কেন্দ্রীয় তেলমন্ত্রী হরদীপ সিংহ পুরী সম্প্রতি বলেছেন, এখনই না হলেও দু-তিন মাসের মধ্যে পেট্রল-ডিজেলের দাম কমবে। বলেছেন, ক্রেতারা যাতে সমস্যায় না পড়েন, তা দেখা হবে। অর্থাৎ মন্ত্রীর বোধ অনুযায়ী তেলের বিপুল দামে ক্রেতারা এখনও পর্যন্ত কোনও সমস্যায় পড়েনি। অবশ্য জনসাধারণ সম্পর্কে এমন ধারণা না থাকলে তাঁকে আর মন্ত্রী করা হবে কেন! যদিও তিনি দাম কমানোর ক্ষেত্রে অনেক ‘যদি এবং কিন্তু’ রেখেছেন। বলেছেন, যদি অশোধিত তেলের দাম স্থিতিশীল থাকে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থাগুলির আয় যদি আগামী তিন মাসে ভাল হয়, তা হলে তারা তেলের দাম কমানোর কথা ভাবতে পারে। মন্ত্রীকে অবশ্য জনসাধারণের লাভ-লোকসান নিয়ে হিসেব কষতে দেখা যাচ্ছে না। তাঁর কথায়, গত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরে তেলের দাম নাকি বাড়ানো হয়নি। ফলে তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থার প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। সরকার তেল কোম্পানিগুলির লাভের কথা ভাবছে আর সেই লাভের কড়ি জোগাতে জনসাধারণের যে পকেট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই তাঁর। দাম কমানোর আসল ‘গল্প’টা অবশ্য আলাদা। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে মধ্যপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, ছত্তিশগড়, রাজস্থানের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। ফলে সরকার ছিটেফোঁটা যাই কমানোর কথা বলুক, ওই সময়টা বেছে নিয়েছে জনদরদি সাজতে।
বিশ্ববাজারে অশোধিত তেলের দাম কি আজ কমল? গত কয়েক মাস ধরেই তা কমছে। এখন তা ব্যারেল প্রতি ১২০ ডলার থেকে কমে ৭০ ডলারের নিচে চলে গেছে। কিন্তু সারা বিশ্বে তেলের দাম কমলেও ভারত সরকার তা কমতে দেয়নি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আশীর্বাদ হিসাবে দেখা দিয়েছে ভারতীয় তেল কোম্পানিগুলির কাছে। কোম্পানিগুলি বিপুল পরিমাণ লাভবান হয়েছে। যুদ্ধের ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আমেরিকা রাশিয়ার তেলে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। ফলে রাশিয়ার তেলের দাম হু হু করে নামতে শুরু করে। এই অবস্থায় এশিয়ার দেশগুলিতে তেল বিক্রির চেষ্টা করেছে রাশিয়া। সেই সুযোগে ভারতীয় তেল কোম্পানিগুলি অত্যন্ত কম দামে রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল কিনে তা পরিশোধন করে পাওয়া পেট্রল, ডিজেল যেমন ভারতের বাজারে চড়া দামে বিক্রি করেছে, তেমনই ইউরোপ সহ বিশ্বের দেশে দেশে তা বিক্রি করেছে আন্তর্জাতিক দামেই। তেল কোম্পানিগুলি রাশিয়া থেকে ৪০ ডলারের থেকে কম দামে তেল কিনলেও জনসাধারণকে চড়া দামে পেট্রল-ডিজেল কিনতে হচ্ছে। গোটা বিশ্বে রান্নার গ্যাসের দামের নিরিখে ভারত সর্বোচ্চ এবং পেট্রলের দামের নিরিখে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। অথচ সরকারের কোনও হেলদোল নেই।
ইউক্রেন যুদ্ধের আগে রাশিয়া থেকে আমদানি করা তেলের পরিমাণ অতি সামান্য হলেও ২০২৩ অর্থবর্ষে ভারত রাশিয়া থেকে তেল আমদানিতে শীর্ষে রয়েছে। মার্চে ভারত রাশিয়া থেকে ৫১.৫১ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল আমদানি করেছে। বেসরকারি তেল কোম্পানি মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ ২০২৩-এ। কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৮৭.৩ শতাংশ অপরিশোধিত তেল আমদানি করেছে।
তা হলে দেশের বাজারে তেলের দাম এতখানি চড়া কেন? এর কারণ একদিকে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তেল কোম্পানিগুলির জন্য সীমাহীন লুঠের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে, অন্য দিকে প্রধানত কেন্দ্রীয় সরকার, সাথে রাজ্য সরকারগুলিও তেলের উপর চাপানো কর ও সেস কমাচ্ছে না। রিলায়েন্স কোম্পানিকে কেন্দ্রীয় সরকার বিশেষ সুযোগ দিয়েছে রাশিয়ার সস্তা তেল বেশি করে আমদানি করার। রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিকে এই তেল সরকার নিতে দেয়নি। ফলে দামও কমছে না। কোম্পানিগুলির বিপুল লাভের কড়ি জোগাতে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
