Breaking News

বিশ্বজোড়া তীব্র শান্তি আন্দোলনই পারে প্যালেস্তাইনে ইজরায়েলের গণহত্যা রুখতে

প্যালেস্টাইনের রাফায় ইজরায়েলের হানাদারির বিরুদ্ধে এসইউসিআই (সি)-র বিক্ষোভ। তিরুবন্তপুরম, কেরালা। ১৫ মে

রেহাই নেই এমনকি শরণার্থীদেরও। সাম্রাজ্যবাদী ইজরায়েলের বিধ্বংসী বোমাবর্ষণে গত ২৬ মে রাতে পুড়ে ছাই হয়ে গেল রাফার তেল আল সুলতান এলাকার আশ্রয়শিবির। গাজা থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা হতভাগ্য প্যালেস্তিনীয় উদ্বাস্তুদের দেহ দাউ দাউ আগুনে ঝলসে গলে গেল। অস্থায়ী তাঁবুর নিচে ঘুমিয়ে ছিলেন তাঁরা। একটি হিসাবে এই নারকীয় হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৪৫ জন। মৃতের সংখ্যা একশোও হতে পারে। আহত শতাধিক। এ দিকে রাফার হাসপাতালগুলিতে জীবনদায়ী ওষুধ নেই। ডাক্তার-নার্সদের বেশিরভাগই নিহত। অস্তে্রাপচারের জন্য প্রয়োজনীয় অ্যানাস্থেসিয়ার উপকরণও অমিল। এই গণহত্যার যেটুকু ছবি সামনে এসেছে সেখানে দেখা গেছে মৃত শিশুর মুণ্ডহীন দেহ বুকে জড়িয়ে হাহাকার করছেন অসহায় পিতা। ধ্বংসস্তূপে জ্বলতে থাকা ধিকি ধিকি আগুনের মধ্যেই খাবার খুঁজে চলেছে কয়েকটি বাচ্চা ছেলেমেয়ে। গণহত্যাকারী ইজরায়েল রাফায় প্যালেস্তিনীয় উদ্বাস্তুদের উপহার দিয়েছে এমনই এক নরক।

অথচ প্যালেস্তাইনের এই দক্ষিণাংশে হামলা চালাবার কথা ছিল না ইজরায়েলের। আক্রান্ত প্যালেস্তাইনের মানুষকে মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ক্রমাগত দক্ষিণ দিকে চলে যাওয়ার নির্দেশ জারি করেছিল ইজরায়েল। প্রাণ বাঁচাতে দক্ষিণ দিকে ছুটে চলেছিলেন আশ্রয়হীন প্যালেস্তিনীয় পরিবারগুলি। গাজার দক্ষিণতম প্রান্ত মিশর-সীমান্তের রাফায় সারি সারি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন প্রায় ১০ লক্ষ শরণার্থী। মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আগেই এই তেল আল সুলতান এলাকায় আশ্রয়শিবিরে মাথা গুঁজেছেন হাজারেরও বেশি উদ্বাস্তু। বাস্তবে গোটা গাজাতেই নিরাপদ আশ্রয় বলে আজ আর কিছু নেই। রাফার উত্তরে বিধ্বস্ত জনপদ– জল নেই, খাবার নেই, ওষুধ পর্যন্ত নেই। ত্রাণও প্রায় অমিল। আর দক্ষিণে মিশর সীমান্ত, যা নিয়ন্ত্রণ করছে ইজরায়েলি বাহিনী।

বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদের শিরোমণি আমেরিকার দোসর ইজরায়েল গত ৭ মাস ধরে প্যালেস্টাইনের গাজায় নির্মম হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে নিহত প্রায় সাড়ে ৩৬ হাজার মানুষ, যার একটা বড় অংশ শিশু। আহত প্রায় ৮৩ হাজার। বিধ্বংসী বোমায় গোটা গাজা আজ ধ্বংসস্তূপ। এই গণহত্যায় অস্ত্র ও অর্থ জুগিয়ে মদত দিয়ে চলেছে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা। সঙ্গে রয়েছে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি।

