ভারতে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ নামে যে আইনটি এখন চালু আছে তা ভারতীয়দের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দমন করার জন্য ব্রিটিশ শাসকরা তৈরি করেছিল। সেই আইন যা দেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতিল হওয়া দরকার ছিল, তা স্বাধীন ভারতের শাসকেরা ব্রিটিশ শাসকদের মতোই দেশবাসীর ক্ষোভ-বিক্ষোভ দমন করতে লাগাতার ব্যবহার করে এসেছে। বিজেপি শাসিত ভারতে এই দণ্ডবিধির ১২৪এ ধারা তথা ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ আইনের যথেচ্ছ ব্যবহার এমনই বাড়াবাড়ির স্তরে পৌঁছেছে, যাতে মনে হবে বিজেপি দলটিই বুঝি রাষ্ট্র, এবং এই দলের নেতারা সব রাষ্ট্রের এক একজন স্তম্ভ। আর, দেশের নাগরিকরা সব বিজেপি নেতাদের প্রজা। নেতাদের অপকর্মের বিরোধিতাই রাজদ্রোহ। স্বাভাবিক ভাবেই সমাজের নানা স্তর থেকে বিজেপি সরকারের এই স্বৈরাচারী আচরণের বিরোধিতা শুরু হয়। বিরোধিতার পাশাপাশি নানা ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয় যাতে কোর্ট ব্রিটিশ শাসকদের তৈরি দমনমূলক এই আইনটি বাতিল করে স্বাধীন ভারতে নাগরিকদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারকে যোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে।
১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের পর শঙ্কিত ব্রিটিশ সরকার ১৮৭০ সালে কুখ্যাত ‘সিডিশন’ বা রাজদ্রোহ আইন প্রণয়ন করে। যার বলে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর আন্দোলন দূরে থাক এমনকি যে কোনও রকম সমালোচনা করার অধিকারও তারা কেড়ে নেয়। এই আইনের বলে কোনও রকম বক্তব্যে, লেখায় বা কাজে সরকারের প্রতি আনুগত্যহীনতা বা সরকার বিরোধিতা প্রকাশ পেলেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে তিন বছর থেকে যাবজ্জীবন পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া চলে। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এই আইনকে নির্বিচারে প্রয়োগ করে ব্র্রিটিশ রাজশক্তি ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর যে নির্মম দমনপীড়ন চালায় তা আজ ইতিহাস। গান্ধীজি, নেতাজি, বালগঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রাই, ভগৎ সিংয়ের মতো সর্বভারতীয় স্তরের নেতা সহ একেবারে স্থানীয় স্তরের স্বদেশি বিপ্লবীদেরও ‘রাজদ্রোহ’ অজুহাতে বিনা বিচারে ইচ্ছামতো কারারুদ্ধ করেছে ব্রিটিশ সরকার। এমনকি শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ উপন্যাস, নজরুলের কবিতা, প্রেমচন্দের গল্প, মুকুন্দদাসের গানের মতো যে কোনও রচনা, সঙ্গীত, সাধারণ সভা সমিতির বক্তব্য সমস্ত কিছুকেই ‘সিডিশাস’ ছাপ মেরে নিষিদ্ধ করে দেওয়া এবং সংশ্লিষ্ট লেখক, শিল্পী, বক্তাদের কারারুদ্ধ করা ছিল ব্রিটিশ শাসনকালে নিত্যদিনের ঘটনা।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের শাসক বুর্জোয়া শ্রেণি কিন্তু এই চূড়ান্ত স্বৈরাচারী আইনটিকে বাতিল করল না, নানা কথার ছলে আইনটিকে চালু রেখে দিল। কোর্টে আবেদনকারীদের বক্তব্য, এমন একটি আইন যা বিদেশি শাসকরা স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমন করার জন্য তৈরি করেছিল, স্বাধীন ভারতে সেই আইন চালু রাখা মানেই তা নাগরিক স্বাধীনতার পরিপন্থী। অবিলম্বে তা বাতিল করা হোক। আবেদনে এ-ও উল্লেখ করা হয়েছে, স্বাধীন ভারতে যারা যখন শাসন ক্ষমতায় বসেছে তারা প্রত্যেকে আইনটি বিদেশি শাসকদের মতোই দেশের জনসাধারণ এবং বিরোধী দলগুলির বিরোধিতা-বিক্ষোভ স্তব্ধ করতে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে চলেছে। বিজেপি শাসনে এর অপব্যবহার মাত্রাছাড়া আকার নিয়েছে।
