যুদ্ধ পুঁজিবাদী অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ
আজ থেকে বহুদিন আগে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস, শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।’ তাঁর এই সতর্কবাণী আজ অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে। একদিকে ‘সুন্দর’, ‘বিপন্মুক্ত’ পৃথিবী গড়ার কথা বলছেন দেশনেতারা, অন্য দিকে বিপুল পরিমাণ অত্যাধুনিক অস্ত্র উৎপাদন করে একের পর এক দেশে যুদ্ধ বাধিয়ে হাজার হাজার মানুষকে প্রাণে মারার নিখুঁত পরিকল্পনা করছেন। তার জন্য ফি-বছর সামরিক খাতে খরচ রেকর্ড হারে বাড়িয়ে চলেছে নানা দেশের পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা। দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালে বিশ্বে সামরিক খাতে মোট ব্যয় ৩.৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ২২৪০ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ২ লক্ষ ২৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে যে তিনটি দেশ– আমেরিকা, চীন এবং রাশিয়া, তারা বিশ্বের মোট সামরিক খরচের ৫৬ শতাংশ ব্যয় করে এই খাতে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপরি)-র প্রকাশিত রিপোর্টে উঠে এসেছে এই বিপজ্জনক তথ্য। তা হলে বিশ্বের শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের অন্তরের আকাঙ্খা যে ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’ তা কি শুধু স্লোগানই থেকে যাবে?
সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর কার্যকলাপে সেই আশঙ্কাই দৃঢ় হচ্ছে। তারা বিশ্ব জুড়ে যুদ্ধ উন্মাদনা জিইয়ে রাখতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উৎপাদন এবং কেনাবেচা করছে। দুর্বল দেশগুলিকে অস্ত্র সরবরাহ করছে এবং একটা দেশের সাথে অন্য দেশের যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়ে অস্ত্রবাজারকে চাঙ্গা রাখছে। রাশিয়া, ইউক্রেন কোনও দেশের সাধারণ মানুষই যুদ্ধ চায় না। তা সত্তে্বও এক বছরের বেশি চলছে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এই যুদ্ধের পরিণামে পৃথিবীর নানা দেশে দারিদ্র, অনাহার আরও ভয়ঙ্কর হচ্ছে তা জানা সত্তে্বও কোনও দেশের শাসকই যুদ্ধ বন্ধের কোনও চেষ্টা করছে না। উল্টে ইউক্রেনকে ভয়ানক সব মারণাস্ত্র দিয়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে আরও দীর্ঘস্থায়ী হতে সাহায্য করছে আমেরিকা, জার্মানি, ইংল্যান্ড সহ ইউরোপের নানা দেশ। অন্য দিকে তারা ইউক্রেনকে যুদ্ধজোট ‘ন্যাটো’র সদস্য করতে চেষ্টা চালাচ্ছে। আগেও এইভাবে আমেরিকা বছরের পর বছর ধরে লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান সহ নানা দেশে আক্রমণ চালিয়ে ‘গণতন্ত্র’ রক্ষা করেছে! কখনও কোনও দেশকে ‘সাহায্য’ করার নামে, অথবা দ্বন্দে্ব অবতীর্ণ দুটি দেশের মধ্যে ‘শান্তিস্থাপনে’র নামে এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে মিলিটারিতে ‘সুপারপাওয়ার’ আমেরিকা।
বিশ্বের নানা দেশে সামরিক খাতে ব্যয়ের বহর দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন দেশগুলির আর্থিক সঙ্কটের বিষয়টি। এই খাতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে আমেরিকা। ২০২২-এ এই খাতে ৮৭৭ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে বিশ্বে সর্বাধিক যুদ্ধাস্ত্র তৈরির এই দেশ। বিশ্বের মোট ব্যয়ের ৩৯ শতাংশই খরচ করে আমেরিকা। দ্বিতীয় দেশ চীন ব্যয় করেছে ২৯২ বিলিয়ন ডলার। ২০১৩ সালে এই খাতে চীন যা খরচ করত এখন তার থেকে ৬৩ শতাংশ বেশি খরচ করছে বেকারত্বে জর্জরিত এই দেশ। ন্যাটোর সদস্যভুক্ত দেশগুলি ২০২২-এই শুধু ১২৩২ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। রাশিয়ায় সামরিক ব্যয় বেড়েছে ৯.