জালে ঘেরা বড় খাঁচা৷ ভেতরে দাঁড়িয়ে বসে বেশকিছু শিশু–কিশোর৷ সেনারা কঠিন মুখে বন্দুক হাতে ঘোরাফেরা করছে খাঁচার ভেতরে বাইরে৷ বাচ্চাদের সাবধান করে দিচ্ছে তারা– কেউ যেন সাংবাদিকদের কাছে মুখ না খোলে৷ সম্পূর্ণ অচেনা এই পরিবেশে মা–বাবাকে আকুল হয়ে খুঁজছে বাচ্চারা৷ চোখের জলে মুখ ভেসে যাচ্ছে৷ ওই বন্দি শিবিরের এক কর্মী স্থির থাকতে পারেননি৷ কর্তৃপক্ষের নিষেধ অগ্রাহ্য করে একটি বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরে জানতে চেয়েছিলেন তার কোনও কষ্ট হচ্ছে কি না৷ উত্তরে সে তার নিজের ভাষায় শুধু ‘মা’ ‘মা’ বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে৷ সহ্য করতে পারেননি ওই কর্মী৷ ইস্তফা দিয়েছেন কাজে৷
এই হল মেক্সিকো সীমান্তে আমেরিকার একটি ‘ডিটেনশন সেন্টার’–এর ছবি৷ দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ভিটেমাটি ছেড়ে কোনও মতে প্রাণ হাতে নিয়ে জীবনের খোঁজে ধেয়ে আসা লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে কড়া হাতে রুখতে চান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প৷ উদ্বাস্তুদের শিক্ষা দিতে তাই নোটিস জারি করেছেন তিনি– বাবা–মায়েদের কাছ থেকে বাচ্চাগুলোকে ছিনিয়ে নাও৷ আলাদা করে নিয়ে ওদের ভরে দাও ডিটেনশন সেন্টারে৷ তাহলেই জব্দ হবে ‘জানোয়ারগুলো’৷ হ্যাঁ, না খেতে পেয়ে অবধারিত মৃত্যু, কিংবা দাঙ্গা–হাঙ্গামার হাত এড়িয়ে বাঁচার আশায় ছুটে আসা আশ্রয়প্রার্থী মানুষগুলো ট্রাম্পের কাছে অমানুষ, জানোয়ার ছাড়া আর কিছু নন৷ তাই তাঁদের সন্তান হারানোর অসহ্য যন্ত্রণায় বিকার নেই ট্রাম্পের৷ তাই আজ মার্কিন ডিটেনশন সেন্টারগুলো জুড়ে পাক খেয়ে চলেছে আতঙ্কগ্রস্ত শিশুদের নিরুপায় কান্না৷
পৃথিবীর আর এক প্রান্তে অতলান্তিক মহাসাগরের ওপারেও একই অমানবিকতার ছবি৷ সেখানে আলজিরিয়া থেকে মাঝে মাঝেই সেনারা ট্রাকভর্তি শরণার্থীদের নামিয়ে দিয়ে চলে যায় সাহারা মরুভূমির বুকে৷ চূড়ান্ত গরিবি আর দাঙ্গা–হাঙ্গামায় দীর্ণ পশ্চিম আফ্রিকার মালি, গাম্বিয়া, গিনি, আইভরি কোস্ট, নাইজার ইত্যাদি দেশগুলো থেকে এই শরণার্থীরা দলে দলে চলে আসছেন উত্তর দিকের আলজিরিয়া, টিউনিশিয়া ইত্যাদি দেশে৷ ভূমধ্যসাগর পার হয়ে কোনওক্রমে ইউরোপের কোনও দেশে ঢুকে পড়াটা তাঁদের লক্ষ্য৷ তাহলেই হয়ত রুটি–রুজির একটা কিছু ব্যবস্থা হবে৷ পাশ কাটানো যাবে অবধারিত মৃত্যুকে৷ বাঁচিয়ে রাখা যাবে প্রাণের চেয়ে প্রিয় সন্তানদের৷
কিন্তু এ বোঝা মাথায় নিতে রাজি নয় ইউরোপ৷ আলজিরিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করে তারা বলেছে, আলজিরিয়া যেন দেশ থেকে দূর করে দেয় উদ্বাস্তুদের৷ তাই এই ৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ছুঁইছুঁই শরীর ঝলসে দেওয়া প্রচণ্ড গরমে সাহারা মরুভূমির গলন্ত বালির ওপরে সেনাদের বন্দুকের মুখে অনির্দিষ্ট পথ ধরে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছেন দলে দলে শরণার্থী৷ কে নেই সেই দলে শিশু, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ, এমনকী সন্তানসম্ভবা নারীরা পর্যন্ত৷ ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইএমও)–এর হিসাবে গত ১৪ মাসে এই শরণার্থীদের সংখ্যা ১৩ হাজারেরও বেশি৷ ভয়ঙ্কর তাপে নির্মম সাহারার বুকে জলহীন, খাদ্যহীন এই অমানুষিক সফর প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে অসংখ্য মানুষের৷ আইএমও–রই একটি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ২০ হাজার৷
শুধু ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকা নয়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি থেকেও গত কয়েক বছর ধরে ঘর–বাড়ি ছেড়ে আসা লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর স্রোত আছড়ে পড়ছে আমেরিকা ও ইউরোপের ধনী দেশগুলোর সীমান্তে৷ সমস্ত রকম ঝুঁকি উপেক্ষা করে প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে আসতে গিয়ে অকালে ঝরে যাচ্ছে অসংখ্য প্রাণ৷ ২০১৫–য় তুরস্কের সমুদ্রতটে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা তিন বছরের আয়লান কুর্দির মৃতদেহের ছবি নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা বিশ্বের মানুষকে৷ সিরিয়া থেকে বাবা–মায়ের সঙ্গে ভূমধ্যসাগর পার হয়ে পালিয়ে আসছিল সে৷ পথে নৌকাডুবিতে মারা যায়৷ সমুদ্র ফিরিয়ে দিয়েছিল সেই লাল জামা পরা ছোট্ট মৃতদেহটি, যেটি শরণার্থীদের ভয়াবহ অসহায়তার প্রতীকে পরিণত হয়েছে৷
কেন এত মানুষ নিজের চির পরিচিত বাসভূমি, জীবিকা কিংবা নিজের ভাষাভাষী লোকজনকে ছেড়ে পাড়ি দিচ্ছে ভয়ঙ্কর ঝুঁকিবহুল পথে? কারণ, এছাড়া বেঁচে থাকার উপায় নেই তাদের৷ নিজের স্যাঙাতদের নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেদিন থেকে তার কুখ্যাত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’–এর নামে দেশে দেশে সশস্ত্র হানাদারি শুরু করেছে, সেদিন থেকে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে আক্রান্ত দেশের মানুষের স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ জীবনযাত্রা৷ আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, সোমালিয়া, মালি, সুদান ইত্যাদি দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ছারখার করে দিয়েছে মার্কিন ও পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদ৷ তথ্য বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যত মানুষ আশ্রয়হীন হয়েছিলেন, এই সময়ে সৃষ্টি হওয়া শরণার্থীর সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি৷
আফগানিস্তানের কথাই ধরা যাক৷ ’৮০–র দশকে সেখানে একটি জনপ্রিয় সরকার ছিল ক্ষমতায়৷ সেই সরকারের আমলে খেটে খাওয়া মানুষের আন্দোলন করার অধিকার ছিল, ন্যূনতম মজুরির হারও ছিল সরকার নির্ধারিত৷ পড়াশোনার সুযোগ ছিল দেশের সমস্ত ছেলেমেয়ের৷ এমনকী মেয়েরাও প্রাচীন প্রথা ও গোঁড়া ধর্মীয় সংস্কৃতির শিকল ভেঙে অনেকটাই এগিয়ে আসতে পেরেছিল৷ স্বাধীনভাবে নিজের জীবিকা খুঁজে নেওয়ার সুযোগ ও শিক্ষা ছিল তাদের৷ খোদ মার্কিন প্রতিরক্ষা সংস্থা ‘পেন্টাগন’ও তার রিপোর্টে এমনকী আফগান মহিলাদের এই স্বাধীন জীবনের কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে৷
তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনপুষ্ট এ হেন প্রগতিশীল আফগান সরকারকে উৎখাত করতে তৎপর হয়ে ওঠে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ৷ দেশজুড়ে নৈরাজ্য তৈরির লক্ষ্যে তারা সেখানকার সামন্তী জমিদার ও মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলিকে উস্কানি ও প্রচুর পরিমাণে মারণাস্ত্র দিয়ে নানা ভাবে সক্রিয় করতে থাকে৷ এই শক্তিগুলি থেকেই ধীরে ধীরে জন্ম নেয় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অর্থ ও অস্ত্রে পুষ্ট আল–কায়েদা ও তালিবানের মতো মৌলবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী৷ এই আল–কায়েদা ও তালিবানরাই মার্কিন মদতে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার দখল নেয়৷ এরপর ২০০১–এর ১১ সেপ্ঢেম্বর আমেরিকা তার নিজের দেশের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের দায় নিজেরই তৈরি করা আল–কায়েদার ওপর চাপিয়ে তাদের পর্যুদস্ত করার নামে হানাদারি শুরু করে আফগানিস্তানে৷ সাম্রাজ্যবাদী হানাদারদের সেই নির্মম আক্রমণে ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রাচীন সভ্যতার দেশ আফগানিস্তান আজ একটা ধ্বংসস্তূপ ছাড়া কিছু নয়৷ সেখানকার মানুষ আজ দারিদ্রের শেষ সীমায় পৌঁছে চরম আতঙ্কের জীবন কাটাচ্ছে৷ দলে দলে ঘর ছেড়ে শরণার্থীর অমানবিক জীবন বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে৷
মধ্যপ্রাচ্যের আরেকটি দেশ ইরাক৷ আর পাঁচটা পুঁজিবাদী দেশের মতো জনজীবনে নানা সমস্যা থাকলেও প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেনের শাসনে ইরাকেও মৌলবাদীদের দাপট চাপা পড়ে গিয়েছিল৷ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মেয়েদের স্বাধীন জীবন বেছে নেওয়ার সুযোগের নিরিখে ইরাক ছিল অনেকটাই সামনের সারিতে৷ সাদ্দাম হুসেন ‘গণবিধ্বংসী অস্ত্র’ মজুত করেছেন– এই অজুহাত তুলে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে মধ্যপ্রাচ্যের অঢেল খনিজ তেল কব্জা করা ও ওই অঞ্চলে নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করার মতলবে ব্রিটেন, ফ্রান্সের মতো সাম্রাজ্যবাদী স্যাঙাতদের সঙ্গে নিয়ে ২০০৩ সাল থেকে এ দেশের বুকে তাণ্ডব চালাতে শুরু করে আমেরিকা৷ আজ আফগানিস্তানের মতো ইরাকও একটা ধ্বংসস্তূপ৷ অসংখ্য মৃত, আহতের সংখ্যা আরও বেশি৷ যাঁরা জীবিত, জীবনগুলোকে একটু গুছিয়ে নেওয়ার ক্ষীণ আশা নিয়ে দেশান্তরী হতে হচ্ছে তাঁদের৷
