বিলকিস বানোঃ অপরাধীদের নির্দোষ দেখাতে বিজেপি নেতাদের নির্লজ্জ মিথ্যাচার

 

দিল্লি

২০০২-এর গুজরাট গণহত্যার সময়ে বিলকিস বানোকে গণধর্ষণ ও তাঁর পরিবারের ৭ জনকে খুনের দায়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১১ জন বিজেপি কর্মীকে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে গুজরাটের বিজেপি সরকার মুক্তি দিয়েছে। এই ধরনের অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে আমৃত্যু কারাদণ্ড। তা সত্ত্বেও গুজরাট সরকার এই অপরাধীদের মুক্তি দিল কী করে?

গুজরাট সরকার যুক্তি দিয়েছিল, কারাবাসের সময়ে এই অপরাধীরা অত্যন্ত ভাল আচরণ করায় তাদের সাজার মেয়াদ সরকারি নিয়মেই কমে গেছে। তাই তাদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং তা দেওয়া হয়েছে এই সংক্রান্ত আইন মেনেই। অবশ্য গুজরাটের এক বিজেপি নেতা এই মুক্তি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, এঁরা সংস্কারী ব্রাহ্মণ। এমন অপরাধ এঁরা করতেই পারেন না।

ধর্ষক-খুনীদের এই মুক্তি সারা দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে স্তম্ভিত করে দেয়। তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় দেশ জুড়ে। এই মুক্তি রদ করার দাবি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হলে কোর্ট গুজরাট সরকারকে হলফনামা পেশের নির্দেশ দেয়। সেই হলফনামাতে অপরাধীদের সদাচরণের যে নমুনা বেরিয়ে এসেছে তা রীতিমতো বিস্ময়কর। শুধু তাই নয়, রাজ্য সরকার অপরাধীদের মুক্তি দিতে কত বড় মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছে, এতে তা-ও স্পষ্ট হয়ে গেছে।

গুজরাট সরকারের হলফনামা কী বলছে? এই ১১ জন অপরাধী যখন প্যারোলে জেলের বাইরে ছিল, তখন এদের মধ্যে দু’জনের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হয়েছে। দু’জনের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ জমা পড়েছে। ১১ জনের মধ্যে ১০ জনই প্যারোলের নিয়ম ভঙ্গ করেছে। নিয়মভঙ্গের জন্য বেশ কয়েক জন জেলে শাস্তিও পেয়েছে। অপরাধীদের ১৪ বছরের বেশি জেলে থাকার কথা গুজরাট সরকার বললেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, তারা প্রায় সকলেই প্যারোলে হাজার দিনের বেশি জেলের বাইরে থাকার সুযোগ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, ১১ জনের মধ্যে ১০ জনই প্যারোলের নিয়ম ভঙ্গ করে নির্দিষ্ট দিনের চেয়ে অনেক দেরিতে জেলে ফিরেছে। দীর্ঘ সময়ের সাজাপ্রাপ্তরা জেলে সদাচরণের বিনিময়ে মুক্তি এগিয়ে আনার যে সুবিধা পেয়ে থাকেন, যাকে আর্নড রেমিশন বলা হয়, নিয়ম অনুযায়ী এদের প্রায় সকলেরই তা হারানোর কথা। তার বদলে গুজরাটের বিজেপি সরকার এদের সদাচরণের সার্টিফিকেট দিল! এ থেকে এটাই স্পষ্ট যে, গুজরাট সরকারের যুক্তি ছিল আসলে অজুহাত মাত্র।

১৯৯২-এর যে আইনে সুপ্রিম কোর্ট দণ্ডিতদের পূর্বমুক্তির কথা বিবেচনা করতে বলেছিল, তাতে যে শর্তগুলি দেওয়া হয়েছিল সেগুলিকে সরকার অগ্রাহ্য করেছে। যেমন, অপরাধীদের মুক্তি দিলে সমাজে তার কী প্রভাব পড়বে, তা খতিয়ে দেখা। প্যারোলে থাকাকালে তাদের অপরাধের তালিকাই প্রমাণ করেছে এই মুক্তি সমাজের পক্ষে কতখানি মারাত্মক হতে চলেছে। তা ছাড়া, যে আদালত তাদের শাস্তি দিয়েছে, সেই আদালতের মত নেওয়ার নির্দেশ ছিল। সেই নিম্ন আদালত, সিবিআই, এমনকি পুলিশও কিন্তু অপরাধীদের মুক্তি দেওয়ার বিরুদ্ধেই মত দিয়েছিল।

অর্থাৎ এদের মুক্তি দিতে গিয়ে গুজরাট সরকার কিংবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক কেউই কোনও নিয়ম, আইন কোনও কিছুরই তোয়াক্কা করেনি। আসলে অপরাধীরা যেহেতু বিজেপির পরিকল্পিত গুজরাট গণহত্যায় খুনি, ধর্ষণকারীর ভূমিকা পালন করেছে, তাই বিজেপি সরকার তথা নেতাদের চোখে তাদের কোনও অপরাধই প্রকৃত অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না। তাই তাদের মুক্তির জন্য কোনও নিয়ম মানার, আইন মানার প্রয়োজন বিজেপি নেতারা মনে করেননি।

