সংসদের সদ্যসমাপ্ত বাদল অধিবেশনে সরকার ও বিরোধী পক্ষের দ্বারা যা ঘটেছে, তা গণতন্ত্রের কলঙ্ক। এমনকি সংবাদপত্রও বলেছে, ভারতীয় সংসদ গণতন্ত্র-ভ্রষ্ট হইয়াছে।
কী করেছে সরকার পক্ষ বিজেপি? সংসদে অনেকগুলি বিল পাস করিয়েছে, যেগুলো নিয়ে কোনও আলোচনা, তর্ক বিতর্ক কিছুই করতে দেওয়া হয়নি। অথচ, তর্ক বিতর্ক, আলাপ আলোচনা হল গণতন্ত্রের প্রাণ। নিতান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে, বিরোধী সদস্যদের আলোচনার দাবিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কৌশলে আইন পাস করিয়ে দেওয়ার যে ঘৃণ্য নজির রচিত হল তা গণতন্ত্রের পক্ষে বড় বিপদ।
বিরোধী পক্ষের ভূমিকা কী? তাঁরাও সাধারণ মানুষের পক্ষ নিয়ে ওই সব আইন তৈরির পিছনে সরকার পক্ষের যড়যন্ত্র উদঘাটিত করে কোনও বলিষ্ঠ বক্তব্য রাখেননি। শুধুমাত্র হৈ হট্টগোল করেই সময় পার করে দিয়েছেন। দিনের পর দিন অধিবেশন ভণ্ডুল করে দিয়েছেন, যা শাসক দলকে কৌশলে বিল পাশেরই সুযোগ করে দিয়েছে।
শুধু এবারই প্রথম নয়, নরেন্দ্র মোদির সাত বছরের শাসনে বহুবার সংসদে বিতর্ক ছাড়াই বিল পাশ করানো হয়েছে। বিরোধীদের প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়াই প্রধানমন্ত্রী মোদির বরাবরের বৈশিষ্ট্য। তিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন না, তাদের প্রশ্ন শোনেন না, উত্তর দেওয়ার তো বালাই-ই নেই। যে সংসদকে একদিন গণতন্তে্রর মন্দির বলে মাথা ঠুকেছিলেন সেই সংসদেও একই ভূমিকা। গণতন্ত্রকে মূল্য দিয়ে তিনি বিতর্ককে স্বাগত জানান না। পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে কখনও বিতর্ক হলে তাতে তিনি অংশগ্রহণ করেন না। সরকার পক্ষের প্রধান হিসেবে জবাবি ভাষণ দেন না। কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া বা প্রসঙ্গ এড়িয়ে ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া– এভাবেই তিনি সংসদে আচরণ করছেন এবং সংসদের গুরুত্বকে খাটো করছেন। শুধু তাই নয়, প্রশ্ন অপ্রিয় হলে তাকে দেশদ্রোহী হিসেবে দাগিয়ে দিতেও অতি পারদর্শী। বিরোধীরা বহুবার দাবি করলেও কৃষি বিল নিয়ে আলোচনার ব্যবস্থা করেননি। সাম্প্রতিক কালে বহু আলোচিত ফোনে আড়িপাতার পেগাসাস কাণ্ডকে কেন্দ্র করে ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করার বিষয়ে বিতর্কও উপেক্ষা করেছেন তিনি।
বির্তক এড়িয়ে বিল পাশের নজির বিজেপি শাসনে ব্যাপক রূপ নিলেও, কংগ্রেস শাসনেও এ জিনিস দেখা গেছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ধারক বাহক সব দলই কম-বেশি এই অগণতান্ত্রিক ধারা বহন করছে। কেন সংসদের মতো একটা উচ্চতম প্রতিষ্ঠানে এভাবে গণতন্ত্র খর্ব হচ্ছে? পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শুরুর দিকে সংসদে যতটুকু গণতন্ত্রের চর্চা হত কেন তার বিলুপ্তি ঘটছে? এর কারণ হল পুঁজির কেন্দ্রীকরণ। পুঁজি যত কেন্দ্রীভূত হচ্ছে, একচেটিয়া রূপ নিচ্ছে, তত তার আধিপত্যবাদী ক্ষমতা বাড়ছে, তত সে আগ্রাসী হচ্ছে, তত সে সমালোচনা গণতান্ত্রিক বিতর্ককে পদদলিত করছে, তত সে বিতর্কের প্রতিষ্ঠান সংসদকেও ঠুঁটো করে রাখছে। অর্থনীতিতে মনোপলি বা একচেটিয়া রূপ এলে তার উপরকাঠামো হিসাবে রাজনীতিতেও একদলীয় আধিপত্য কায়েম হয়, বিপন্ন হয় বহুদলীয় গণতন্ত্র। পার্লামেন্ট একচেটিয়া পুঁজির দাসত্ব করে ও প্রশাসন হয়ে ওঠে ফ্যাসিস্টিক। পুঁজিবাদ বিকাশের পথে একচেটিয়া রূপ নেয়, সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র অর্জন করে, অন্য দেশকে পদানত করে, নিজ দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকেও হরণ করে, প্রয়োজন হলে সংসদকে রবার স্ট্যাম্পের মতো ব্যবহার করে। সেটাই নগ্ন রূপে ঘটল এবার সংসদের বাদল অধিবেশনে।