ধরা যাক আফ্রিকার দেশ লিবিয়ার কথা৷ ২০১১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির যুদ্ধজোট ‘ন্যাটো’ হানাদারি চালানোর আগে পর্যন্ত এই মহাদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশ ছিল লিবিয়া৷ সুস্থিতিপূর্ণ এই দেশটিতে জীবনযাত্রার মান ছিল যথেষ্ট উঁচু৷ প্রতিটি নাগরিকের জন্য বাড়ি, সকলের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করেছিল প্রেসিডেন্ট গদ্দাফির সরকার৷ শুধু তাই নয়, আফ্রিকার ওপর আমেরিকা সহ ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির অবাধ লুটপাটের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল যে ‘আফ্রিকান ইউনিয়ন’, প্রেসিডেন্ট গদ্দাফি ছিলেন তার একজন প্রধান নেতা৷ আফ্রিকার দেশে দেশে নানা কৌশলে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ বাধিয়ে দিয়ে, সেই সংঘর্ষ দমনের নামে আফ্রিকারই অনুগত কয়েকটি দেশের সাহায্য নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা সেখানে তৈরি করেছে ‘আফ্রিকম’৷ এর মাধ্যমে নানা প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ আফ্রিকা অবাধ লুটপাট সহজ করতে ওই মহাদেশে সেনা মোতায়েন করেছে আমেরিকা৷ এই আফ্রিকমের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ–প্রতিরোধের অন্যতম বলিষ্ঠ মুখ ছিলেন প্রেসিডেন্ট গদ্দাফি৷ দারিদ্র্যে জর্জরিত আফ্রিকার দেশগুলিকে ঋণ দিয়ে দিয়ে তাদের ঋণের ফাঁদে বেঁধে ফেলেছে ফ্রান্সের মতো ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি৷ তা থেকে মুক্তি পেতে গদ্দাফির নেতৃত্বেই চেষ্টা চলছিল গোটা আফ্রিকা মহাদেশের একটি কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ও নিজস্ব মুদ্রা তৈরি করার৷
সাম্রাজ্যবাদী শোষণের এত বড় অন্তরায়কে টিকতে দেবে কেন আমেরিকা তাই দেশের মধ্যে জমে ওঠা পুঁজিবাদী শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের স্বাভাবিক ক্ষোভ–বিক্ষোভকে উস্কানি দিয়ে, তাদের নানা ভাবে খেপিয়ে তুলে দেশের মধ্যে অস্থিরতা তৈরির পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট গদ্দাফিকে ‘স্বৈরাচারী’ তকমা দিল আমেরিকা৷ তারপর সেই তথাকথিত ‘স্বৈরাচারী’ শাসকের হাত থেকে লিবিয়ার জনগণের গণতন্ত্র রক্ষা করার ‘মহান ব্রত’ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মার্কিন সেনাবাহিনী৷ একের পর এক বিমান হানায় গুঁড়িয়ে গেল লিবিয়া৷ অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হল, আহত হল আরও বেশি৷ প্রেসিডেন্ট গদ্দাফিকে নৃশংসভাবে খুন করল ন্যাটোর গুণ্ডাবাহিনী৷ এই সুযোগে আজ সে দেশজুড়ে মাথা চাড়া দিয়েছে আল–কায়েদা, ইসলামিক মাঘরেবের মতো একটার পর একটা মৌলবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী৷ লিবিয়া আজ ফিরে গিয়েছে যেন প্রাক–সভ্যতা যুগে৷
একা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নয়৷ গোটা আফ্রিকাকে শকুনের মতো ছিঁড়েখুঁড়ে শেষ করে দিচ্ছে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিও৷ সোনা, প্ল্যাটিনাম, হিরে, ইউরেনিয়াম, কোল্টান, তামা, খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, দামি কাঠ, কোকো, কফির মতো কৃষিপণ্য সহ অসংখ্য প্রাকৃতিক সম্পদে ভরে আছে আফ্রিকা মহাদেশের মাটি৷ একসময় ফ্রান্স, ব্রিটেন ইত্যাদি দেশ আফ্রিকায় উপনিবেশ তৈরি করে অবাধে লুঠ করেছে ওই সম্পদ৷ আজ ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি নয়া কৌশলে লুঠের ধারা বজায় রেখেছে৷ এরা সাহারা মরুর দক্ষিণের ৩৭টি দেশ থেকে প্রতি বছর ১ লক্ষ কোটি ডলারেরও বেশি মূল্যের খনিজ সম্পদ লুট করে নিয়ে যায়৷ আর এই লুটপাট অব্যাহত রাখতে, অবাধে চালাতে সাম্রাজ্যবাদীরা আফ্রিকার দেশে দেশে জাতিদাঙ্গা, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বগুলোকে মদত দিয়ে জিইয়ে রাখে৷ যাতে সেসব দমনের অজুহাতে সহজেই হাজির করা যায় সাম্রাজ্যবাদী সেনাদলকে৷ এবং এই অমানুষিক শোষণ–লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে চরম গরিবি ও দাঙ্গা–হাঙ্গামায় জর্জরিত আফ্রিকা মহাদেশের হতভাগ্য মানুষগুলির সমস্ত প্রতিবাদ–প্রতিরোধক গুঁড়িয়ে দেওয়া যায় সেনাবাহিনীর বোমা আর বুলেট দিয়ে৷
লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গদ্দাফি সাম্রাজ্যবাদী হানাদারদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, লিবিয়া ধ্বংস হলে আফ্রিকার দেশগুলি থেকে শরণার্থীর ঢল আছড়ে পড়বে ইউরোপের দেশগুলিতে৷ কারণ, আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলির ভুখা মানুষ ও ইউরোপের ধনী সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মধ্যে লিবিয়ার মতো সমৃদ্ধ দেশ খানিকটা দেওয়ালের মতো কাজ করত৷ সেই দেওয়াল গুঁড়িয়ে দিয়েছে সাম্রাজ্যবাদীরা৷ ফলে একদিকে সাম্রাজ্যবাদী হানাদারিতে দীর্ণ মধ্যপ্রাচ্য, অন্যদিকে আফ্রিকার দেশগুলি থেকে জীবন খুঁজতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়া অগণন শরণার্থী আজ একটু খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য মাথা কুটছে সেই আমেরিকা ও ইউরোপেরই দেশে দেশে৷
মেক্সিকোর মতো ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলি থেকেও বন্যার জলের মতো শরণার্থী মানুষের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার মূলেও রয়েছে সাম্রাজ্যবাদ৷ তাদের সঙ্গে আমেরিকা ও কানাডার মতো সাম্রাজ্যবাদী দেশের করা ‘নাফটা’ চুক্তির ফলে মেক্সিকোর কৃষিপণ্যের বাজার আজ পুরোপুরি ওই দুই দেশ থেকে রপ্তানি করা কৃষিজাত দ্রব্যের কবলে৷ ফলে সেখানকার লক্ষ লক্ষ চাষি ও কৃষি–মজুর আজ বেকার৷ পাশাপাশি আজ মেক্সিকোর বহু কল–কারখানার মালিক হয়ে বসে রয়েছে আমেরিকার পুঁজিপতিরা৷ কোনওরকম শ্রম–আইনের তোয়াক্কা না করে নিতান্ত অল্প মজুরিতে সেখানে তারা খাটিয়ে নেয় শ্রমিকদের৷ এই অবস্থায় মেক্সিকোর জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি চলে গেছে চরম দারিদ্রের কবলে৷ বাঁচার রাস্তা খুঁজে না পেয়ে দলে দলে মানুষ শিশু সন্তানদের কোলে কাঁখে নিয়ে ছুটে চলেছে সীমান্তের দিকে৷ কোনওরকমে একবার আমেরিকায় ঢুকে যেতে পারলে হয়ত জুটবে পেটের দু–মুঠো ভাত৷ স্বজন–বান্ধব হারিয়ে, চিরচেনা পরিবেশ ছেড়ে যেতে হলেও তারা মরিয়া হয়ে আশ্রয় খুঁজে চলেছে৷ জীবন যে বড় দামি!
কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী বর্বরদের কাছে কর্পোরেট পুঁজির পেটমোটা মালিকরা ছাড়া আর কারও জীবনের কোনও মূল্য নেই৷ এই পুঁজিমালিকদেরই স্বার্থরক্ষায় সর্বশক্তি নিয়োজিত তাদেরই রাজনৈতিক ম্যানেজার মার্কিন প্রেসিডেন্টকুলের৷ তাই সেই ১৯৯৪ সালে নাফটা চুক্তি কার্যকর হওয়ার সময় প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টনের আমলে শরণার্থীদের রুখতে মেক্সিকো সীমান্তে যে বিশাল প্রাচীর তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল, তা বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্পূর্ণ করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছেন৷ পাশাপাশি আশ্রয়প্রার্থীদের প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি নিয়ে বর্বর এই প্রেসিডেন্ট চরম অমানবিকতার পরিচয় দিয়ে দুধের শিশুদের আলাদা করে দিচ্ছেন মা–বাবার কাছ থেকে৷
এই সাম্রাজ্যবাদী শয়তানদের আগ্রাসী লোভ আর বর্বর মুনাফা লুটের বলি শরণার্থীরা নিরুপায় হয়ে আজ বেঁচে থাকার জন্য মাথা খুঁড়ছে সাম্রাজ্যবাদীদেরই পায়ে৷ বিনিময়ে সন্তান হারানো মা–বাবাকে একবুক হাহাকার নিয়ে ছেড়ে যাওয়া রিক্ত স্বদেশে ফিরে আসতে হচ্ছে৷ আমেরিকার ডিটেনশন সেন্টারগুলো ভরে রয়েছে মা–বাবাকে দেখতে না পেয়ে অস্থির হয়ে ওঠা শিশুদের আকুল কান্নায়৷ অন্যদিকে আফ্রিকার ধু ধু মরুর উত্তাপে গলে যাওয়া বালির ওপর দিয়ে অন্তহীন যাত্রায় চলেছে শিশু, বৃদ্ধ, পুরুষ, নারী৷ পিছিয়ে পড়ে প্রাণপণ চেষ্টায় তাদের নাগাল পেতে টলতে টলতে হাঁটছে সদ্যপ্রসূতি মা, জন্মরক্ত গড়িয়ে পড়ছে তার দু’পা বেয়ে– নিজের হাতে একটু আগে সে বালিচাপা দিয়েছে তার মৃত সদ্যোজাতকে৷ বাঁচার তাগিদে চলতে থাকবে তাদের এই যাত্রা যতক্ষণ না মরুভূমির আগ্রাসী উত্তাপ শুষে নিচ্ছে তাদের সবটুকু প্রাণশক্তি৷
সভ্যতার ঘৃণ্যতম শত্রু সাম্রাজ্যবাদ আজ এমনি করেই বিশ্বের সাধারণ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে, জীবিতদের জন্য বরাদ্দ করছে অসহনীয় জীবনযন্ত্রণা৷ লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ মানুষের এমন তছনছ হয়ে যাওয়া অমানুষের জীবন যদি আমাদের একটুও কাঁদায়, ভাবায়, তাহলে সর্বশক্তি নিয়োগ করে গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধ৷ গোটা দুনিয়া জুড়ে সংগঠিত করতে হবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তিশালী জঙ্গি আন্দোলন৷ আশার কথা, সাম্রাজ্যবাদের মুখ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বর্বরতার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই দুনিয়া জুড়ে বিক্ষোভ সংঘটিত হচ্ছে৷ খোদ আমেরিকায় অসংখ্য মানুষ প্রখর রোদ অগ্রাহ্য করে নিজের শিশু সন্তানদের নিয়ে সামিল হচ্ছেন এই বর্বর প্রেসিডেন্টের নির্মম শরণার্থী–নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিলে৷ গোটা বিশ্বের মানুষ প্রবল ধিক্কার জানাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের এই শিশুঘাতী, নারীঘাতী, কুৎসিত বীভৎসতার বিরুদ্ধে।
(৭০ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা ১৩ জুলাই, ২০১৮)