অনেকেরই মনে আছে, এ বছর স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে সব জ্ঞানগর্ভ বত্তৃতা দিয়েছিলেন তাতে মহিলাদের মর্যাদা, সুরক্ষা, ক্ষমতায়ন প্রভৃতি অনেক ভাল ভাল কথা ছিল। বলেছিলেন, আমাদের মহিলাদের অপমান করার মানসিকতা পরিত্যাগের সঙ্কল্প নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর বত্তৃতা শুনতে শুনতেই কোনও মহিলা যদি দেখেন গর্ভবতী অবস্থায় তাঁর উপর দলবদ্ধ ধর্ষণকারীদের সরকার সেদিনই কারাবাসের মাঝপথে মুক্তি দিয়ে দিচ্ছে, তবে প্রধানমন্ত্রীর বত্তৃতা এবং এই ঘটনাকে কী ভাবে মেলাবেন তিনি? এই ঘটনাকে কি তিনি তাঁর তথা মহিলাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নিদর্শন হিসাবে দেখতে পারবেন? স্বাভাবিক ভাবেই বিলকিস বানো তা পারেননি।

একই ভাবে পারেননি দেশের বিরাট অংশের মহিলারাও। তাঁরা এই মুক্তির তীব্র প্রতিবাদ করেছেন এবং এক বাক্যে প্রশ্ন করেছেন, এই কি প্রধানমন্ত্রীর মহিলাদের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শনের নিদর্শন? নাকি বত্তৃতার সবটিই এমন শূন্যগর্ভ কথার ফুলঝুরি মাত্র? কারও মনে হতে পারে, গুজরাটে অপরাধীদের এই মুক্তির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মহিলাদের সম্মান প্রদর্শনের সদিচ্ছার বিরোধ কোথায়? অবশ্যই আছে। কারণ গুজরাট সরকারের এই কর্মকাণ্ডে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সম্মতির প্রয়োজন এবং সে সম্মতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। এ কথা ঠিক যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর নয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। কিন্তু গুজরাট গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত এই বিলকিস বানো ধর্ষণ মামলা একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ঘটনা। সেই মামলায় দোষী ১১ জন অপরাধীর সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে এবং তা-ও ঠিক গুজরাট নির্বাচনের আগে, অথচ প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি ছাড়াই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তা করছেন, এমন ঘটনা প্রধানমন্ত্রীর দলের লোকেরাই বিশ্বাস করবেন না। প্রধানমন্ত্রীর বত্তৃতা এবং বাস্তব আচরণের এই বৈপরীত্য দেশবাসী কোন দৃষ্টিতে দেখবে!

প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হোন, এঁরা সকলেই জনগণের ভোটে নির্বাচিত মন্ত্রী। এঁরা প্রত্যেকে ভারতের সংবিধান মেনে শাসন চালানোর অঙ্গীকার করেছেন। সেই অঙ্গীকার যদি তারা গায়ের জোরে ভঙ্গ করেন তবে আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক শাসন কথাগুলির কোনও মানে থাকে না। বিজেপি দাবি করে তারা গণতন্ত্র, সংবিধান এবং আইনের পরিকাঠামোর গণ্ডির মধ্যেই কাজ করে। তাঁদের এই আচরণে কোথায় গণতন্ত্র, কোথায় সংবিধান, কোথায় আইনের গণ্ডি? এ ভাবে আইনকে ইচ্ছেমতো নাকচ করার দ্বারা তাঁরা কী দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন? সমাজটাকে তাঁরা কি একটা জঙ্গলে পরিণত করতে চান? দলের নেতা হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর কি এর পর মহিলাদের সম্মানরক্ষা বিষয়ে কোনও কথা বলার অধিকার থাকে? বাস্তবে এমন আচরণের দ্বারা তাঁরা নিজেদের স্বৈরাচারী বলেই প্রমাণ করেছেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বেচ্ছাচারী, স্বৈরাচারীদের কোনও স্থান থাকতে পারে না, জনগণও তেমন নেতাদের মেনে নিতে পারে না। এরপর বিজেপির এই সব নেতাদের গণতন্ত্রের, আইনের বিষয়ে কোনও কথাকে দেশের মানুষ ভণ্ডামি ছাড়া আর কী মনে করতে পারে? যে ভাবে ধর্ষক ও খুনিদের মুক্তি দেওয়া হল, তাতে দেশের মহিলাদেরও কি আর বিজেপি নেতাদের থেকে কোনও জ্ঞানবাণী শোনা উচিত?

উল্লেখ্য, শাস্তি মকুবকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দায়ের করা মামলা বিচারের জন্য গ্রহণ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। কোর্টকেও সঠিক সিদ্ধান্তে দৃঢ় থাকার জন্য প্রয়োজন এই অন্যায়, অগণতান্ত্রিক, বেআইনি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত। সেই মত তৈরিতে দেশের সাধারণ মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে।