পথের দাবি
ভরা ব্রিগেড। লাল শালু আর পতাকায় মোড়া সুউচ্চ সুবিশাল মঞ্চের বাঁ পাশে যেখানে বসে আছি, সেখান থেকে কৌণিক দৃষ্টিতে দেখা ত্রিমাত্রিক পশ্চাদপট একটা ভিন্ন অবয়ব ধারণ করেছে, যেন মুষ্টিবদ্ধ হাতের ক’টা আঙুল। অদ্ভূত সমাপতনে উল্টোদিকে, মঞ্চের ডান পাশে খোলা আকাশের প্রেক্ষাপট জুড়ে ৬৫টি তলা নিয়ে আকাশ আঁচড়ানো অট্টালিকার দানবীয় উপস্থিতি। তারই পাদদেশ ঘিরে, সামনে পিছনে পথে পথে বিস্তৃত ময়দান ছাপিয়ে কল্লোলিত জনস্রোত– যার উৎপত্তি বহু বছর আগে জয়নগরের এক ছোট্ট সভাস্থলে। আকাশে উড়ে উড়ে কটা উড়ুক্কু যান দেখলাম যন্ত্রচক্ষুতে মাপছে সেই ক্রমশ স্ফীতকায় স্রোতের আড়-বহর। যন্ত্র-চক্ষুর তোলা আলোকচিত্র কি ধরতে পারবে জনস্রোতের মেজাজ বা ভাবনার রূপ? মঞ্চের সামনে হাজার লোকের ভিড়ের দিকে তাকিয়ে আলাদা করে দেখতে পারছিলাম না সেই ‘কুলতলির পার্টিতে’ আজ হাজির কর্ণাটকের গ্রাম নগর থেকে আসা চিকিৎসকদের, অথবা দিল্লি এইমসের স্নাতকোত্তর বা কটক মেডিক্যাল কলেজের তরুণ ছাত্রদের।
না তারা আসেননি কোনও বিশেষ দাবি নিয়ে, পড়ার বাড়তি সুযোগ বা চাকরির আর্জি নিয়ে। যেমন আসেননি গঙ্গাপাড়ের জুটমিল শ্রমিক, বর্ধমানের খেতমজুর বা ঝাড়খণ্ডের প্রাথমিক শিক্ষক আলাদা আলাদা ঝান্ডা বা স্থানীয় সমস্যা নিয়ে। ব্যাপারটা তলিয়ে বুঝলে একটু অবাকই লাগে। কোনও আশু অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া নয় বা নির্বাচনী প্রচার নয়– এত লোক, দূর গ্রাম থেকে আসা প্রান্তিক চাষি থেকে চারপাশের মহতী সব অট্টালিকা থেকে নেমে আসা সরকারি বেসরকারি চাকুরেরা ভিড় করেছেন শুধু একজন চিন্তানায়কের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে, তাঁর চিন্তার আলোয় তাঁদের চারপাশের দুনিয়াকে নতুন করে চিনতে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, ভারত ছাড়ো আন্দোলন, রাষ্ট্র ক্ষমতার হস্তান্তর, দেশভাগ সব মিলিয়ে বিগত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের ঝোড়ো সময়ে রাজনৈতিক কর্মীদের পক্ষে সামনের পথ চেনা সহজ ছিল না, বিশেষ করে অনুশীলন, যুগান্তরের মতো বিপ্লবী গোষ্ঠীর বা নানা গুপ্ত সমিতির সদস্যদের। জেলে থাকতে মার্ক্সবাদ পড়ে তাঁদের অনেকেরই ভাবনায় নতুন চিন্তার প্রসার কী ভাবে তাঁদের উদ্বুদ্ধ করেছিল দেশ স্বাধীন হবার পরও মানুষের কল্যাণে এক কল্যাণকামী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য আবার এক নতুন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে, সে ইতিহাস বহুকথিত। নানা ভাবে, নানা ব্যাখ্যায়।
