বিলগ্নিকরণ রুখতে ভারত পেট্রোলিয়াম কর্মীরা রাস্তায়

বাজেট ঘাটতি কমানোর নামে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণ করেই চলেছে৷ কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী এ বছরের বাজেটে বিলগ্নিকরণের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছেন এক লক্ষ পাঁচ হাজার কোটি টাকা৷ এই বিলগ্নিকরণের খাঁড়া যে সমস্ত সংস্থার উপর নেমে আসতে যাচ্ছে তাদের অন্যতম ভারত পেট্রোলিয়াম কোম্পানি (বিপিসিএল)৷ চাকরি হারানোর আশঙ্কায় সংস্থার কর্মীরা ইতিমধ্যেই এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছেন এবং দাবি তুলেছেন,  বিলগ্নিকরণ বন্ধ কর৷

বিলগ্নিকরণের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে দেশের মানুষকে অন্ধকারে রাখতে সাধারণত একটা ধুয়া তোলা হয় যে, অলাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র বা লোকসানে চলা রাষ্ট্রীয় সংস্থা চালিয়ে যাওয়ার অর্থ, সরকারি অর্থের অপচয়৷ এগুলো চালিয়ে যাওয়ার চেয়ে বেচে দেওয়াই ভাল৷ তাতে সরকারের অর্থ বাঁচবে৷ এটা যে কত বড় মিথ্যা, তার একটা বড় উদাহরণ বিপিসিএল বিলগ্নিকরণ৷

ভারত সরকার যে ৮টি সংস্থাকে ‘মহারত্ন’ সংস্থা বলে ঘোষণা করেছে, বিপিসিএল তার অন্যতম৷ ভারতের সমস্ত শিল্প–সংস্থার মধ্যে এর স্থান ছয় নম্বরে৷ গোটা বিশ্বের অগ্রগণ্য শিল্পসংস্থাগুলির যে তালিকা আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা ‘ফরচুন’ তৈরি করেছে, সেখানে প্রথম ৩০০টি মধ্যে বিপিসিএলের স্থান ২৭৫তম৷ তেল ও গ্যাস নিয়ে এর ব্যবসা৷ ভারতের চারটি জায়গায় এর শোধনাগার আছে৷ কোচি, মুম্বই, বীণা (মধ্যপ্রদেশ) ও নিউমালিকায় (আসাম)৷ বীণার তেল শোধনাগারটি চলে ওমান তেল কোম্পানির সঙ্গে যৌথ মালিকানার ভিত্তিতে৷ গোটা ভারত জুড়ে এদের নেটওয়ার্ক৷ দেশের তেল উৎপাদনের ২৪ শতাংশ রয়েছে বিপিসিএল–এর হাতে৷ এদের এল পি জি কানেকশন গ্রাহক সংখ্যা ৬.৮ কোটি৷ গোটা দেশে এদের ডিপো ও পাম্পের সংখ্যাও অসংখ্য৷ বোম্বে হাই–এর তৈলক্ষেত্রের কাজ এরাই শুরু করে৷ গত পাঁচ বছরে এদের শোধনাগারগুলিতে ৩০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের পর এদের বাৎসরিক তেল উৎপাদন ক্ষমতা ২.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন থেকে বেড়ে বর্তমানে ১৫.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন হয়েছে৷ ২০১৭–’১৮ সালে এদের নিট লাভের পরিমাণ ছিল ৮,৫২৭ কোটি টাকা৷ তা হলে, এরকম একটা লাভজনক সংস্থাকে কোন যুক্তিতে বিলগ্ণিকরণ ঘটানো হচ্ছে?

ভারত সরকারের ডির্পাটমেন্ট অফ ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড পাবলিক অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট সমীক্ষা করে বিপিসিএল–এর বিক্রয় মূল্য ধার্য করেছে ৫৬ হাজার কোটি টাকা৷ যে সংস্থার নিট লাভ বছরে ৮৫২৭ কোটি টাকা, অপারেটিং লাভ ১১৯৬৮ কোটি টাকা, ২০১৯ সালে যার মোট সম্পদের পরিমাণ ১ লক্ষ ৩৬ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা৷ তার বিক্রয়মূল্য ৫৬ হাজার কোটি টাকা কী করে হয়?