এই অবস্থায় সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারের মত জানতে চায়। উত্তরে কেন্দ্রীয় সরকার রাষ্ট্রদ্রোহ আইনটি যেমন আছে তেমন অবস্থাতেই রাখার পক্ষে সওয়াল করে। বলে, আইনের অপব্যবহারের অভিযোগ কোনও ভাবেই সাংবিধানিক বেঞ্চের রায় পুনর্বিবেচনা করার যুক্তি হতে পারে না। আইনের অপব্যবহার রোখার উপায় হল, প্রতিটি অভিযোগকে আলাদা আলাদা ভাবে বিচার করা। যদিও কেন তাঁরা এই আইনের অপব্যবহার এতদিন রোখেননি, কেন প্রতিটি অভিযোগকে আলাদা আলাদা ভাবে বিচার করেননি, কেন অভিযুক্তরা বিনা বিচারে বছরের পর বছর জেলে বন্দি থেকেছেন তার কোনও উত্তর দেননি। উল্লেখ্য, ১৯৬২ সালে এক মামলার বিচার উপলক্ষে পাঁচজন বিচারকের সাংবিধানিক বেঞ্চ এই আইনটিকে বহাল রাখে। যদিও রায়ে বলা হয় একমাত্র হিংসায় উস্কানি কিংবা জনজীবনে বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টার ক্ষেত্রেই এই আইনকে ব্যবহার করা যাবে, নিছক সরকারের সমালোচনা কখনও দেশদ্রোহ হিসাবে বিবেচিত হবে না।
প্রথমে আইনটিকে আগের অবস্থাতেই বজায় রাখার পক্ষে সওয়াল করলেও পরে মোদি সরকারের মনে হয়, সুপ্রিম কোর্ট আইনটি বাতিলের ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে দিতে পারে। এই আশঙ্কা থেকেই সরকার তড়িঘড়ি আগের মত পাল্টে কোর্টকে জানায়, রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের কিছু অংশ পরীক্ষা ও পুনর্বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। উপযুক্ত ফোরামে বিষয়টি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তার আগে যেন আদালত কোনও সিদ্ধান্ত ঘোষণা না করে। কিন্তু এই পর্যালোচনা কত দিনে শেষ হবে, কারা তা করবেন, ততদিন আইনটি কী অবস্থায় থাকবে, সবচেয়ে বড় কথা, সরকার এই আইন বাতিল করার লক্ষে্যই এই পর্যালোচনা চায় কি না, এ সবের কোনও কিছুই সরকার জানায়নি। বিজেপি সরকারের যা চরিত্র এবং ইতিহাস তাতে স্বাভাবিক ভাবেই কারও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, পর্যালোচনার ছলে বিষয়টিকে আপাতত ধামাচাপা দেওয়া এবং সুপ্রিম কোর্টের হাত থেকে নিজেদের হাতে নিয়ে নেওয়াই এই ঘোষণার উদ্দেশ্য। কিন্তু শাসক বিজেপির এই চাল ব্যর্থ হয়ে যায় যখন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণার নেতৃত্বাধীন তিন জন বিচারপতির বেঞ্চ ঘোষণা করে যে, যত দিন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের পুনর্বিবেচনা না করছে তত দিন কেন্দ্র বা রাজ্য ওই আইনে এফআইআর দায়ের করবে না। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন তথা ১২৪এ ধারায় যে সব মামলা দায়ের হয়েছে সেগুলিরও তদন্ত বন্ধ থাকবে। কোনও গ্রেফতারি বা দমনমূলক পদক্ষেপ করা যাবে না। এই আইনে অভিযুক্তরা জামিনের আবেদন করতে পারবেন।
