না, বিলকিস বানো একফোঁটা চোখের জল ফেলেননি, শুধু শঙ্কায় ঘৃণায় অপমানে শোকে পাথর হয়ে গিয়েছেন। তিনি তাঁর আইনজীবী মারফত বিবেকবান মানুষের কাছে আবেদন রেখেছেন, ‘আমাকে নির্ভয়ে বাঁচার অধিকার ফিরিয়ে দিন’। অপরাধীদের মুক্তি আমার থেকে শান্তি কেড়ে নিয়েছে এবং ন্যায়বিচারের প্রতি আমার বিশ্বাসকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এই দুঃখ এবং বিশ্বাস নড়ে যাওয়ার বিষয়টি শুধু আমার একার নয়, প্রতিটি মহিলা–যারা আদালতে ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রাম করছেন, তাঁদের সকলের।’ ভারতের এক সাধারণ মেয়ের বিশ্বাস নড়ে যাওয়ার, শান্তি হারিয়ে যাওয়ার, আতঙ্কের অতলে ডুবে যাওয়ার সময়টি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। দেশ যখন পালন করছে স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠান সেই ‘অমৃত মহোৎসব’-এর তীব্র আলোর রোশনাইয়ের বিপরীতে বিলকিস বানোরা তলিয়ে যাচ্ছে এক গভীর অন্ধকারে। না, এ কোনও সিনেমার কাহিনি নয়, নয় শুধু গুজরাতের দাহোদ জেলার রাধিকাপুর গ্রামের এক ন্যায়বিচারপ্রার্থীর কাহিনি। এ ঘটনা গোটা দেশের মানুষের সম্মানহানির ঘটনা।
জেনে যে-কেউ অবাক হবেন, ২০০৮-এর ২১ জানুয়ারি থেকে গোধরা জেলে বন্দি ১১ জন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত আসামি ২০২২ এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত যতদিন জেলে থেকেছে তার থেকে বেশি দিন প্যারোলে মুক্ত অবস্থায় থেকেছে জেলের বাইরে! একবার প্যারোল থেকে ফিরে তারা পরের বার প্যারোলের জন্য আবেদন জানিয়েছে। প্যারোলে মুক্ত হয়ে সাক্ষীর বয়ান বদলাতে চাপ দিয়েছে, আক্রান্ত পরিবারকে হুমকি দিয়েছে, সদর্পে অংশগ্রহণ করেছে শাসক বিজেপির মিটিংয়ে মিছিলে। সেই প্রতিটি দিন প্রতিটি রাত গুজরাটের রাধিকাপুরের বিলকিস বানোর জীবনকে ঠিক কতটা দুর্বিষহ করে তুলেছে তা বোঝা কি খুব কঠিন?
ঘটনাটা ২০০২ এর মার্চে গুজরাটে পরিকল্পিত দাঙ্গা ও গণহত্যার সময়ের। বিলকিস তখন ২১ বছরের তরুণী। ওই দাঙ্গার কবলে পড়ে তাঁর পরিবারও। তাঁর চোখের সামনে পরিবারের সাত জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়, যার মধ্যে তাঁর তিন বছরের শিশুকন্যাও ছিল। অন্তঃসত্ত্বা বিলকিস সহ ৯ জন মহিলাকে গণধর্ষণ করে ওই নরপশুরা। ওই অবস্থায় একটি মেয়ের মনের অবস্থা কী হয়? আর কেউ হলে হয়তো পাগলও হয়ে যেতে পারতো। বিলকিস বানো ও তাঁর পরিবার লড়াইটা এগিয়ে নিয়ে গেছেন, ন্যায় বিচারে আশা রেখেছেন। এই জন্যেহ তো বিলকিস বানো শুধুমাত্র একটি অত্যাচারিতা মেয়ে নন, বিলকিস একটি মর্যাদার প্রতীক। যাকে কালিমালিপ্ত করেছে বিচারব্যবস্থা-বিজেপি-আরএসএস-বিশ্ব হিন্দু পরিষদ।
স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষপূর্তির ‘অমৃত মহোৎসব’ উপলক্ষে গণহত্যা ও গণধর্ষণে সাজাপ্রাপ্তদের শাস্তি মকুব করা হল। এই নরপশুদের কারামুক্তিতে উল্লসিত হয়ে এ দেশেরই জন কয়েক মেয়ে তাদের জয়মাল্যে বরণ করল। এরা সকলেই হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী আরএসএস, বিজেপির নানা শাখার সদস্য। অথছ তাদের তো মহিলা হিসাবে এর বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনার ঝড় তোলার কথা ছিল! ধর্মীয় মৌলবাদ মানুষের মনকে যে অন্ধতা, যে উগ্রতার বিষে জারিত করে তার রূপ এমনই! গভীরভাবে ভাবলে দেখা যাবে, বিলকিস বানোর ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। হাথরস, উন্নাও, ভয়ঙ্কর ধর্ষণকাণ্ডের সঙ্গে এক পংক্তিতে রেখে বিচার করলে এদের মধ্যে চরিত্রগত মিল পাওয়া যাবে। জম্মুতে ধর্ষণের ঘটনায় দোষীদের মুক্তির দাবিতে জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে বিজেপি কর্মীদের মিছিলের সঙ্গে পার্থক্য করা যাবে না উলুধবনি দিয়ে বিজয়মাল্য পরিয়ে