বেসরকারি কোম্পানিগুলি এবং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি কী বেপরোয়া লুঠ চালাচ্ছে দেখা যাক। সংসদে কেন্দ্রীয় তেল প্রতিমন্ত্রী রামেশ্বর তেলির দেওয়া তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, তেলের শুল্ক থেকে ২০২১-২২ অর্থবর্ষে কেন্দ্রের আয় হয়েছিল ৪.৯২ লক্ষ কোটি টাকা, ২০২০-২১ অর্থবর্ষে ৪.৫৫ লক্ষ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ তে এই আয় ছিল যথাক্রমে ৩.৪৮ লক্ষ কোটি টাকা এবং ৩.৩৪ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ লকডাউনকে কেন্দ্র করে জনজীবন যখন বিপর্যস্ত, যখন মানুষ ভেবে পাচ্ছে না সংসার চালাবে কী করে, তখন ২০১৯-২০-র থেকে পরের বছর এক লাফে অতিরিক্ত ১ লক্ষ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় সরকার জনগণের ঘাড় ভেঙে তুলেছে। পরের বছর তা আরও বেড়েছে।
সরকার তেল কোম্পানিগুলির ক্ষতির কথা বলছে। দেখা যাক তেল কোম্পানিগুলির লাভ হচ্ছে, না ক্ষতি। রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থা অয়েল ইন্ডিয়া ২০২২-এ লাভ করেছিল ৩৮৮৭ কোটি টাকা, ২০২৩-এ লাভ করেছে ৬৮১০.৪০ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। ইন্ডিয়ান অয়েল ২০২৩-এর তৃতীয় ত্রৈমাসিকে লাভ করেছে ৭৭৩.২৩ কোটি টাকা। রিলায়েন্স ২০২২-২৩-এ ৮৭.৩ শতাংশ রাশিয়ান তেল আমদানি করে লাভ করেছে ১৯ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। লাভ করেছে অন্য তেল কোম্পানিগুলিও। আসলে বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা কোম্পানিগুলির লোকসানের গল্প শুনিয়ে দেশের মানুষকে যে বোকা বানাতে চাইছেন, তা এই বিপুল লাভের খতিয়ান থেকে পরিষ্কার। মন্ত্রী মানে যে সরকারের ভেতরে পুঁজিপতিদের এজেন্ট, তা স্পষ্ট নয় কি?
তেল কোম্পানিগুলি বেপরোয়া লুঠ চালাতে পারছে কেন? মন্ত্রীদের সাথে তেল কোম্পানিগুলির দহরম-মহরম এর অন্যতম কারণ। মনমোহন সিংয়ের প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়ে টু-জি কেলেঙ্কারির তদন্তে জানা গিয়েছিল, তৎকালীন টেলিকম মন্ত্রী এ রাজা ছিলেন টাটাদের মনোনীত। বিজেপি শাসনে পূর্বতন তেলমন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান ছিলেন আম্বানিদের মনোনীত। বর্তমান তেলমন্ত্রী হরদীপ পুরী ‘কে কী করে দেখে নেব’ গোছের ভাব করে যেভাবে বলছেন, দুনিয়ার যে কোনও জায়গা থেকে কম দামে ভারত তেল কিনবে– তাতে তিনি যে কোম্পানিগুলিরই ঘরের লোক তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিছুদিন আগে সরকারই জানিয়েছিল তেল কোম্পানিগুলির সাথে বৈঠক করেই সরকার তেল-নীতি ঠিক করেছে। এই তেলমন্ত্রীর উমেদারিতেই অর্থমন্ত্রক গ্যাস উৎপাদনে ‘লোকসান হচ্ছে’ এমন হাস্যকর দাবি মেনে তেল কোম্পানিগুলিকে ২২,০০০ কোটি টাকা পুষিয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ মুখে যা-ই বলা হোক, বাস্তবে এই সরকার শিল্পপতিদের দ্বারা, শিল্পপতিদের জন্য, শিল্পপতিদেরই সরকার। জনগণের স্বার্থের সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্ক নেই।
আর একটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বামনামধারী বা দক্ষিণপন্থী দল যে যেখানে ক্ষমতায় রয়েছে তারা সাধারণ মানুষের ‘দুঃখে’ যত চোখের জল ফেলুক-ই না কেন, কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সাথে সেই রাজ্য সরকারগুলিও তেলের উপর বসানো ট্যা’ থেকে বিপুল আয় করে। ফলে তারা কেউই তেলের দাম কমানোর দাবি তোলে না। একমাত্র এসইউসি আই (সি) লাগাতার ভাবে তেলের দাম কমানোর দাবি করে যাচ্ছে।