গোটা বিশ্বের শান্তিপ্রিয় গণতান্ত্রিক চেতনার মানুষ আজ প্যালেস্তাইনে গণহত্যার জন্য দায়ী সাম্রাজ্যবাদী ইজরায়েলের শাসকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছে। অবিলম্বে প্যালেস্তাইনে ইজরায়েলি হানাদারি বন্ধের দাবিতে প্রতিদিন দেশে দেশে বিক্ষোভ মিছিলে সামিল হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডা, মেক্সিকো এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা কর্তৃপক্ষের আপত্তি ও পুলিশি হামলা উপেক্ষা করে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। বিক্ষোভ হচ্ছে ইটালি, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, জাপান, অস্টে্রলিয়ার মতো দেশে। এমনকি খোদ ইজরায়েলেও ইহুদি ধর্মের শান্তিপ্রিয় মানুষ সোচ্চারে স্লোগান তুলছেন, আমাদের রক্ষার অজুহাতে প্যালেস্তাইনের আরবদের উপর এই বর্বরতা বন্ধ হোক। ভারতের জনসাধারণ ও ছাত্ররাও ইজরায়েলি শাসকদের নির্মম বর্বরতার বিরোধিতা করছেন, দেখাচ্ছেন বিক্ষোভ।

এই অবস্থায় বিশ্ব রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়ার আশঙ্কায় ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু রাফায় হামলার পরে তড়িঘড়ি দুঃখ প্রকাশ করেছেন। দেশের সংসদে বিবৃতি দিয়ে তিনি এই বোমাবর্ষণকে ‘দুঃখজনক ভুল’ বলে অভিহিত করেছেন। এর আগে বহুবার সাম্রাজ্যবাদী ইজরায়েলের সেনাবাহিনীকে দিয়ে শরণার্থী শিবির, স্কুল, হাসপাতাল ও নাগরিকদের বসতির উপর বোমাবর্ষণ করিয়েছে নেতানিয়াহুর সেনাবাহিনী। এমনকি বিধ্বস্ত গাজায় রাষ্ট্রসংঘের তৈরি করা নানা শিবির এমনকি অ্যাম্বুলেন্সও বাদ যায়নি তাদের হামলা থেকে। ফলে রাফায় বোমাবর্ষণ নিয়ে ইজরায়েলের শাসকদের এই দুঃখপ্রকাশ যে কুমীরের কান্না তা বলে দেওয়ার দরকার পড়ে না।

নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে যাওয়ার এই স্পর্ধা ইজরায়েলের শাসকরা দেখাতে সাহস করত না, যদি না আমেরিকা সহ ইউরোপের পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি থেকে রাজনৈতিক মদত এবং বিপুল পরিমাণে অস্তে্রর সরবরাহ না পেত। বিপুল মন্দার ধাক্কা সামলে দেশের অর্থনীতিকে চলমান রাখতে আমেরিকা সহ সমস্ত পুঁজিবাদী দেশগুলিরই আজ অর্থনীতির সামরিকীকরণ করা ছাড়া পথ নেই। ইজরায়েলের কাছে দেদার অস্ত্র বিক্রি করে রাষ্টে্রর অর্থভাণ্ডার ভরিয়ে তুলছে তারা। এ ছাড়াও সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীদের কাছে ইজরায়েলের সামরিক কৌশলগত অবস্থানজনিত সুবিধার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদী দস্যুবৃত্তি চালানোর জন্য ইজরায়েল তাদের ঘাঁটি। তাই প্যালেস্তিনীয়দের দুর্দশায় মুখে দুঃখপ্রকাশ করতে করতেই তারা ইজরায়েলের সঙ্গে অস্ত্র ব্যবসার হরেক চুক্তি করে চলেছে।

