যুদ্ধ হোক বা দুর্ভিক্ষ, যখন মানুষ নির্বিচারে মারা পডে, ধনে-প্রাণে দেউলিয়া হয়, ঠিক সেই সময় ওৎ পেতে থাকা শোষক-পুঁজিপতিরা মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে লাভের কড়ি গোনে। তাদের মুনাফার হার ছাপিয়ে যায় আগেকার সমস্ত রেকর্ড। অতি প্রয়োজনীয় খাদ্য, ওষুধসহ নিত্যপণ্যের মজুতদারি ও কালোবাজারি করেই এই কাজটা সারে তারা অবলীলায়। এখন যে কোভিড অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ সমগ্র বিশ্বকে তথা সাধারণ মানুষকে বিপর্যস্ত করে ফেলছে, ভারতসহ বিশ্বের দেশগুলোতে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটছে, সে সময়ও থেমে নেই কর্পোরেট পুঁজিপতিদের উদগ্র লালসা জনিত কালোবাজারির রমরমা। ওষুধ, অক্সিজেন থেকে শুরু করে প্রতিষেধক টিকা কোনও কিছুই এর আওতার বাইরে নেই। মুনাফার স্বার্থের কাছে কণামাত্র দাম নেই মানুষের জীবনের। সাধারণের জন্য যে জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তোলা ছিল অতিমারি ঠেকাতে আশু প্রয়োজন, সরকারি নীতিতে তা এখন অমিল। অতিমারি ঠেকাতে বিশ্বের বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকরা যে প্রতিষেধক গ্রহণের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করছেন, বিশ্ব জুড়ে দেখা দিয়েছে তার ভয়ঙ্কর আকাল।
এ দেশের দিকে তাকিয়ে দেখুন, বহু মানুষই প্রয়োজনীয় টিকা পাচ্ছেন না। যখন দাবি উঠছে সরকারি উদ্যোগে সকলের জন্য বিনামূল্যে টিকাদান প্রকল্পের, তখন কেন্দ্রীয় সরকার সেই দাবি কিছুতেই মানছে না। কর্পোরেট ফার্মা কোম্পানির স্বার্থই তাদের কাছে বড়। এমনকি জীবনদায়ী ওষুধ, পিপিই, ভেন্টিলেটর ও টিকার উপর থেকে জিএসটি সরাতেও রাজি নয় সরকার। যেখানে প্রয়োজন ছিল বিপুল উৎপাদন সেখানে মুনাফালোভী কোম্পানিগুলো উৎপাদনকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সেই সুযোগে ব্যাপক দাম নির্ধারণ করে তার মুনাফাকে নিিচত করতে চাইছে। উৎপাদনে স্বল্পতার জন্য সৃষ্টি হয়েছে বন্টনের ক্ষেত্রে ব্যাপক সংকট। অর্থের বিনিময়ে যদি বা বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রতিষেধক পাওয়া যায়, সরকারি হাসপাতালগুলোতে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকলেও যথেষ্ট প্রতিষেধক মিলছে না। রয়েছে শহর ও গ্রামের বৈষম্য। কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের টিকা নীতি দেশের মধ্যে প্রতিষেধক বৈষম্য বাড়িয়ে তুলছে, যা ভয়ঙ্কর।
শুধু এ দেশে নয়, প্রতিষেধক বৈষম্য এখন বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। উচ্চ আয়ের দেশগুলো যত পরিমাণ ভ্যাকসিন প্রথমে কিনে মজুত করে নিয়েছিল, নিম্ন আয়ের গরিব দেশগুলো তার ক্ষুদ্রাংশও পায়নি। একটা পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে বাস করেন বিশ্বের মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ। অথচ উৎপাদিত প্রতিষেধকের ৪৫ শতাংশ রয়েছে ওই দেশগুলোর হাতে। অপরদিকে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক বাস করেন নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে, অথচ তাদের হাতে মোট প্রতিষেধকের মাত্র ১৭ শতাংশ রয়েছে। যে কারণে বিত্তশালী দেশগুলি বিশেষ করে আমেরিকা, ব্রিটেন এবং ইজরায়েল সহ বেশিরভাগ দেশে ইতিমধ্যেই শিশু-কিশোরদের টিকাকরণ শুরু করলেও আফ্রিকা থেকে শুরু করে ভারত, ব্রাজিলের মতো অধিক জনসংখ্যা বিশিষ্ট দেশগুলোতে ৯০ শতাংশ মানুষই টিকা পাননি। বহু ক্ষেত্রেই সামনের সারির করোনা যোদ্ধারাও টিকা থেকে বঞ্চিত থেকে গেছেন। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে কোভিড সংক্রমণ রোধে হু-র উদ্যোগে গঠিত কোভ্যা’ প্রকল্প বাস্তবে মুখ থুবড়ে পড়েছে। এই প্রকল্পটি তৈরিই হয়েছিল কোভিড অতিমারির জন্য যথেষ্ট পরিমাণ প্রতিষেধক তৈরি এবং বিশ্বজুড়ে তার সমবন্টনের উদ্দেশ্যে। ঘোষিত কর্মসূচি ছিল প্রতিটি দেশের মোট জনসংখ্যার কুড়ি শতাংশকে এই বছরের মধ্যে প্রতিষেধক টিকা দেওয়া হবে। সেজন্য দেশে দেশে মোট ২০০ কোটি ডোজ পাঠানোর কর্মসূচি ঠিক হয়েছিল এই বছরের মধ্যে। আশঙ্কা, এই কর্মসূচি সুদূরপরাহত থেকে যাবে। পরিসংখ্যান বলছে, নিম্ন আয়ের দেশগুলোর মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.১ শতাংশ মানুষকে এই টিকা দেওয়া গেছে। যেখানে উচ্চ আয়ের দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ এই টিকা পেয়ে গেছেন। আমেরিকা, ব্রিটেন, ইজরায়েলের মতো দেশগুলি ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আগে থেকেই আগাম অর্থ দিয়ে জনসংখ্যার অনুপাতের চেয়েও বেশি ভ্যাকসিন কিনে নেয় এবং মজুত করে রাখে। অপরদিকে নিম্ন আয়ের দেশগুলো অর্থাভাবে ভ্যাকসিন পায় না। আফ্রিকার অত্যন্ত দরিদ্র দেশগুলোতে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর অভাব এতটাই যে কোভ্যাক্সিন প্রকল্পের ভ্যাক্সিন পেলেও তা সে দেশের সরকার দেশবাসীকে দিতেও পারে না, নষ্ট হয়। অথচ অতিমারি বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকরা সমস্বরে বলছেন, করোনা অতিমারি রুখতে এই বৈষম্য নিদারুণ প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। কারণ অতিমারির চরিত্র এমনই যে সারা বিশ্বে একই সাথে টিকাকরণ কর্মসূচি না চালানো হলে করোনা অতিমারিকে সমূলে উৎপাটন করা কার্যত অসম্ভব। তা ছাড়া, এ না হলে শুধু দ্বিতীয় ঢেউতেই থেমে না থেকে ভাইরাস নিজের মিউট্যান্ট পাল্টে তৃতীয়- চতুর্থ ঢেউ আকারে আসতেই থাকবে বিশ্বজুডে, যা আরও প্রাণহানির কারণ হবে। মানব সভ্যতার পক্ষে যা হবে আত্মঘাতী।
এই ভ্যাকসিন বৈষম্যের কারণ কী? ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পর তার পেটেন্ট বা উৎপাদন স্বত্ত্ব কিনে নিয়েছে মুষ্টিমেয় কর্পোরেট পুঁজি মালিক। তারা লাভের উদ্দেশ্যেই ভ্যাকসিনের উৎপাদন ও বন্টন নিয়ন্ত্রণ করছে, যেমন খুশি দাম নির্ধারণ করছে। ভারত সহ বিভিন্ন দেশের ক্ষমতাসীন সরকারগুলো কর্পোরেট পুঁজির লেজুড়বৃত্তির কারণে অর্থাৎ পুঁজিপতিদের মুনাফা রক্ষার নিরিখে দেশের স্বাস্থ্যনীতি নির্ধারণ করার কারণে বিশ্বজুড়ে সার্বজনীন ভ্যাকসিন প্রদান কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ভারতেও বিজেপি সরকার দেশের সব মানুষের কাছে ভ্যাক্সিন পৌঁছে দেওয়ার থেকেও ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী কোম্পানির মুনাফাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। তার ফলেই আজ দেশজুড়ে ভ্যাকসিনের এমন চূড়ান্ত সংকট দেখা দিয়েছে।
অথচ একদা সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি দেখিয়ে দিয়েছিল প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর জোর দিলে বসন্ত -টিবির মতো রোগ-ব্যাধিকে অনেক আগেই রুখে দেওয়া যায়। কমিউনিটি মেডিসিন, জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামো, এপিডেমোলোজি তথা মহামারি নিয়ন্ত্রণের বিশেষ চিকিৎসা পদ্ধতির সঠিক প্রয়োগ সোভিয়েত সমাজতন্ত্রই প্রথম দুনিয়াকে দেখিয়েছিল। এখনকার সমাজতান্ত্রিক দেশ কিউবা রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যনীতি সঠিক ভাবে প্রয়োগের ফলে কোভিড অতিমারিকে রুখে দিতে পেরেছে। এই প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে যাওয়া মুমূর্ষু পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থাই করোনা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এই ব্যবস্থা যত দিন টিকে থাকবে তত দিন মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলতেই থাকবে। পুঁজিবাদী এই সমাজ ব্যবস্থার উচ্ছেদের প্রশ্ন আজ সভ্যতার টিকে থাকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে।