মোদি-শাসনে বিশ্বের চোখে ভারতের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে ব্যাপক ঢাক পেটাতে দেখা যায় বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের। তাঁরা জোর গলায় প্রচার করেন, দেশকে ‘বিশ্বগুরু’ বানাতে দায়বদ্ধ প্রধানমন্ত্রী সেই লক্ষ্যে অনলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। নরেন্দ্র মোদি অন্য দেশের কোনও রাষ্ট্র নেতাকে সামনে পেলেই জড়িয়ে ধরে ছবি তোলার পোজ দেন। দুই দেশের শাসকের কূটনৈতিক বন্ধুত্বও হয়ত হয়। কিন্তু শাসক আর জনগণ এক নয়! বিশ্বের জনগণের চোখে কোথায় দাঁড়িয়ে ভারত? দেখা যাচ্ছে, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিশ্বের দেশে দেশে মানুষের চোখে ভারতের মর্যাদা ক্রমাগত কমছে।
গত ৭ মে প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘গ্লোবস্ক্যান’-এর একটি সমীক্ষা রিপোর্ট। আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মানুষের মধ্যে ২৯ মার্চ থেকে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত সমীক্ষাটি চালানো হয়। সমীক্ষার ভিত্তিতে এই রিপোর্ট তৈরি করেছেন নেদারল্যান্ডসের গ্রনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের শিক্ষাবিদরা। তাঁদের সঙ্গে কাজ করেছে ‘ফ্রেন্ডস অফ ডেমোক্র্যাসি’ সংস্থাটিও। তাঁরা সমীক্ষাটির নাম দিয়েছেন ‘মোদি মরীচিকা’। নামটি যে যথার্থ, ভারতকে ‘বিশ্বগুরু’ বানানোর মোদি-ঘোষিত প্রতিশ্রুতি যে আসলে মরীচিকাই, রিপোর্টের লাইনে লাইনে তা স্পষ্ট।
রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষই মনে করেন, ভারতে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের হাল যথেষ্ট খারাপ। সমীক্ষা করা হয়েছে যাঁদের, তাঁদের প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজনই ভারতে সিএএ তথা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনটি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, এই আইনের ফলে মুসলমান ধর্মের মানুষের পক্ষে ভারতের নাগরিক হওয়া কঠিন হবে। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ব্রিটেনে মোদির সমর্থনে কথা বলেছেন মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ। আমেরিকায় এই হার মাত্র ২২ শতাংশ। আবার দেখা যাচ্ছে, আমেরিকার তরুণদের মধ্যে মোদির পক্ষে রয়েছেন আরও কম মানুষ– মাত্র ৯ শতাংশ।
অন্য একটি সংস্থা ‘ইউগভ’-এর করা গত মার্চ মাসের একটি সমীক্ষা দেখাচ্ছে, আমেরিকা ও ব্রিটেনের নাগরিকদের কাছে নরেন্দ্র মোদি জনপ্রিয় তো ননই, এমনকি সুপরিচিতও নন। আমেরিকার প্রখ্যাত ‘পিউ রিসার্চ’-এর গত বছর সেপ্টেম্বরের রিপোর্টেও দেখা গেছে, সে দেশের ৪০ শতাংশ লোকই নরেন্দ্র মোদির নাম শোনেননি। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী নরেন্দ্র মোদির শাসনকালে ৬১ শতাংশ ফরাসি নাগরিকই ভারত সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করেন না।
তা হলে নরেন্দ্র মোদি বিশ্বের দরবারে ভারতের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন বলে প্রচারের এই বিপুল ঢেউয়ের উৎস কী? ‘মোদি মরিচীকা’ নামের সমীক্ষা রিপোর্ট এ প্রসঙ্গে চমকে ওঠার মতো মন্তব্য করেছে। তারা বলেছে, চাপ দিয়ে সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা, অর্থাৎ মোদি-বিরোধী সংবাদ প্রকাশ করতে না দেওয়া এবং সমাজমাধ্যমে ঢালাও অসত্য প্রচার– এই দুই পথেই নাটকীয় ভাবে ‘বিশ্বগুরু’র ঢাক পিটিয়েছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ও তার প্রশাসন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রচারের সেই ঢাক যে ফেটে গেছে, সমীক্ষা-রিপোর্টেই তা স্পষ্ট।
শুধু পশ্চিমী দেশগুলিতেই নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতেও ভারতের প্রভাব ও জনপ্রিয়তা কমছে। ‘আসিয়ান’ (অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস)-এর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলিতে সমীক্ষা চালিয়ে সিঙ্গাপুরের ‘দ্য স্টেট অফ সাউথইস্ট এশিয়া’-র ২০২৪-এর গত এপ্রিলের রিপোর্ট বলছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তি মনে করেন মতামত দাতার মাত্র ০.৬ শতাংশ। সমীক্ষা করা হয়েছে যাঁদের উপর, তাঁদের মাত্র ০.৪ শতাংশের মতে মোদি সরকার এই অঞ্চলে রাজনৈতিক ও কৌশলগত প্রভাবের ক্ষেত্রে সেরা। নিরাপত্তা, প্রশাসন, সমৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক শান্তির ক্ষেত্রে মোদি সরকারের উপর আস্থা প্রকাশ করেছেন মাত্র ১.