কিন্তু বিশ্ব জুড়ে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভের স্রোত যে ভাবে শহরে নগরে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরগুলিতে আছড়ে পড়ছে তাতে ভয় পেয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্টে্রর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইজরায়েলকে যুদ্ধ বন্ধ করার আবেদন জানিয়েছেন। তিন দফা প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। প্রথম দফায় অবিলম্বে ৬ সপ্তাহের জন্য যুদ্ধবিরতির আবেদন করেছেন বাইডেন। দেশের অভ্যন্তরীণ জোট রাজনীতির কারণে হামলা বন্ধে সমস্যা থাকা সত্ত্বেও জানা গেছে, ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী প্রথম দফার পরামর্শটি মেনে নিতে চলেছেন।

ইজরায়েলের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বাণিজ্যিক-রাজনৈতিক সম্পর্ক থাকা সত্তে্বও স্পেন, নরওয়ে ও আয়ারল্যান্ডের মতো দেশ এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যেও প্যালেস্তাইনকে রাষ্টে্রর স্বীকৃতি দিয়েছে। তারা রাফা-হামলার তীব্র নিন্দাও করেছে। ইজরায়েলকে দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্র জোগান দিয়ে চলা ফ্রান্সও রাফায় শরণার্থীদের উপর এই নৃশংস হামলার তীব্র নিন্দা করেছে। বাস্তবে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে দেশে দেশে গণরোষ সামাল দিতে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলিকে আজ মুখে হলেও শান্তির কথা বলতে হচ্ছে।

গোটা বিশ্বের মানুষ যখন ইজরায়েলের বর্বরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার, সেই সময়ে ভারতের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার দীর্ঘ ঐতিহ্যকে পায়ে মাড়িয়ে নরেন্দ্র মোদি সরকার ইজরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে চলেছে। দেদার অস্ত্র সরবরাহ করে চলেছে ইজরায়েলকে। চূড়ান্ত বেকার সমস্যার সুযোগ নিয়ে দলে দলে কর্মহীন যুবককে কাজ দেওয়ার নাম করে কামানের খাদ্য বানাতে পাঠাচ্ছে ইজরায়েলে। এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে ভারতের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। ছাত্র-যুব-মহিলা সহ এ দেশের সর্বস্তরের শান্তিপ্রিয় মানুষ দীর্ঘদিন ধরে প্যালেস্টাইনে ইজরায়েলের হানাদারির প্রতিবাদ জানিয়েছে। এই অবস্থায় দেশের মানুষের প্রতিবাদী মেজাজকে রেয়াত করতে বাধ্য হতে হয়েছে এমনকি নরেন্দ্র মোদির দক্ষিণপন্থী বিজেপি সরকারকেও। বিদায়ী মোদি সরকারের বিদেশ মন্ত্রককেও রাফায় হামলার ঘটনায় ‘তীব্র উদ্বেগ’ প্রকাশ করতে হয়েছে।

ফলে এ কথাই আবার প্রমাণিত হল যে, অত্যাচারী শাসক বোঝে শুধু প্রতিবাদের ভাষা। তাই নিরীহ প্যালেস্তিনীয় আরবদের উপর ইজরায়েলের উগ্র ইহুদিবাদী শাসকদের এই নির্মম অত্যাচার বন্ধে অবিলম্বে বিশ্ব জুড়ে দেশে দেশে গড়ে তুলতে হবে যুদ্ধবিরোধী গণপ্রতিরোধ। প্রতিটি দেশের গণতান্ত্রিক চেতনা ও শুভবুদ্ধির দ্বারা চালিত খেটে-খাওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণকে সঠিক নেতৃত্বে সংগঠিত করে সাম্রাজ্যবাদী জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের শক্তিকে আরও জোরদার করতে হবে। দিকে দিকে গড়ে তুলতে হবে সংগ্রামী শান্তি-আন্দোলন। তবেই রোখা যাবে এই মর্মান্তিক মৃত্যুর মিছিল। স্বজন-সন্তানহারা অসহায় মানুষের কান্নায় আর ভিজে উঠবে না অত্যাচারিত দেশের আকাশ-বাতাস।