২ শতাংশ অর্থাৎ ৮৬.৪ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের জিডিপি-র ৪.১ শতাংশের সমতুল্য। সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া ২০২১ সালের সামরিক বাজেটের থেকে ৩৪ শতাংশ এমনিতেই বাড়িয়েছে। সেজন্য দারিদ্র, বেকারিতে জর্জরিত দেশের সাধারণ মানুষের কাছে শাসকগোষ্ঠী যুক্তি দিচ্ছে, ইউক্রেনে আগ্রাসন এতদিন চলবে তা তারা নাকি বুঝতে পারেননি। অর্থাৎ নিজেদের দায়মুক্ত করতে সামরিক খাতে ব্যয়বৃদ্ধির দায় কার্যত ইউক্রেনের ঘাড়েই ঠেলে দিয়েছে। যুদ্ধ চালিয়ে যেতে মরিয়া ইউক্রেনও ইদানীং কালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খরচ করেছে সামরিক খাতে। ২০২২-এ ইউক্রেন অস্ত্র আমদানিতে পঞ্চদশ থেকে এগিয়ে তৃতীয় স্থানে এসেছে। বিশ্বের সব সাম্রাজ্যবাদী দেশই হয় ইউক্রেন, নয় রাশিয়াকে সহযোগিতা করার নামে শকুনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে একবিংশ শতাব্দীর ভয়াবহ এই ধ্বংসলীলায়। এভাবে নিজেদের অস্ত্রবাজারকে চাঙ্গা রাখছে তারা।
ভারতও সামরিক বাজেটবৃদ্ধিতে পিছিয়ে নেই। অস্ত্র আমদানিতে শীর্ষে রয়েছে ভারত। ভারত কখনও আমেরিকা কখনও রাশিয়া উভয় দেশের সাথে সু-সম্পর্ক রেখে সামরিক সম্ভারে প্রথম সারিতে উঠে আসতে চাইছে। সম্প্রতি আমেরিকা সফরে গিয়ে বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি চুক্তি করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে তিনশো কোটি ডলার মূল্যের ৩০টি হামলাকারী ড্রোন কেনা, আমেরিকার জেনারেল ইলেকট্রিক-এর ভারতের ‘হ্যাল’-এর সঙ্গে একত্রে যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন তৈরি ইত্যাদি। এ ছাড়া রয়েছে সমুদ্রপথে নজরদারির জন্য আমেরিকা থেকে লিজে নেওয়া ড্রোনের (সি গার্ডিয়ান) মেয়াদ বাড়ানোর চুক্তিও। সম্প্রতি ফ্রান্সের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে ভারত। এভাবেই ‘দেশপ্রেমিক’ সাজছেন আমাদের দেশের নেতা-মন্ত্রীরা। আর তাঁদের ‘সৌজন্যে’ খালি পেটে ঘুমোতে যাওয়া লক্ষ লক্ষ মানুষকে যুদ্ধবিমানের মহড়া দেখেই খুশি হতে হচ্ছে! ‘দেশপ্রেমের’ জিগির তোলা এই যুদ্ধবাজ শাসকরা দেশের সৈন্যদের প্রাণ বাজি রেখেই এই সব কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বে সামরিক ব্যয়ে চতুর্থ স্থানাধিকারী দেশ ভারত ২০২২-এ ৮১.৪ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ৮ হাজার ১৪০ কোটি টাকা খরচ করছে, যা ২০২১ সালের থেকে ৬ শতাংশ বেশি। ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়া কৃষক আত্মহত্যা করছে, কাজ না পাওয়া বেকার যুবক পরিবার-পরিজন ছেড়ে পরিযায়ী শ্রমিকে পরিণত হচ্ছে, ফি দিতে না পেরে শিক্ষার সুযোগ হারাচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা, চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে না পেরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে কত শত মানুষ। এ সব নিয়ে দেশের শাসকরা বিন্দুমাত্র বিচলিত নন। তারা কৃষি-বাজেট, শ্রম-বাজেট কিংবা শিক্ষা-স্বাস্থ্য বাজেটে বরাদ্দ দিনের পর দিন কমিয়ে চলেছে। অজুহাত দিচ্ছে, সরকারি কোষাগারে অর্থের অভাবের, অথচ সামরিক বাজেট বাড়িয়েই চলেছে। পূর্বের কংগ্রেস বা বর্তমানের বিজেপি উভয় সরকারই যখন-তখন পাকিস্তান-জুজু দেখিয়ে সামরিক বাজেট বাড়িয়়ে চলেছে। এমনকী বাজেট বহির্ভূত খরচও বাড়িয়ে চলেছে।
