নদিয়ার শান্তিপুরে স্বজন হারানোর হাহাকারে বাতাস ভারী৷ মৃত্যুর সংখ্যা ১২৷ মৃত এবং বিষমদের প্রতিক্রিয়ায় অসুস্থ হয়ে আরও যাঁরা আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, সকলের পরিবারের পক্ষ থেকে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে দাবি জানানো হয়েছে– গ্রামে মদ প্রবেশ বন্ধ করুন৷ সেই দাবিতে মন্ত্রী সাড়া দেননি, তাঁদের হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে দায় সেরেছেন৷
নদিয়ায় এসইউসিঅাই (সি) -র ডাকে
১২ ঘন্টা বনধ
২০১১ সালে দক্ষিণ ২৪ পরগণার সংগ্রামপুরে বিষমদে ১৭৩ জনের মৃত্যু, ২০১৩–তে বীরভূমের তারাপীঠে ৮ জনের মৃত্যু, ২০১৫–তে মেদিনীপুরের ময়নায় ২৫ জনের মৃত্যু বা তার পরেও এখানে সেখানে নানা মৃত্যু থেকে রাজ্য প্রশাসন যে কোনও শিক্ষাই নেয়নি, মদ বন্ধের কোনও উদ্যোগই নেয়নি, শান্তিপুরের ঘটনা সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল৷
আইন অনুযায়ী, চোলাই মদের কারবার বন্ধ করা সরকারের দায়িত্ব৷ বেঙ্গল এক্সাইজ আইনে চোলাই মদ কারবারিদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা করার কথা বলা হয়েছে৷ রাজ্য সরকার এই আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করছে না৷ বরং পুলিশ প্রশাসনের সাহায্যে আইনের নানা ফাঁক দিয়ে অপরাধীরা গ্রেপ্তার এড়াচ্ছে অথবা সহজে জামিন পেয়ে যাচ্ছে এবং আবগারি অফিসার ও পুলিশকে মাসোহারা দিয়ে একইভাবে চোলাই কারবার চালিয়ে যাচ্ছে৷ এলাকার জনগণ বিশেষ করে মহিলারা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে পুলিশ মদ ব্যবসায়ীদের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে৷ কোথায় মদ তৈরি হচ্ছে, কোন পথে তার পরিবহণ এবং বিপণন হচ্ছে সব জেনেও পুলিশ কোনও ব্যবস্থাই নিচ্ছে না৷ ফলে রাজ্য সরকার এই মৃত্যুর দায় কোনও অবস্থাতেই এড়াতে পারে না৷
রাজ্য সরকার কখনও কখনও লোক দেখানো হানায় চোলাই কারবারিদের দু–একজনকে গ্রেপ্তার করলেও তার সামগ্রিক অবস্থান মদের ঢালাও প্রসারের৷ রাজ্যের তৃণমূল সরকার মদের ক্ষেত্রেও পূর্বতন সিপিএম সরকারের নীতিই অনুসরণ করছে৷ প্রচুর মদের দোকানের লাইসেন্স দিয়েছে৷ এ বছর সরকার আরও ১১০০ মদের লাইসেন্স দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে প্রত্যেক গ্রাম পঞ্চায়েতে মদ ভাটি খুলবে বলে শোনা যাচ্ছে৷ সরকারি মদের জোগান বাড়াতে সমস্ত বিলিতি মদ ও বার–রেস্তোরাঁতে দিশি মদ বিক্রির অনুমতি দিয়েছে৷ এক্ষেত্রে সিপিএম সরকার রাজস্ব বৃদ্ধির যে অজুহাত দিত, তৃণমূল সরকারও তাই দিচ্ছে৷
সরকার চালাতে রাজস্ব দরকার এ কথা কেউই অস্বীকার করে না৷ তাই বলে মানুষকে মৃত্যুপথে ঠেলে দিয়ে রাজস্ব আদায় রাজস্বই আসল লক্ষ্য হলে সরকার বড় বড় পুঁজিপতিদের ট্যাক্স ছাড় দেওয়া বন্ধ করুক, তাদের সম্পদের উপর ট্যাক্স বাড়াক, প্রশাসনিক অপচয়–চুরি–দুর্নীতি বন্ধ করুক, এম এল এ–এম পিদের রাজকীয় বেতন–ভাতা–সুবিধা প্রদানে রাশ টানুক, সরকারি টাকায় দান–খয়রাতি করে ভোটব্যাঙ্ক তৈরি, খেলা–কার্নিভাল ও নানা উৎসবে টাকার অপচয় বন্ধ করুক৷ সরকার সে পথে যাচ্ছে না কেন?
সমীক্ষা বলছে, পথদুর্ঘটনার একটা বড় কারণ মদ্যপান৷ হাইকোর্টকে যে কারণে বলতে হচ্ছে, জাতীয় সড়কের ৫০০ মিটারের মধ্যে মদের দোকান থাকা চলবে না৷ নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, ইত্যাদির ক্ষেত্রেও দেখা গেছে অপরাধীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মদ্যপ৷ ধারাবাহিক মদ্যপানে লিভার, কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মৃত্যুও ঘটছে৷ এসব জেনেও সরকার এতবড় একটা ক্ষতিকর কাজের ঢালাও ছাড়পত্র দিচ্ছে কেন?
পুঁজিপতিদের দেদার কর ছাড় দেওয়ায় রাজকোষ ঘাটতি মেটাতে মদের লাইসেন্স দিয়ে টাকা তোলা সরকারের প্রথম লক্ষ্য হলেও দ্বিতীয় লক্ষ্যটি অবশ্যই মানুষকে নেশাগ্রস্ত করে দিয়ে চেতনাকে ভোঁতা করে দেওয়া৷ এমনতরো মানুষই শাসকের পক্ষে সুবিধাজনক৷ তারা রাষ্ট্র নিয়ে, সরকার এবং সরকারের কাজ নিয়ে, সরকারের জনবিরোধী নীতি নিয়ে কোনও প্রশ্ন তুলবে না, তর্ক করবে না৷ তেমনই ভাববে না সমাজের ভাল–মন্দ নিয়েও৷ এমন নিষ্ক্রিয় জনসমাজই শাসকরা চায়৷
সস্তার ভেজাল মদে শান্তিপুরে যাঁরা মারা গেলেন, তাঁরা প্রায় সকলেই দিনমজুর৷ কেউ ভ্যান চালান, কেউ ইটভাটায় কাজ করেন৷ ঘরে অভাব অনটন৷ বাস্তব জীবনের দুঃখকষ্ট ভুলতে এঁরা সারা দিনের রোজগার ভেঙে মদ্যপান করেন৷ মদ ব্যবসায়ীরা নেশা তীব্র করতে ইথাইল অ্যালকোহলের সাথে মিশিয়ে থাকেন মিথাইল অ্যালকোহল৷ কোনও ক্রমে এর মাত্রা বেড়ে গেলেই মদ পরিণত হয় বিষমদে৷ এই মৃত্যু ফাঁদ সরকারি সৌজন্যে বহাল তবিয়তে চলছে৷ ২০০০ সালে সিপিএম জমানায় নদিয়ার কৃষ্ণনগরে বিষমদে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছিল৷ ২০০৯ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জমানায় তমলুকের রামতারকে বিষমদে মৃত্যু হয়েছিল ৪৮ জনের৷ সরকার বদলেছে৷ বদলায়নি তার মদনীতি৷ চলছে মৃত্যুমিছিল৷
মদ নিষিদ্ধ করার দাবিতে ৩০ নভেম্বর এসইউসিআই (সি) নদিয়া জেলা বনধের ডাক দেয়৷ জেলার সর্বত্র শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এই বনধকে স্বাগত জানান৷ বনধের প্রচারকালীন জনগণ বলেন, সরকার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নামে মৃত্যুর দায় এড়াচ্ছে৷ স্কুল, কলেজ, বাজারে বনধের প্রভাব ছিল ভালই৷ সমস্ত আদালত ছিল পুরোপুরি বন্ধ৷ দলের জেলা সম্পাদক মৃণাল দত্ত বলেন, রাজ্যে মদ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার দাবিতে এসইউসিআই (সি)–র আন্দোলন চলবে৷