২০১৭ সালে ইমার অয়েল কোম্পানি গুজরাটে তাদের একটিমাত্র তেল শোধনাগার রাশিয়ার একটি তেল কোম্পানি রুফ নেটফ্লিক্সকে বিক্রি করে দেয় ১২.৯ বিলিয়ন ডলারে৷ ভারতীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা৷ বিপিসিএল–এর মোট সম্পদ এর দশ গুণেরও বেশি৷ তা হলে তার দাম ৫৬ হাজার কোটি টাকা হয় কী করে? প্রশ্ন উঠেছে, কোন অদৃশ্য হাতের খেলা এর পিছনে কাজ করছে?

বিপিসিএল–এর ৫৩.২৯ শতাংশ শেয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রয়েছে৷ তা বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় স্বভাবতই বিপিসিএল–এর কর্মীরা গভীর উদ্বিগ্ন৷ বিপিসিএল–এর মোট কর্মী সংখ্যা ১২ হাজার ১৫৭৷ এ ছাড়াও রয়েছে আরও ২৭ হাজার ঠিকা কর্মী যাঁরা এদের তেল শোধনাগারগুলিতে নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত৷ এদের ৪টি মূল শোধনাগারের মধ্যে কেরালার কোচি ইউনিটটিই সবচেয়ে বড়৷ স্বাভাবিকভাবেই এই রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বেচে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সেখানে তীব্র প্রতিবাদ দানা বেঁধেছে৷ তাছাড়া কোচি রিফাইনারি সম্প্রসারণের কাজ চলছে৷ ৪০ হাজার কোটি টাকায় এই প্রকল্পের জন্য ১৭৬ একর জমি নেওয়া হয়েছে৷ আরও ৪৬০ একর জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে৷ ফলে অনেকেই আশায় ছিলেন, এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে৷ সরকারের বিলগ্নিকরণের সিদ্ধান্ত এই আশায় জল ঢেলে দিল শুধু তাই নয়, কর্মীদের জীবিকাকেও একটা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিল৷ এই সংস্থা বেসরকারি মালিকের হাতে চলে গেলে কত জনের চাকরি থাকবে? এই উদ্বেগ থেকে বিপিসিএল–এর কর্মীরা ইতিমধ্যেই প্রতিবাদে নেমেছেন৷ সেপ্টেম্বর–অক্টোবর মাস জুড়ে আন্দোলনের নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে৷ বিপিসিএল বিলগ্নিকরণ ও বেসরকারিকণের বিরুদ্ধে লড়াইকে তীব্রতর করতে এর্নাকুলাম জেলায় গঠিত হয়েছে যুক্ত সংগ্রাম কমিটি৷ এতে সমস্ত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের প্রতিনিধিরাই রয়েছেন৷

কোচি ছাড়া বিপিসিএল–এর অন্য শোধনাগারের কর্মীরাও আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন৷ আশঙ্কা ও উদ্বেগ বাড়ছে ইন্ডিয়ান অয়েল (আইওসিএল), অয়েল ইন্ডিয়া, ওয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস করপোরেশন (ওএনজিসি), হিন্দুস্থান পেট্রোলিয়াম (এইচপিসিএল)–এর মতো অন্যান্য তেল কোম্পানিগুলির শ্রমিক–কর্মচারীদের মধ্যেও৷ এঁদের সবাইকে নিয়ে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকে ইতিমধ্যেই একটি জাতীয় কনভেনশন মুম্বইতে অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ এই কনভেনশন থেকে আগামী দিনে আরও বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছে৷ শুধু তেল কোম্পানিগুলিই নয়, রেলেও বেসরকারিকরণের  প্রক্রিয়া চলছে৷ সেখানেও কয়েক লক্ষ শ্রমিক কর্মচারী কাজ হারানোর আশঙ্কায় দিন গুনছেন৷ আশঙ্কায় রয়েছেন অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্মীরাও৷