দেশের সাধারণ মানুষের পরিস্থিতির কথা বিন্দুমাত্র না ভেবে ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ে তোলার জিগির তুলে দেশের অভ্যন্তরে অস্ত্র ও যুদ্ধের সরঞ্জাম তৈরি করার একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগোচ্ছে বিজেপি সরকার। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক আগামী পাঁচ বছরে দেশীয় কোম্পানিতে ২৫ বিলিয়ন ডলারের যুদ্ধের সরঞ্জাম তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে, এর মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলারের যুদ্ধাস্ত্র বিদেশে রপ্তানি করার টার্গেট রয়েছে। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ স্লোগান দিয়ে বিজেপি নেতারা ভারতকে সামরিক দিক থেকে আরও শক্তপোক্ত করার অঙ্গীকার করছেন। এর জন্য ২০২৩-২৪ বর্ষে সামরিক খাতে বরাদ্দের ৭৫ ভাগ ধার্য করা হয়েছে দেশীয় কোম্পানিতে যুদ্ধাস্ত্র তৈরির জন্য। বেসরকারি কোম্পানি এবং স্টার্ট-আপ সংস্থাগুলিকে এর বরাত দেওয়া হয়েছে। অনিল আম্বানির রিলায়েন্সকে মহারাষ্ট্রের মিহানে সমরাস্ত্র তৈরি করার এবং সেগুলি বিশ্বের যে কোনও দেশে বিক্রির ছাড়পত্র দিয়েছে সরকার। জানা গেছে, ২০১৫ সালে রাশিয়ার এক অস্ত্র উৎপাদক সংস্থার সাথে আম্বানির করা যুদ্ধ-বিমানের আক্রমণ প্রতিরোধী অস্ত্র তৈরির চুক্তিতে মধ্যস্থতা করেছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এর ক্রেতা হচ্ছে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী। বিজেপি ঘনিষ্ঠ আদানিও ইজরায়েলের অস্ত্র কোম্পানির সাথে যৌথ উদ্যোগে সমরাস্ত্র তৈরির ব্যবসায় নেমেছে (টাইমস অফ ইন্ডিয়া -৫ আগস্ট, ২০২২)। অস্ত্র উৎপাদনে স্বনির্ভর হওয়ার বাসনায় ভারত সমরাস্ত্র রপ্তানিও বাড়িয়েছে। সেজন্য ২০২২-২৩ এ ভারতের রপ্তানি খাতে খরচ ধার্য হয়েছে ১৬ হাজার কোটি, যা ইদানীং কালের মধ্যে সর্বাধিক। সরকারি সূত্রে খবর, ২০১৬-১৭ সালের থেকে রপ্তানি বেড়েছে ১০ গুণেরও বেশি।
বিশ্বে সামরিক দিক থেকে অন্যতম শক্তিশালী দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে উঠেপড়ে লেগেছে ভারত। সেজন্য ভারত আমেরিকার সাথে যৌথভাবে সামরিক মহড়া দিচ্ছে। মোদি সরকার বিশ্বের মধ্যে প্রতিরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করতে আগামী দশকে এই খাতে ২৫০ বিলিয়ন ডলার খরচের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আভ্যন্তরীণ সংকটকে ধামাচাপা দিতে এবং অর্থনীতিকে আপাত চাঙ্গা রাখতে যুদ্ধের জিগির তোলা একান্ত প্রয়োজন আজ আমেরিকা থেকে ভারত– প্রতিটি সাম্রাজ্যবাদী দেশের শাসকের। বাজার সংকট আজ প্রতি মুহূর্তের সংকটে পরিণত হয়েছে। বর্তমান পুঁজিবাদী সংকটের সমাধান বা এর থেকে বেরিয়ে আসার কোনও দাওয়াই দিতে পারছেন না বিশ্বের তাবড় অর্থনীতিবিদরা। সংকটগ্রস্ত মানুষ ক্রমশই আরও সোচ্চার হচ্ছেন এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, শাসকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন, যুদ্ধের বিরুদ্ধে স্লোগান তুলছেন। শাসকরা একদিকে অন্য দেশের উপর তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে, অন্যদিকে মুমুর্ষু পুঁজিবাদী বাজারকে কিছুটা হলেও চাঙ্গা করতে অস্ত্রকে পুঁজি করছে। ফলে যুদ্ধ পুঁজিবাদী অর্থনীতির অনিবার্য পরিণাম। অবক্ষয়িত স্তরে পুঁজিবাদ যুদ্ধ ছাড়া বাঁচতে পারে না। অর্থনীতির সামরিকীকরণ করা তাই অনিবার্য হয়ে উঠেছে– অস্ত্র উৎপাদনে শীর্ষ দেশ আমেরিকা কিংবা ভারতের মতো অস্ত্র উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করতে চাওয়া ভারতের শাসকদের কাছে। তাই ইতিমধ্যেই যুদ্ধে বিধ্বস্ত বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের যুদ্ধ বন্ধের করুণ আবেদন শাসকদের কানে পৌঁছচ্ছে না অথবা তারা শুনেও না শোনার ভান করছেন। একমাত্র যুদ্ধবিরোধী মানুষের সংঘবদ্ধ লড়াই-ই আনতে পারে যুদ্ধমুক্ত পৃথিবী।