সভামঞ্চ ঘিরে বিশাল কিন্তু সুশৃঙ্খল জনতাকে দেখছি সাগ্রহে শুনছেন মাইকে প্রভাস ঘোষের গলায় সে ইতিহাসের টুকরো টুকরো স্মৃতিচারণ। খাবার নেই, থাকার জায়গা নেই, পরবার কাপড় নেই, একটাই ভাল জামা পালা করে পরা, কিন্তু খামতি নেই নিরন্তর অধ্যয়নে, বিশ্রাম নেই সঠিক পথের সন্ধানে নতুন নতুন পথে পদচারণায়। সঠিক পথ কী? সহযাত্রীদের মধ্যেই অনেক তর্ক-বিতর্ক। সশস্ত্র সহিংস বিপ্লব না রাজনৈতিক পথে শান্তিপূর্ণ উপায়ে পুঁজিপতি-বুর্জোয়া স্বার্থরক্ষাকারী শাসকদের হাত থেকে শ্রমিক-কৃষকের বন্ধু সমাজতন্ত্রীদের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতার বদল? সংসদীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সমাজতন্ত্রীদের ভূমিকা কী বা কতটা? সে রাস্তা খুঁজতে শিবদাস ঘোষের শিক্ষা ছিল পথ চলতে চলতেই পথ চেনা। এক বিপ্লবী গুপ্ত সমিতি ‘পথের দাবী’কে নিয়ে শরৎচন্দ্রের ওই একই নামের উপন্যাস আর তার নায়ক সব্যসাচী মল্লিক তাই ছিল তাঁর বড় প্রিয়। অনুজ সহযাত্রীদের জন্য লেখায় বত্তৃতায় সব্যসাচীর উক্তি, ‘‘পথের দাবীর ভালমন্দ দিয়েই আমার সত্যাসত্য নির্ধারিত হয়, এই আমার নীতিশাস্ত্র, এই আমার অকপট মূর্তি”। বারবার উদ্ধৃত করে শিবদাস ঘোষ সেই সহজ শিক্ষাটাই দিতে চেয়েছিলেন।
এত বছর পরেও, এত লোক তাই দেখতে পাচ্ছি পথে নেমে এসে স্মরণ করছেন এমন একজন লোকের কথা যিনি বলতে পারতেন, ‘আমার জীবনই আমার বাণী’। দীর্ঘ সময় ধরে খুঁটিয়ে দেখছেন তাঁর আর সহযাত্রীদের চলার পথের নানা বাঁক, নানা ক্রান্তিকারী মুহূর্তের সাক্ষ্য বহনকারী লেখা-চিত্রের প্রদর্শনী। স্মৃতি ভারাক্রান্ত বয়স্ক অনেকের চোখে জল, আবেগ সঞ্চারিত হচ্ছে তরুণদের মনেও। ভিড়ের মধ্যে সম্ভবত এমন অনেক প্রাজ্ঞ সচেতন ব্যক্তিত্বরা, রাজনীতিক বা অরাজনীতিক আছেন, যাঁরা অন্য মতের পথিক হয়েও এসেছেন শুধু একজন সৎ ভাল মানুষের শ্রদ্ধায় অবনতমস্তক হতে। আজকের মাত্রাছাড়া সহিংস দলাদলির আর দুর্নীতির আবহে সেটা সম্ভবত এক বড় পাওনা। পথের দাবিও হয়তো।
ডাঃ অরুণাভ সেনগুপ্ত, বিশিষ্ট ক্যানসার সার্জেন
প্রত্যয়ই নীরবে সরব
এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) পার্টি নিভৃতে কাজ করে। ৫ আগস্টের ব্রিগেড সমাবেশই তার সাক্ষ্য বহন করে। প্রত্যয়ই নীরবে সরব। স্বউচ্চারের আস্ফালন নেই। আছে মনোযোগ– আছে বিশ্বাস– দৃঢ় প্রত্যয়। এই বিশ্বাসই এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) পার্টির জীবনীশক্তি।
গণেশ হালুই, বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী
অসামান্য বিশ্লেষণী
নিজে একটি জীবনচর্যা যাপন করে বক্তব্য রাখলে সেই বক্তব্য যে হৃদয়গ্রাহী হয় প্রভাসবাবুর সে দিনের বক্তব্য তার প্রমাণ। যদিও আমার কাছে বক্তব্যের প্রথম পঁয়তাল্লিশ মিনিট অসামান্য রকম বিশ্লেষণী লেগেছে, জনসভায় উপস্থিত ক’জন সঠিক ভাবে সেটি অনুধাবন করতে পেরেছেন, জানি না।
ডাঃ দাশগুপ্ত