গুজরাটে সদ্য জেলমুক্ত এগারো জন ধর্ষণকারী-খুনিকে ফুলের মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দিচ্ছেন শাসকদল বিজেপি-ঘনিষ্ঠ বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সদস্যরা। হাসিমুখে চেয়ারে বসিয়ে মিষ্টি খাওয়ানো হচ্ছে দুষ্কৃতীদের। আর এই দৃশ্যটিকে ঘিরে পাক খাচ্ছে এক গণধর্ষিতা নারীর, চোখের সামনে নিজের শিশুকন্যাটিকে খুন হতে দেখা একজন মায়ের আর্ত প্রশ্ন– ‘এ ভাবে কি কোনও ন্যায়বিচার শেষ হতে পারে!’ এই দৃশ্যকল্প ভারতীয় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের নাগরিক হিসাবে বিশ্বের কাছে লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট করে দেয়। সঞ্চারিত করতে থাকে একটি ভয়ঙ্কর বার্তা– ভোট রাজনীতির পাশাখেলায় উগ্র হিন্দুত্ববাদকে আশ্রয় করতে গিয়ে মানবিকতা, নৈতিকতা, সামাজিক মূল্যবোধ এবং আইনকেও দু’পায়ে পিষে দিতে শাসক বিজেপির এতটুকু বাধে না। আর তাই দেখে ধর্ষক-দুর্বৃত্তরা ত্রুর হাসি হাসে। তারা আজ আশ্বস্ত– শাসকদলের ছত্রছায়া জোগাড় করতে পারলেই রেহাই মিলবে সমস্ত দুষ্কর্মের শাস্তি থেকে।
১৫ আগস্ট ‘স্বাধীনতার ‘অমৃত মহোৎসব’-এর দিনে দেশের আইন-কানুন, বিচারব্যবস্থা, সংবিধানে ঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষতা, জীবনের অধিকার, নারীর মর্যাদা, মানবিক মূল্যবোধ– সমস্ত কিছুকে গরলের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে গুজরাটের বিজেপি সরকার মুক্তি দিয়েছে ১১ জন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীকে। এরা কোনও সাধারণ আসামী নয়। ২০০২ সালে কুখ্যাত গুজরাট গণহত্যার সময়ে এরা গণধর্ষণ করেছিল পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা বিলকিস বানোকে। খুন করেছিল তাঁর পরিবারের ১৪ জনকে। পাথরে আছড়ে মাথা থেঁতলে হত্যা করেছিল বানোর তিন বছরের শিশুকন্যাটিকে।
সেদিন ধর্মান্ধ দুষ্কৃতীরা দাহোদ গ্রামে ঘরে ঘরে আগুন লাগালে প্রাণভয়ে দিশাহারা বানো ও তাঁর আত্মীয়রা যখন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছিলেন, তখনই ঘটে এই নৃশংস ঘটনা। ঘটনার বর্বরতায় দেশ জুড়ে শোরগোল ওঠে। পুলিশ বাধ্য হয় পদক্ষেপ নিতে। ২০০৮ সালে ওই ১১ জন দুষ্কৃতীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। এ বছরের শুরুতে এক আসামী কারামুক্তির আবেদন জানালে সুপ্রিম কোর্ট গুজরাট সরকারকে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে বলে। গুজরাটের বিজেপি সরকার এমন কমিটি তৈরি করে যার দুই সদস্য বিজেপির বিধায়ক, বাকি দু’জনও দলের সক্রিয় কর্মী। খুব স্বাভাবিক ভাবেই কমিটি দ্রুত ওই ১১ জন অপরাধীর সাজা মকুবের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার দিন রাজ্যের সরকার তাদের মুক্তি দেয়।
জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর যেভাবে হিন্দুত্ববাদীরা ওই ১১ জন গণধর্ষণকারী-খুনিকে সংবর্ধনা দিয়েছে, তাতে দেশ জুড়ে ধিক্কারে সোচ্চার হয়েছে মানুষ। আইন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার অনুমতি না দিলে রাজ্য সরকারের পক্ষে শাস্তি মকুব করা সম্ভব নয়। ফলে এই দুর্বৃত্তদের কারামুক্তি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনুমতি ছাড়া সম্ভব নয়। প্রশ্ন উঠেছে, প্রধানমন্ত্রী এই চূড়ান্ত অন্যায় কাজে সম্মতি দিতে পারলেন কী করে? সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুললেই যেখানে সমাজকর্মী থেকে শুরু করে সাংবাদিকদের ইউএপিএ-র মতো কঠোর আইনে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, যখন হাজার আবেদন সত্ত্বেও অসুস্থ, মৃত্যুপথযাত্রী মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মীদেরও মুক্তি, এমনকি জামিন পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে না, তখন কোন যুক্তিতে এই ভয়ঙ্কর অপরাধীদের মুক্তি দিল বিজেপি সরকার?
