প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মাসখানেক আগেই গলায় আবেগ ঢেলে বলেছেন, সারা বিশ্ব ভারতের যুবসমাজের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তিনি কি তাকাতে ভুলে গেছেন! না হলে ভারতে যুব সম্প্রদায়ই সবচেয়ে কম কাজের সুযোগ পাচ্ছে কেন? এমনিতেই তিনি ভুলেও আর বছরে দু’কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতির কথা মুখে আনছেন না। প্রতিশ্রুতির ফোয়ারা ছোটাতে স্বয়ং নরেন্দ্র মোদিকেও যখন ঢোক গিলতে হয়– ব্যাপারটা তখন কত গভীর তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। আর্থিক উপদেষ্টা সংস্থা সিএমআইই তাদের নিয়মিত সমীক্ষার ভিত্তিতে জানিয়েছে, ভারতে কাজের বাজারে এখন সবচেয়ে অবহেলিত অংশ হল ১৫ থেকে ৩৫ বছরের কর্মপ্রার্থীরা। অর্থাৎ এ দেশে যুবসমাজের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি হারে বাড়ছে বেকারত্ব। যুব-সম্প্রদায়ের মাত্র ১০.৪ শতাংশ কর্মপ্রার্থী বিগত আর্থিক বছরে কাজ পেয়েছে।
ক’দিন আগেই প্রধানমন্ত্রী সরকারি দপ্তরগুলিকে ১০ লক্ষ পদ পূরণের জন্য তৈরি হতে বলেছিলেন। সেটাও একটা জুমলা, নাকি সব নিয়োগই হবে ‘অগ্নিপথের’ স্টাইল মেনে, উত্তরটা জানা যায়নি। সম্প্রতি ব্যাঙ্কের ক্লার্ক থেকে অফিসার পর্যন্ত নিয়োগেও এই ফরমুলাই প্রয়োগ করতে চেয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। সরকারি কাজের নামে যুবসম্প্রদায় নামমাত্র বেতনে অস্থায়ী চুক্তির ভিত্তিতে কয়েক বছরের জন্য নিযুক্ত হবে, তিন-চার বছর পর যুব বয়সেই তাঁরা ‘রিটায়ার্ড’ তকমা নিয়ে ফেলবেন! এরপর তাঁদের সংসার প্রতিপালনের উপায় কী হবে? উত্তর দেওয়ার দায় নিয়ে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হননি! তাঁর ‘মন কি বাত’ জনগণকে শুনতে হয়, তিনি জনগণের কথা শুনবেন– এত সময় কোথায়?
বেশিদিন নয়, গত জানুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদব ২০২১-এর প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক কর্মসংস্থান সমীক্ষার ত্রৈমাসিক রিপোর্ট হাতে নিয়ে জোর গলায় দাবি করেছিলেন, গত বছর জুনের তুলনায় সেপ্টেম্বরে ২ লক্ষ কর্মসংস্থান বেড়েছে। মন্ত্রীমশাইয়ের দুর্ভাগ্য– তাঁর অতবড় ঢাকটা অতি অল্প দিনেই ফেঁসে গেছে! সিএমআইই ২০২২-এর মে মাসে জানিয়েছে নতুন করে ১ কোটি ৪০ লক্ষ কর্মচারী কাজ হারিয়েছেন। এই সংস্থা জানিয়েছে, আগস্টে বেকারত্বের হার বেড়ে শহরে দাঁড়িয়েছে ৯.৭ শতাংশ, গ্রামে ৭.৬ শতাংশ। হরিয়ানা, জম্মু-কাশ্মীর, রাজস্থানের মতো কিছু রাজ্যে তা ৩০ শতাংশে পৌঁছেছে।
কেউ দাবি করতে পারেন ৯.৭ শতাংশ আর এমনকী চড়া বেকারত্বের হার! আসলে এখন প্রকৃত অর্থে বেকারত্বের হিসেব প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক সমীক্ষা থেকে পাওয়া যায় না। বেকারত্বের হার বলে যেটাকে দেখানো হয়, তা হল কাজের বাজারে কাজ খুঁজতে এসে কতজন কাজ পাননি, তারই শতাংশ ভিত্তিক হিসাব। জনসংখ্যার নিরিখে ধরলে ভারতে ১৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সি কর্মক্ষম জনসংখ্যার ৫৩ শতাংশ পুরোপুরি রোজগারহীন। ৪৭ শতাংশ মাত্র কিছু কাজ পায়। করোনা মহামারির ওপরে যে দোষ চাপানো যাবে না। মহামারি আসার আগেই সরকারের সংস্থা ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে অরগানাইজেশন (এনএসএসও) জানিয়েছিল ২০১৯-এর আগেই ভারতে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি ৪৫ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সেই রিপোর্ট প্রকাশ না করে কেন্দ্রীয় সরকার সংগঠনটারই অস্তিত্বই বিলোপ করে দিয়ে তাকে স্ট্যাটিস্টিকাল অফিসে পরিণত করেছে।
ভারতের জনসংখ্যার অর্ধেকই হল ২৫ বছরের আশেপাশের যুবসম্প্রদায়। যে কোনও দেশের পক্ষেই এটা একটা বিরাট সম্পদ হতে পারে। কিন্তু যুবসমাজের শিক্ষিত অংশের চাকরি পাওয়াটাও অনিশ্চিত। সমীক্ষা দেখাচ্ছে ২০২১-এ গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারীদের ১৯.১ শতাংশ চাকরি পায়নি। কিছু কিছু রাজ্যে এই বেকার গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা আরও বেশি। বিহারে তা ৩৪.২ শতাংশ। কর্ণাটকের আইটি সেক্টর বাদ দিলে বেশিরভাগ রাজ্যেই ১২ থেকে ১৫ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট চাকরি পান না। তার মধ্যে আছে নরেন্দ্র মোদির রাজ্য গুজরাটও। ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের মতে ভারতের প্রতি ১০ জন গ্র্যাজুয়েটের মধ্যে মাত্র একজন ডিগ্রি অনুযায়ী চাকরি পেতে পারে। সে জন্যই বিজেপি শাসিত হিমাচলপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশই হোক কিংবা তৃণমূল শাসিত পশ্চিমবঙ্গই হোক, দেখা যায় পিওনের চাকরি, ডোমের চাকরির জন্য হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট, এমএ, পিএইচডি ডিগ্রিধারীরা দরখাস্ত নিয়ে লাইন দেয়।
যারা চাকরি একটা পাচ্ছেও তাদের মাত্র ২১ শতাংশ নিয়মিত বেতনে কাজ করে, ২৩ শতাংশ ক্যাজুয়াল লেবার এবং ৫৬ শতাংশই ‘সেল্ফ এমপ্লয়েড’। নিয়মিতদের ৬৪ শতাংশেরই কোনও লিখিত কন্ট্রাক্ট নেই, ৪৮ শতাংশ একটাও সবেতন ছুটি পায় না। আর বেতনের পরিমাণ ? মুকেশ আম্বানি ঘন্টায় ৯০ কোটি টাকা আয় করলেও বহু শ্রমিকের আয় দিনে ২০০ টাকারও কম। সরকারি তরফে দক্ষ এবং অদক্ষ শ্রমিকের নূ্নতম মজুরি ৩১১ টাকা থেকে ৪৭৩ টাকা পর্যন্ত ধার্য করা আছে। সে টাকাতে এই মূল্যবৃদ্ধির বাজারে মানুষের কী হয় সে প্রশ্ন না হয় ছেড়েই দেওয়া গেল, কিন্তু এই টাকাই পায় কতজন?
স্বাধীনতার ৭৫ বছরে অমৃত মহোৎসবের জেল্লাদার উৎসব এই অন্ধকারকে কি ঢাকতে পারে? যে দেশের জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ যৌবনের শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সে দেশে কীসের অভাব? প্রাকৃতিক সম্পদ অঢেল। প্রাকৃতিক সম্পদ এবং মানব সম্পদ ব্যবহার করে মানুষের জন্য বিপুল উৎপাদন সম্ভব। তাতে প্রতিদিন কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়ে চলার কথা। কারখানা বন্ধ হওয়া দূরে থাক, এত মানুষের প্রয়োজন মেটাতে আরও বেশি কারখানা খেলার কথা। অথচ যে সব কারখানা আছে তাতেই উৎপাদন হচ্ছে না, প্রতিদিন কলকারখানা বন্ধ হচ্ছে। কর্মসংস্থান বাড়া দূরে থাক তা দিনে দিনে কমছে।
কেন এমন হচ্ছে? নরেন্দ্র মোদিরা যখন বিরোধী দলে ছিলেন, তখন বলতেন কংগ্রেস সরকারের জন্য বেকারত্ব বাড়ছে। কংগ্রেস এখন বলছে বিজেপি সরকারের জন্য বেকারত্ব বাড়ছে। যেমন পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম গদিতে থাকার সময় বেকারত্বের জন্য তৃণমূল তাদের দিকে আঙুল তুলত, এখন সিপিএম বলছে এদের হঠিয়ে আমরা ক্ষমতায় এলেই বেকারত্বের অবসান হবে! কিন্তু সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা, যে দলই সরকারি গদিতে বসুক, নতুন নতুন কলকারখানা খোলা, বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি বা বেকারত্বের অবসান ঘটানোর চেষ্টা কেউই করতে পারে না। কেন? সত্যটা আসলে তারা কেউই বলে না। এরা সরকারে যায় পুঁজিপতি শ্রেণির সেবা করতে। ঝান্ডার রঙ তাদের যাই হোক এই চরিত্রে তারা এক। আর পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পুঁজিপতিরা উৎপাদন করে নিজেদের সর্বোচ্চ মুনাফার দিকে লক্ষ্য রেখে। যতটুকু উৎপাদন করলে তাদের সর্বোচ্চ মুনাফা হতে পারে তার বেশি উৎপাদন তারা করতে দেয় না। এর সঙ্গে প্রতিনিয়ত শ্রমিকের উপর চলা নির্মম শোষণে দেশের বেশিরভাগ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমাগত কমতে থাকে। ফলে তীব্র বাজার সংকটে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ভুগতে থাকে। এর মধ্যে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি বিপুল মুনাফা তুলে নিতে পারে, দুচারটে কারখানাও খুলতে পারে। কিন্তু তাতে কর্মসংস্থান হয় না। বরং চলতে থাকে শ্রমিক ছাঁটাই।
যে দলই সরকারে যাক, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সেবা করে এই চিত্র তাদের পক্ষে পাল্টানো সম্ভব নয়। এই সত্যটা জনগণকে বুঝতে হবে। কর্মসংস্থানের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেকার যুবকদের ঠকিয়ে ভোট জোগাড়ের এই চক্রকে ভাঙতে গেলে দরকার কর্মসংস্থানের দাবিতে লাগাতার আন্দোলন। যে পথে কিছুটা হলেও শ্রমনিবিড় শিল্প গড়ে তুলতে সরকারকে বাধ্য করা যেতে পারে।