৫ শতাংশ মানুষ। অথচ কেন্দ্রে ক্ষমতায় বসে পুরনো ‘লুক ইস্ট’ নীতির নাম পাল্টে ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি গ্রহণ করে নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছিলেন যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই অঞ্চলটি তাঁর সরকারের শীর্ষ অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে। বেশি দিন নয়, গত বছরেও জাকার্তায় দক্ষিণ-পূর্বের এই দেশগুলির শীর্ষ সম্মেলনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন যে, ভারতের প্রতিবেশী নীতির মূল স্তম্ভই হল ‘আসিয়ান’। বলেছিলেন, এই অঞ্চলটিই এখন ভারতের সবচেয়ে বেশি মনোযোগের কেন্দ্র। এ দিকে সমীক্ষার রিপোর্ট স্পষ্টই জানিয়ে দিচ্ছে যে, ‘বিশ্বগুরু’র দাবি-দাওয়ার পুরোটাই আসলে মোদিজির শূন্যে তৈরি করা হাওয়ামহল।
‘আসিয়ান’ভুক্ত দেশগুলি তো তাও দূরের প্রতিবেশী। নেহাত ঘরের পাশে রয়েছে যারা, তাদের সঙ্গে মোদিজির ভারতের সম্পর্ক কেমন? এই কিছুদিন আগেই তো বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর দাবি করেছেন যে মোদি সরকারের আমলে প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে উন্নত হয়েছে! বাস্তব বলছে, সেই দাবিরও সারবত্তা নেই বললেই চলে। এ বছরের শুরুতেই দীর্ঘদিনের বন্ধু দেশ মলদ্বীপের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। ভারতবিরোধিতায় উত্তাল মলদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনাকে সরে যেতে বাধ্য করেছেন সেখানকার প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুইজ্জু। কয়েক মাস আগে বাংলাদেশেও বয়ে গেছে ভারত বিরোধিতার হাওয়া। ভারতের পণ্য বয়কটের যে ডাক দিয়েছিল বিএনপি ও জামাত, তার বেশ খানিকটা প্রভাব পড়েছিল বাংলাদেশের মানুষের উপর। গত কয়েক বছর ধরেই নেপালের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক ক্রমাগত তেতো হয়ে চলেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে নেপালের প্রধানমন্ত্রী নেপালি কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ভেঙে কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপালের হাত ধরেছেন। চিনের ঘনিষ্ঠ এই দলটি সরকারে আসায় নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের মেরামতি এখন অনেকটাই কঠিন।
আসিয়ান গোষ্ঠীতে মর্যাদা হ্রাস কিংবা বাংলাদেশ, নেপালের মতো পড়শি রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে এ দেশের সাম্প্রতিক সম্পর্কের অবনতির পিছনে রয়েছে ভারতীয় পুঁজি ও ওইসব দেশগুলির জাতীয় পুঁজির দ্বন্দ্ব। রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিটি পুঁজিবাদী দেশ যেহেতু তার জাতীয় পুঁজির প্রতিনিধিত্ব করে, তাই কোন গোষ্ঠীতে কার দাপট বাড়বে বা কমবে, কোন রাষ্ট্রের সঙ্গে কোন রাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতা বাড়বে বা সম্পর্ক খারাপ হবে– এগুলি সবই নির্ধারিত হয় তাদের নিজের নিজের জাতীয় পুঁজির শক্তি- দুর্বলতা ও দুটি দেশের পুঁজির শক্তির পারস্পরিক প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু এ সবের বাইরেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারত ঐতিহ্যগত ভাবে একটি বিশেষ সম্মানের অধিকারী ছিল।
চিরাচরিত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভূমিকার কারণে ভারত দীর্ঘদিন ধরে দেশে দেশে সাধারণ মানুষের কাছে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু সেই সম্মানও আজ ধূলায় মুখ লুকিয়েছে। দেশীয় কর্পোরেট পুঁজির মুনাফার নগ্ন স্বার্থে ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণির পলিটিকাল ম্যানেজার কেন্দ্রীয় সরকারগুলি যত দিন যাচ্ছে তত আরও বেশি করে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির সঙ্গে দহরম মহরম বাড়িয়ে তুলছে। সাথে সাথে দেশের ভিতরে গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারগুলির টুঁটি টিপে ধরে সরকারগুলি ক্রমাগত ফ্যাসিবাদী রূপ ধারণ করছে।
গত দশ বছর ধরে কেন্দ্রে মোদি সরকারের শাসন এ বিষয়ে অতীতের সমস্ত রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে। পরিণামে বিশ্বের দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণতন্ত্রপ্রিয় সাধারণ মানুষের চোখে ভারতের আজ মর্যাদা খাটো হয়ে পড়েছে। ফলে এ কথা বলাই যায়, মোদি সরকার ভারতকে ‘বিশ্বগুরু’-র আসনে বসানো দূর অস্ত, বরং বিশ্বের চোখে তার পুরনো সম্মানটুকুও বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।
(তথ্যসূত্রঃ স্ক্রোল ডট ইন, ৮ মে ‘২৪,
আ. বা. প. ৭ মে ‘২৪ ও ১ সেপ্টেম্বর ‘২৩)