গুজরাট গণহত্যার সময় নরেন্দ্র মোদি ছিলেন সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। সংখ্যালঘু গণহত্যা রোধে তাঁর নিষ্ক্রিয় ভূমিকা দেখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী তাঁকে ‘রাজধর্ম’ পালনের উপদেশ দিয়েছিলেন। আজ যখন তিনি নিজেই দেশের প্রধানমন্ত্রী, তখন কোন ধর্মের অনুশাসনে এমন অন্যায় আচরণ করলেন নরেন্দ্র মোদি? ২০১৪ সালে গৃহীত সরকারি নীতি অনুযায়ী স্পষ্ট নির্দেশিকা রয়েছে, ধর্ষণকারী কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তদের এ ভাবে মুক্তি দেওয়া যাবে না। তাহলে গুজরাটের বিজেপি সরকার কোন আইনের বলে এ জিনিস করতে পারল? প্রধানমন্ত্রীই বা এই বেআইনি কাজের অনুমতি দিলেন কী করে?
আসলে পুরো সিদ্ধান্তটি ভোট-রাজনীতির স্বার্থে। গুজরাটে বিধানসভা নির্বাচন এ বছরের শেষে। উগ্র হিন্দুত্ববাদকে উস্কে দিয়ে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের সাহায্যে ভোটবাক্স গোছানোর লক্ষ্যেই গণহত্যার অপরাধীদের এভাবে মুক্তি দেওয়া। এই ঘটনার পর আতঙ্ক যেভাবে নতুন করে পিছু নিল বিলকিস ও তাঁর পরিজনদের, গুজরাটে সংখ্যালঘু ভোটারদের আসলে সেই আতঙ্কের আবহেই ঠেলে দিতে চায় বিজেপি। উগ্র সাম্প্রদায়িক পরিবেশ তৈরি করে একদিকে সংখ্যালঘুদের সন্ত্রস্ত করা, অন্যদিকে হিন্দুত্বের চ্যাম্পিয়ন সেজে হিন্দু ভোট একজোট করাই এর লক্ষ্য। রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ভোটারদের কাছে এ হল পরিষ্কার বার্তা– বিজেপি-রাজে হিন্দুরা সমস্ত অপরাধের ঊর্ধ্বে, বিশেষ করে সেই অপরাধ যদি ঘটে থাকে সংখ্যালঘু মানুষের সঙ্গে। গুজরাটের এক বিজেপি বিধায়ক তো চরম নির্লজ্জের মতো বলেই দিয়েছেন, ‘ধর্ষণকারীরা ব্রাহ্মণ, তাদের সংস্কারও ভাল।’ একটি দলের মতাদর্শে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা কী ভয়ঙ্কর ভাবে মিশে থাকলে গণধর্ষণকারী-খুনিদের ভাল সংস্কারের ধারক-বাহক বলা যায়, তা দেখিয়ে দিল এই ঘটনা।
গুজরাটে সাজাপ্রাপ্তদের মুক্তির সিদ্ধান্তের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিকটি হল, এই ঘটনায় দুষ্কৃতী-দুর্বৃত্তদের বুঝিয়ে দেওয়া গেল, যত ভয়ঙ্কর অপরাধই তারা করুক না কেন, শাসকদলের আশীর্বাদ মাথায় থাকলে শাস্তির ভয় তো নেই-ই, বাড়তি জুটবে ফুলের মালা। ফলে তাদের আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠার আশঙ্কা তৈরি হল। দেশের নাগরিকদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর অপরিসীম দায়িত্ববোধের প্রমাণ, সন্দেহ নেই! গুজরাটের ওই গণধর্ষণকারী-খুনিদের যেদিন মুক্তি দিল বিজেপি