অপরাধীদের বরণ করে নেওয়ার এই ঘটনাকে। মৌলবাদ মানুষের চিন্তাকে একটি সংকীর্ণ খাতে বইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। মানুষের চোখের সামনে এমনভাবে সুউচ্চ পাঁচিল তুলে দেয়, যার থেকে চোখ সরিয়ে অন্য কিছু দেখা সম্ভব নয়, চিন্তা করা সম্ভব নয়। তাই অনেকে বিমুগ্ধ হয়ে পড়ে দেশে প্রথম দলিত সম্প্রদায়ের এক মহিলা রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে। নিজেদের ‘শিক্ষিত’ ‘নিরপেক্ষ বিচারধারার মানুষ’ বলে যারা মনে করে, দেশের এই ‘অভূতপূর্ব অগ্রগতিতে’ বুকের ভেতরটা গর্বে তাদের টানটান হয়ে ওঠে। ভুলে যায় হাথরসে দলিত কিশোরীকে গণধর্ষণের ঘটনায় উচ্চবর্ণের অপরাধীদের আড়াল করার কী উদগ্র প্রচেষ্টা ছিল সরকারের প্রতিটি স্তরে। ৭৫তম স্বাধীনতার বর্ষপূর্তিতে দেশের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে নারীশক্তি, নারী স্বাধীনতার কথাগুলি শুনে অনেকের ভেতরটা আবেগে অনুরণিত হয়ে উঠেছে। গণধর্ষণ ও হত্যায় সাজাপ্রাপ্ত ১১ জনের কারামুক্ত হওয়ার পর বিলকিস বানোর পরিবার সহ ঘটনার সাক্ষী বাকি মুসলমান পরিবারগুলি এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে, এ সংবাদটাকে তার সাপেক্ষে নেহাতই ছোট বলে মনে হয়। আবার কেউ ঠিক অতটাও হালকাভাবে নেয় না ঘটনাকে। আশা করে তাকিয়ে থাকে– ‘দেখা যাক সুপ্রিম কোর্টে তো কেস হল, কী হয়’। মনে থাকে না, অতীতে গুজরাট দাঙ্গার নায়ক নরেন্দ্র মোদিকে ক্লিনচিট দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টই। কাজেই আর কী, কথাটি ফুরালো আর নোটে গাছটি মুড়োলো।
তবু মর্যাদা বলে কিছু একটা বিষয় আছে। যাঁদের আছে তাঁরা এর জ্বালা টের পান। যেমন আইপিএস সঞ্জয় ভাট, যিনি দাঙ্গার সত্য প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন, মিথ্যা মামলায় জেলবন্দি হয়ে রয়েছেন। সমাজকর্মী তিস্তা শেতলবাদ, যিনি দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায় বিচারের জন্য লড়াই করছিলেন, তাঁকেও মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেকে মনে করেন এসব নিয়ে ভেবে, এসব করে লাভ কী? শুধু শুধু মার খাওয়া, জেলে যাওয়া ছাড়া? সত্য প্রকাশের জন্য, দেশের দশের মঙ্গলে মার যারা খায়, জেলে যারা যায় সত্যিই কি ভেবে দেখেছি তাদের এই দুর্দশা ঘটে কেন? গভীর রাতে ‘নিরপেক্ষতার’ ‘আত্মাভিমানের’ অস্থায়ী পর্দাটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উত্তরটা যদি নিজের কাছে বারবার জানতে চাই তবে উত্তর ঠিক আসে। সত্যিই যা স্বাধীন চিন্তা, যে চিন্তা মানুষের মধ্যে অজস্র প্রশ্নের আলো জ্বে্বলে দেয়, যে চিন্তা মানুষকে কিছু করতে বলে, আমি আপনি সেই চিন্তাকে লালন করিনি। সেই স্বাধীন চিন্তার সামাজিক বিস্তারে কোনও ভূমিকা নিইনি।
তাই অল্পসংখ্যক মানুষ যাঁরা মর্যাদা নিয়ে চলেন তাঁদের এ দুর্গতি। বড় অংশের মানুষকে তাঁরা সাথে পাননি, তাই এ দুর্গতি। মৌলবাদী চিন্তা যা শাসক শ্রেণির হাতে মহা অস্ত্র, বাধাহীনভাবে তা ধারালো হচ্ছে। ক্ষুধা-দারিদ্র-বেকারিত্ব-লাঞ্ছনা-অপমানের বাস্তবতাকে ‘উন্নয়ন’ ‘ত্যাগ’ ‘কৃচ্ছসাধন’ ‘দেশপ্রেম’ এমন নানা নামের আড়ালে ঢেকে দেওয়া যাচ্ছে। চিন্তাটা আসলে এখানেই। এইখানে এসে বিলকিস বানোরা প্রতিদিন ধর্ষিতা হচ্ছেন, দেশের লক্ষ কোটি সাধারণ মানুষ প্রতিদিন নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যদি একবার সবাই মিলে ওই ভারি কালো পর্দাটাকে হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে দিতে পারি, সত্যের আলো এসে ঘুচিয়ে দেবে সব মলিনতার অন্ধকারকে। হাজার হাজার প্রশ্ন এসে ভিড় করে দাঁড়াবে। শত শত বিলকিস সুস্থভাবে বাঁচার অধিকার চাইবে। দাবি জানাবে, ‘আমাদের নির্ভয়ে বাঁচবার অধিকার দিন।’ সমাজ বদলের লড়াইয়ে সামিল হয়েই মিলতে পারে সেই অধিকার!