আজ পুঁজিপতিদের স্বার্থে যেসব রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণ ঘটানো হচ্ছে, সেগুলো একটা সময় এ দেশের সরকার গড়ে তুলেছিল এ দেশের পুঁজিপতিদের স্বার্থেই৷ স্বাধীনতার পরবর্তী পর্যায়ে এ দেশে পুঁজিবাদের বিকাশের জন্য এইসব মূল ও ভারী শিল্পগুলি ছিল অপরিহার্য৷ অথচ ব্যক্তি পুঁজিপতিরা সেদিন এখানে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী ছিল না৷ কারণ এর জন্য প্রয়োজন ছিল বিশাল অংকের পুঁজি৷ তা ছাড়া তাদের চাই চটজলদি লাভ৷ এই ধরনের শিল্পে বিনিয়োগ করে লাভের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে থাকতে হয়৷ শিল্পপতিদের হয়ে এই কাজটা সেদিন করে দিয়েছিল তাদেরই বশংবদ সরকার৷ এটাই ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি গড়ে ওঠার ইতিহাস৷

আজ আবার চিত্রটা সম্পূর্ণ উল্টো৷ আজ পুঁজির মালিকদের হাতে রয়েছে বিশাল পুঁজি৷ কিন্তু তা খাটাবার জায়গা নেই৷ কারণ বাজার নেই৷ বাজার নেই কারণ দেশের অধিকাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বলে কিছু নেই৷ তাই উৎপাদন ক্ষেত্রগুলি ধুঁকছে৷ অর্থনীতিতে মন্দা৷ এই মন্দা মোকাবিলার নামে কেন্দ্রে তাদের সেবাদাস বিজেপি সরকার যেমন একদিকে করপোরেট মালিকদের জন্য সরকারি ভাণ্ডার উজাড় করে দিচ্ছে, করপোরেট ট্যাক্স কমিয়ে দিচ্ছে, এদের অনাদায়ী ঋণ ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মুছে দিচ্ছে, তেমনি একদিন সরকারের হাতে থাকা লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলিও বাজারদরের চেয়ে অনেক কম দামে তুলে দিচ্ছে এদের হাতে৷ শিল্প–স্বাস্থ্য–বিদ্যুৎ মতো অত্যাবশ্যকীয় ক্ষেত্রগুলিও এদের সামনে খুলে দেওয়া হচ্ছে৷ এটাই হল বিলগ্নিকরণের পিছনকার ইতিহাস৷ যা শুরু করেছিল কংগ্রেস ১৯৯১ সালে৷

কংগ্রেসের পথ অনুসরণ করেই বিজেপি বিলগ্নিকরণের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেছে৷ ২০১৩–’১৪ সালে কংগ্রেস রাজত্বের শেষ বছর বিলগ্নিকরণের পরিমাণ ছিল ১৫৮১৯ কোটি টাকা৷ আজ তা লক্ষ কোটি টাকার সীমা ছাড়িয়েছে৷ মোট ৩৩১টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার মধ্যে ২৫৭টিতেই এই প্রক্রিয়া চলছে৷ তথ্য বলছে, যে ২৫৭টি সংস্থায় বিলগ্নিকরণের প্রক্রিয়া চলছে সেখানে ২০১৬–’১৭ সালে নিট লাভের অংক ছিল ১২৭৬০২ কোটি টাকা৷ যা আগের বছরের চেয়ে, ১৩৩৬৩ কোটি টাকা বেশি৷ এই বিজেপিই অটলবিহারী বাজপেয়ীর শাসনকালে (১৯৯৯–২০০৪) ভিএসএনএল, আইপিসিএল (ইন্ডিয়ান পেট্রোকেমিক্যালস), ভারত অ্যালুমিনিয়াম, হিন্দুস্তান জিংকের মতো সংস্থা টাটা, আম্বানিদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল৷ আজ তারা অনেক বেশি বেপরোয়া৷ একে রুখতে হলে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ১৪ সংখ্যা)