এ বার দেখা যাক, স্বাধীনতার পরেও রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের অপব্যবহার কেমন হারে ঘটে চলেছে এবং বিজেপি শাসনে তা কোন মাত্রায় পৌঁছেছে। বর্তমানে সারা দেশে ৮০০টিরও বেশি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় প্রায় ১৩ হাজার মানুষ জেলবন্দি। ন্যাশনাল ক্রাইমস রেকর্ড বুরো সহ বিভিন্ন সংস্থার তথ্য বলছে, ২০১০ সাল থেকে ১০,৯৩৮ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ দায়ের হয়েছে। এঁদের প্রায় ৬৫ শতাংশের বিরুদ্ধে মামলা হয় ২০১৪ সালে কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরে। রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে গত ছ’বছরে গ্রেফতার হয়েছে ৫৪৮ জন। কিন্তু মাত্র সাতটি মামলায় ধৃত ১২ জন দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৪৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা প্রধানমন্ত্রী মোদির সমালোচনা করেছেন এবং ১৪৪ জন উত্তরপ্রদেশ মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সমালোচনা করে অভিযুক্ত হয়েছেন। বুঝতে অসুবিধা হয় না, বিরোধী কণ্ঠকে স্তব্ধ করা ছাড়া এই আইন প্রয়োগের অন্য কোনও উদ্দেশ্যই নেই।
কি কেন্দ্রে, কি বিভিন্ন রাজ্যে যেখানে যখন যে দল সরকারে থেকেছে সেই দলই বিরুদ্ধ কণ্ঠ রোধ করার জন্য এই আইন প্রয়োগ করে অপছন্দের লোককে ‘সিডিশাস’ ছাপ মেরে জেলে ভরে দিয়েছে। ১৯৭৩-এ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার ১২৪এ ধারা প্রয়োগ করে বিনা ওয়ারেন্টে বিরোধীদের গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা পুলিশের হাতে তুলে দেয়। তখন থেকে কংগ্রেস সরকার যতদিন কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল, বিচ্ছিন্নতাবাদ, উগ্রপন্থা প্রভৃতি দমনের অজুহাতে বহু ব্যক্তিকে এই আইনে গ্রেপ্তার করেছে এবং পরে টাডা, ইউএপিএ প্রভৃতি আরও বেশি দমনমূলক আইন প্রণয়ন করেছে। কিন্তু ২০১৪তে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পরে এই ‘সিডিশন’ আইনের অপব্যবহার মাত্রাছাড়া হয়ে যায়।
১২৪এ ধারায় যেসব অভিযোগে মোদি সরকার সাম্প্রতিক কালে বিভিন্ন ব্যক্তিকে কারারুদ্ধ করেছে তার কয়েকটি উদাহরণ দেখলে চমকে উঠতে হয়। এটা একটা গণতান্ত্রিক দেশ না মধ্যযুগের রাজাবাদশাদের মুলুক, বোঝা যায় না। গত বছর আগ্রায় তিনজন কাশ্মীরি ছাত্রকে এই আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ক্রিকেট খেলায় পাকিস্তান জেতায় আনন্দ প্রকাশ করে সোসাল মিডিয়ায় পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে। ২০১৮ সালে মণিপুরের সাংবাদিক ওয়াংখেম সোসাল মিডিয়ায় নরেন্দ্র মোদি, আরএসএস এবং রাজ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সমালোচনা করেছিলেন বলে মণিপুর রাজ্যের বিজেপি সরকার তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে গ্রেপ্তার করে। একই ভাবে প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সমালোচনা করায় উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন রাজ্যপাল আজিজ কুরেশিও অভিযুক্ত হয়েছেন। সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান হাথরসে এক মহিলার ধর্ষণ ও খুন করে জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনার সংবাদ করতে যাওয়ার পথেই গ্রেফতার করে দেশদ্রোহ আইনে জেলে ভরা হয়েছিল। এখনও তিনি জেলেই আছেন। তাঁর মতো আরও ১৩ জন সাংবাদিক এখন জেলে রয়েছেন। কংগ্রেস সরকারও পিছিয়ে নেই। ছত্তিশগড়ের কংগ্রেস সরকার এক প্রাক্তন পুলিশ অফিসারকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে গ্রেপ্তার করেছে, কারণ তিনি সরকারের বিরুদ্ধে ‘উত্তেজক’ লেখা লিখেছেন। তামিলনাডুতে ‘তামিল দিবস’ উদযাপন অনুষ্ঠানে ‘তামিল পতাকা’ তোলার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সীমান নামে তামিল নেতাকে। ২০১৯-এ পুলওয়ামায় সেনা কনভয়ে বিস্ফোরণের ঘটনার পর সোসাল মিডিয়ায় যেসব তর্কবিতর্ক হয়েছিল তার মধ্যে ২৬ জনের বিরুদ্ধে ‘পাকিস্তানের পক্ষে’ এবং ‘দেশবিরোধী’ মতামত প্রকাশ করেছেন সন্দেহে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ করা হয়। সিএএ বিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলনকারীদের মধ্যে ৩৭৫৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ করা হয়েছে। ২০১৮তে ঝাড়খণ্ডে আদিবাসীরা নিজেদের জমি জায়গা রক্ষায় পাথালগড়ি আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধেও এই আইন ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল। বাস্তবে এগুলির কোনওটিই যে রাষ্ট্রদ্রোহ নয়, সরকারের জনস্বার্থ বিরোধী নীতির প্রতিবাদ, তা বোঝা খুবই সহজ।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এমন একটি স্বৈরাচারী আইন স্বাধীন ভারতে থেকে গেল কী করে? ভারত রাষ্টে্রর জন্মের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ব্রিটিশ শাসিত ঔপনিবেশিক ভারত রাষ্ট্রটি তৈরিই হয়েছিল ভারতীয় সম্পদ লুঠ করার এবং তার বিরুদ্ধে যে কোনও প্রতিবাদ দমন করার যন্ত্র হিসাবেই। ফ্রান্স জার্মানি আমেরিকায় যে ভাবে সংগ্রামের পথে গণতান্ত্রিক রাষ্টে্রর অভ্যুত্থান ঘটেছিল, ভারতে তা হয়নি। আপসের পথে ব্রিটিশ শাসিত রাষ্ট্রটিই দেশীয় পুঁজিপতিদের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে মাত্র। স্বাভাবিক ভাবেই ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণির নির্মম শোষণ-নিপীড়নের হাতিয়ার হিসাবেই তা থেকে গেছে। তাই পুঁজিপতি শ্রেণির সেবক সব দলই ক্ষমতাসীন থাকার জন্য এই কুৎসিত কালা আইনটিকে অক্ষত রেখেই তার সুবিধা নিয়ে থাকে।
শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি এবং তাদের রাজনৈতিক ম্যানেজার শাসক দলগুলি দেশের মানুষকে এ কথা ভুলিয়ে দিতে চায় যে, রাষ্ট্র আর সরকার এক নয়। সরকার হল রাষ্ট্র নামক ব্যবস্থাটির পরিচালক। সরকারি নীতির বিরোধিতা করা, শাসক নেতা-মন্ত্রীদের দুর্নীতি-স্বৈরাচারের বিরোধিতা কিংবা প্রতিবাদ করা মানে রাষ্টে্রর বিরোধিতা করা নয়। সরকারের যে কোনও নীতি বা পদক্ষেপ নাগরিকদের অপছন্দ হলে তার বিরোধিতা করা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু যেহেতু বর্তমানে সমস্ত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রই গণতান্ত্রিক চরিত্র হারিয়ে ফ্যাসিবাদী চরিত্র অর্জন করেছে, তাই নাগরিকদের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকারও আজ কোনও সরকার দিতে রাজি নয়। অথচ পুঁজিবাদী অপশাসনে দেশের নাগরিকদের ক্ষোভ বাড়তেই থাকবে এবং উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে তা মাঝে মাঝেই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ফেটে পড়বে। মানুষের এই প্রতিবাদ, আন্দোলন দমন করতে ধূর্ত শাসক শ্রেণি এগুলিকে দেশদ্রোহিতা, দেশবিরোধিতা হিসাবে তুলে ধরে। এগুলির বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের আইন প্রয়োগ করে। স্বাভাবিক ভাবেই দেশের জনগণের পক্ষ থেকে বিদেশি শাসক ব্রিটিশের তৈরি দেশদ্রোহের কালা আইন বাতিলের দাবি অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত।
বিশ্বপুঁজিবাদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে ভারতীয় পুঁজিবাদী রাষ্ট্রও আজ গভীর সংকটে আক্রান্ত। দেশবাসীর ওপর বেপরোয়া লুট চালিয়ে তারা একদিকে টাকার পাহাড়ের উচ্চতায় ইউরোপ আমেরিকার ধনকুবেরদের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে, অন্য দিকে, সমস্ত দমন, নিপীড়ন, বিভেদ বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। আশার কথা, এ সব উপেক্ষা করেই নিপীড়িত মানুষ প্রতিবাদ আন্দোলনে ক্রমাগত বেশি বেশি করে সংগঠিত হচ্ছে। ঐতিহাসিক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কৃষক আন্দোলন সরকারকে মাথা নত করতে বাধ্য করেছে। এমনকি রাজনীতি নিরপেক্ষ সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী সহ সাধারণ মানুষও সোসাল মিডিয়ায়, পত্রপত্রিকায় সরকারের নির্লজ্জ কর্পোরেট তোষণনীতি, লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মীয় অন্ধতা, সামাজিক বিদ্বেষ, নারীধর্ষণ প্রভৃতির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ মত ব্যক্ত করছেন। বিজেপি জানে যে, এইসব প্রতিবাদীরা একটি যথার্থ নেতৃত্বে যে কোনও দিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াইয়ের ময়দানে নেমে যেতে পারে এবং তখন তার ধাক্কা সামলানো পুলিশ প্রশাসন বা আরএসএস বাহিনীর সাধ্যাতীত। তাই তারা দেশ জুড়ে জনসাধারণের মধ্যে হিটলারি জমানা বা ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার মতো একটা ভীতির পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে। জনসাধারণকে বার্তা দিতে চাইছে, মুখ বুজে সব মেনে নাও, না হলেই সর্বনাশ। টুঁ শব্দটি করলেই জেলে ভরে দেওয়া হবে।
অবশ্য পৃথিবীর সব দেশে সব যুগেই ফ্যাসিস্ট শাসকরা জনশক্তির থেকে নিজেদের অত্যাচার নিপীড়নের শক্তিকে বড় বলে মনে করেছে এবং সেটাই তাদের পতনের কারণ হয়েছে। হিটলার, মুসোলিনি, ইন্দিরা গান্ধী কেউই শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাননি। ফ্যাসিস্ট মোদি সরকারকেও শেষ পর্যন্ত মাথা নত করতে হবে। কিন্তু তার জন্য শুধু আদালতের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না, কারণ এই সরকার একদিকে যেমন আদালতকেও তোয়াক্কা করে না, তেমনই একটি স্বৈরাচারী সরকার সব সময় চেষ্টা করে বিচারব্যবস্থাকেও তাদের হুকুমদার হিসাবে ব্যবহার করতে। তা ছাড়া সর্বস্তরের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের সংগঠিত গণআন্দোলন জোরদার হলে তা বিচারব্যবস্থাকেও নিরপেক্ষ আচরণের সাহস জোগায়। তাই এই ঔপনিবেশিক ঘৃণ্য আইন প্রত্যাহারে সরকারকে বাধ্য করতে সব স্তরের মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস অত্যন্ত জরুরি।