছোট্ট হাতে কুয়োর গা ঘষে ঘষে পরিষ্কার করে গোপাল৷ একমুঠো মুড়ি খাওয়ার আশায় ছোটুর ডাগর চোখদুটো চকচক করে ওঠে৷ এই জীবনের সাথে বাংলার দর্শকের পরিচয় ঘটেনি বহুদিন৷ বিনা পয়সায় তাল দিয়েও ভ্যানচালক বাবার ছেলে হওয়ার অপরাধে তালনবমীর নেমন্তন্ন জুটবে না, এই সহজ সত্যিটা ছোটুর কচি মাথায় ঢুকতে চায় না কিছুতেই৷ অভিমানে দিশেহারা ঠোটদুটো যখন কান্না গিলে ‘কেন করবে না নেমন্তন্ন? আমাদেরও করেছে তো, যাব তো আমরা’ বলে সান্ত্বনা পেতে চায় সেই করুণ আর্তির কাছে অতি তুচ্ছ মনে হয় আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনের চাওয়া–পাওয়া–অনুযোগ–বিরক্তি-সন্দেহ-অসন্ত্তষ্টির টানাপোডেন৷ দুটি ছোট্ট ছেলের অসামান্য অভিনয়, অভাবী জীবনের গভীর থেকে উঠে আসা সংলাপ, সযত্নে নির্মিত দৃশ্য এবং সঙ্গীত ছবির আবেদনকে তাৎক্ষণিকতা থেকে উত্তীর্ণ করেছে নান্দনিকতায়৷ এ ছবি আমাদের পাশে, খুব কাছেই দগদগে ঘায়ের মতো জেগে থাকা গ্রামবাংলার নির্মম দারিদ্রের ক্ষত– উন্নয়নের চকচকে বিজ্ঞাপন যাকে ঢাকতে পারে না৷ এ ছবি অভাব–নটনে জর্জরিত গরিবগুর্বো মানুষের মধ্যে মণিমুক্তোর মতো জেগে থাকা সততা, মুল্যবোধ, আত্মমর্যাদার গল্প৷ হাজার কষ্টের মাঝেও পরস্পরকে পরম ভালবাসা, নির্ভরতায় আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাওয়ার গল্প৷ গোপাল–ছোটুর সারল্যের রঙে ভরপুর রোজকার জীবনের সহজপাঠ– নুর, সামিউল, স্নেহা বিশ্বাস এর অনবদ্য অভিনয়ে সেলুলয়েডে আঁকা মাটি পৃথিবীর গল্প৷
ছবিটি নন্দনে দেখাবার সুযোগ পাননি পরিচালক৷ নন্দন কর্তৃপক্ষ ছবির ‘মেরিট’ বিচার করে অনুমোদন দিতে পারেননি বলে শোনা গেছে৷ গুটিকয়েক মাল্টিপ্লেক্সের বাইরে প্রায় কোনও সাধারণ প্রেক্ষাগৃহেই মুক্তি পেল না এমন একটি অভিবাদনযোগ্য প্রয়োজনীয় ছবি৷ লাভক্ষতির ব্যবসায়িক হিসাব সম্পর্কে অজ্ঞ হয়েও বলা যায়– ছবি কতটা চলবে এ হিসাব করতে হয় ঠিকই, কিন্তু জনরুচি নির্মাণে কোনও সরকার যথার্থই আগ্রহী হলে ভালো ছবি সম্প্রচারের দায়িত্ব কখনই এডাতে পারে না৷ গোপাল–ছোটুর মতো অসংখ্য কুঁড়ির নিরুপায়, দুঃখময় জীবন শিক্ষার অধিকার আইন, শিশুশ্রম নিবারণ, গ্রামবাংলার সমৃদ্ধ–হাস্যোজ্জ্বল চেহারার প্রহসনকে আরও নগ্ন করে ফেলতে পারে এ আশঙ্কাই কি আটকে দিল ছবিটিকে? ইতিহাস অন্তত তেমনই ইঙ্গিত দেয়৷ ছবির দুই শিশু অভিনেতা নুর আর সামিউল কে বেড়াচাঁপার কোনও এক অখ্যাত গ্রাম থেকে জোগাড় করেছেন পরিচালক৷ জাতীয় পুরস্কারের দৌলতে বেশ কিছু ইন্টারভিউ, পরিচিতিও হয়েছে তাদের৷ গোপাল ছোটুদের জীবনে কি কোনও পরিবর্তন আনবে সহজপাঠের গপ্পো? এর উত্তর দিতে পারেন দর্শকরা, যারা ছবিটি দেখেছেন বা দেখবেন৷ লোকেশন, ক্যামেরা, কাস্টিংয়ের আলোচনা অতিক্রম করে ছবির পরতে পরতে জডিয়ে থাকা অনুভবি মুহূর্ত যাদের ছুঁয়ে গেছে৷ আমরা চাইব সন্তানের টিফিনবক্সে সুস্বাদু খাবার ভরে দেওয়ার সময় তাদের গোপাল আর ছোটুর মায়াময় চোখদুটো মনে পড়ুক, এ ছবি দেখার পর বাড়ি–গাড়ি–ডিএ’র হিসাব কষার সময় বা রাস্তায় ভিখিরি দেখলে নমস্কার করে সরে যাওয়ার মুহূর্তে কিছুজনের নিজেকে অপরাধী মনে হোক, কিছু মানুষের চিন্তায় ধরা পড়ুক অন্য রকম সমাজের স্বপ্ন যেখানে গোপাল ছোটুদের খিদের জ্বালায় ধুঁকতে হয় না, পড়া বন্ধ করে কাজে ঢুকতে হয় না, অসহায় মাকে অভাবের তাডনায় নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথা ভাবতে হয় না৷ এই বিপন্ন সময়ে দাঁডিয়ে দারিদ্রক্লিষ্ট জীবনের এই মরমি গল্প কিছু মানুষকে ভাবাবে, দিনবদলের লডাইয়ে সামিল হওয়ার প্রেরণা দেবে– আশা করব আমরা৷
সূর্যস্নাতা সেন, কলকাতা –৭৭