সরকার, সেদিনই লালকেল্লার প্রাচীরে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা দিবসের ‘অমৃত মহোৎসবে’ ভাষণ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নারী-মর্যাদা রক্ষার সঙ্কল্প নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেই সময়ে পৈশাচিক অত্যাচারের শিকার সন্তানহারা বিলকিসের করুণ মুখটা একবারের জন্যও কি তাঁর মনে পড়েছিল? নাকি সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে বিজেপির বিচারে তিনি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভারতের নাগরিকই নন! বিলকিস ও তাঁর স্বামী তো দেশের বিচারব্যবস্থা, প্রশাসনের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখেছিলেন! ন্যায়বিচার মিলবেই– এই প্রত্যয়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের শত হুমকি, দাপট অগ্রাহ্য করে লড়াই করে যাচ্ছিলেন! ধর্ষণকারীদের মুক্তি দিয়ে নারীমর্যাদা রক্ষার কোন উদাহরণ স্থাপন করলেন প্রধানমন্ত্রী– আজ বিলকিস যদি প্রধানমন্ত্রীকে এই প্রশ্ন করেন, উনি তার উত্তর দিতে পারবেন তো? নাকি ওই ভাষণের পুরোটাই ছিল স্রেফ কথার কারসাজি?
মানুষ প্রশ্ন তুলছে, দেশের বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা রেখে বছরের পর বছর জীবনপণ লড়াই করে বিলকিস বানো কি ভুল করেছেন? আজ তিনি প্রতারিত, অন্তর থেকে নিঃস্ব। ন্যায়বিচারের প্রতি তাঁর বিশ্বাস টলে গেছে। তিনি বলেছেন, ‘‘আমি শুধু আমার কথা বলছি না। প্রতিটি মেয়ে যারা আদালতে ন্যায়ের জন্য লড়ছে, তাদের সকলের জন্য কষ্ট হচ্ছে আমার।”
বাস্তবে বিজেপি সরকারের এই চূড়ান্ত অন্যায়ের জন্য দেশের সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই আজ বিলকিস বানোর সমব্যথী। মহিলা সংগঠন এআইএমএসএস-এর পক্ষ থেকে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড ছবি মহান্তি ১৮ আগস্ট এক বিবৃতিতে এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন। রাজ্যে রাজ্যে এই অন্যায় সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার ও বিলকিস বানোর নিরাপত্তার দাবিতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন সংগঠনের সদস্যরা। এগিয়ে এসেছে আরও অসংখ্য সংগঠন ও সাধারণ মানুষ। তাঁরা বলছেন, পৈশাচিক গণধর্ষণ ও খুনের আসামীদের মুক্তির ঘটনায় শুধু বিলকিস বানো ও তাঁর পরিবার নয়, গোটা সমাজের মানবতা বিপর্যস্ত হল। এ শুধু বিলকিস বানোর নয়, গোটা নারীসমাজের মর্যাদার প্রশ্ন। ‘ন্যায়বিচারের এই কি পরিণতি?’– বিলকিসের এই আর্ত প্রশ্নের জবাব তাঁরা নিয়েই ছাড়বেন প্রধানমন্ত্রীর থেকে।