বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল হল ২০২৪-এ ভারতের লোকসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনে খরচ হয়েছে ১.৩৫ লক্ষ কোটি টাকা, প্রতিটি ভোট সংগ্রহে খরচ ১৪০০ টাকা। খরচের বহরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে ভারতের অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন। সেখানে খরচ হয়েছিল ১.২০ লক্ষ কোটি টাকা (পিটিআই-২৬ এপ্রিল)।
কোন দেশে এই বিপুল খরচ করেছে বুর্জোয়া শাসক দলগুলি? যে দেশে সাধারণ মানুষের কানাকড়িও দাম নেই। যে ভারতে অপুষ্টিতে মারা যায় অসংখ্য শিশু, চাকরি না পেয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয় বেকার যুবক, দারিদ্রের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে নিজের সন্তানকে হত্যা করে আত্মঘাতী হয় মা, যেখানে ঋণের টাকা শোধ করতে না পেরে কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয় হাজার হাজার চাষি, যে দেশে বন্ধ কারখানার শ্রমিক গলায় দড়ি দিয়ে জীবনের জ্বালা জুড়োয়!
‘সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজ’ দেশে ভোটে খরচের হিসাব দিয়ে জানিয়েছে, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে খরচ হয়েছিল ৫৫-৬০ হাজার কোটি টাকা। এ বার দ্বিগুণেরও বেশি খরচ হয়েছে। সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, ১৯৫১-৫২ সালের সঙ্গে তুলনা করলে খরচসীমার বৃদ্ধি হয়েছে ৩০০ গুণ। তখন একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা খরচ করতে পারতেন। আর এ বার একজন প্রার্থী ৯৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে পারেন। কত গুণ বেড়েছে হিসাব করুন! তাও খরচ-সীমা প্রযোজ্য হচ্ছে মনোনয়ন জমা দেওয়ার পরে হওয়া জনসভা, রোড শো, বিজ্ঞাপন ও পরিবহণ সংক্রান্ত খরচের ক্ষেত্রে। তা ছাড়াও প্রতিটি নির্বাচনে বিজেপি-কংগ্রেস-তৃণমূল-সিপিএম সহ নানা জাতীয় ও আঞ্চলিক দলের হিসাব-বহির্ভূত উপহার, টাকা, সোনা দিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এগুলি নির্বাচন কমিশনের কাছে দেওয়া হিসাবের বাইরে।
উপরন্তু শাসক দলগুলির হয়ে যারা ভোটে দাঁড়াচ্ছে, তাদের একটা বড় অংশই হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। গত লোকসভায় সাংসদদের গড় সম্পদের পরিমাণ ছিল প্রায় ২১ কোটি টাকা। তার উপর নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী, রাজনৈতিক দলের খরচের ক্ষেত্রে কোনও উর্ধ্বসীমা নেই। ফলে ভোটে যে কোনও প্রকারে জেতার তাড়নায় বেড়েই চলেছে খরচের বহর।
নির্বাচন কমিশনে শাসক রাজনৈতিক দলগুলির জমা দেওয়া তথ্য দেখে অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (এডিআর) আশঙ্কা করেছে, অর্থ সংগ্রহ ও খরচ এবং তার হিসাবে স্বচ্ছতার চূড়ান্ত অভাব রয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, ২০০৪-০৫ থেকে ২০২২-২৩ এই সময়কালে দেশের ৬টি বৃহৎ রাজনৈতিক দল ৬০ শতাংশ– ১৯ হাজার ৮৩ কোটি টাকা অনুদান পেয়েছে গোপন উৎস থেকে। এর মধ্যে নির্বাচনী বন্ডও রয়েছে (পিটিআই-২৬ এপ্রিল)।
পুঁজিপতিদের সেবাদাস এই দলগুলি নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে এবং অন্যান্য উপায়ে তাদের থেকে বিপুল অর্থ সংগ্রহ করে। সেই টাকার একটা অংশ খরচ করে সংবাদমাধ্যম, টিভি, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, সোসাল মিডিয়ার মাধ্যমে ভোটারদের প্রভাবিত করতে, রিগিং ও ছাপ্পা দেওয়ার জন্য এক অংশের যুবককে হাতে রাখতে। আর বড় একটা অংশ খরচ করে ঘোড়া কেনাবেচার মতো সাংসদদের কিনে নিয়ে সরকার গঠন করতে।
এ বারের নির্বাচনে কমিশন নানা বিধিনিষেধের কড়াকড়ির কথা বললেও বেশ কিছু সংবাদপত্রে শাসক দলের বিদ্বেষপূর্ণ, সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক বিজ্ঞাপন প্রতিদিন ছাপতে দেখা গিয়েছে। সমাজে এ সবের সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাবের কথা জেনেও এই সব বিজ্ঞাপন যে বিপুল টাকার বিনিময়ে ছাপা হয়েছে, তা স্পষ্ট। এগুলি অবশ্যই বিধিভঙ্গের মধ্যে পড়ে। তবুও তা নিয়ে নির্বাচন কমিশন টুঁ শব্দটি করেনি।
নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা এবং রাজনৈতিক দলগুলির লাগামছাড়া খরচে বিধিনিষেধ আরোপ না করায় স্পষ্ট হয়, বুর্জোয়া রাষ্টে্র মানুষের ভোট দেওয়ার অধিকারকেই শুধুমাত্র ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাকি অধিকারগুলি ভোট শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ভ্যানিশ হয়ে যায়।