এ বছর ছোটনাগপুরের সামন্ততন্ত্র ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আদিবাসী কৃষক বিদ্রোহ ‘উলগুলান’-এর অবিসংবাদী নেতা শহিদ বিরসা মুন্ডার ৯ জুন থেকে ১২৫তম মৃত্যুবার্ষিকী শুরু হয়েছে। এ বছর ১৫ নভেম্বর শুরু হচ্ছে ১৫০তম জন্মবার্ষিকী। এই সময়েই দেশ চলেছে প্রধানমন্ত্রী কল্পিত ‘অমৃতকাল’-এর মধ্য দিয়ে। আজও এ দেশে আদিবাসী ও গরিব মানুষের এক বিশাল অংশকে জীবন ধারণের জন্য জঙ্গলের উপর নির্ভর করতে হয়। অথচ জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল এমন কয়েক লক্ষ আদিবাসী ও বনবাসী পরিবার জঙ্গলের অধিকার আইনের উপর সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ফলে ভিটেমাটি ও চাষের জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে উদ্বাস্তু হওয়ার মুখে দাঁড়িয়ে। উন্নয়নমূলক কাজের নামে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল এবং জঙ্গল ও তৎসংলগ্ন এলাকা থেকে ইতিমধ্যেই এক কোটির বেশি আদিবাসী ও গরিব মানুষ নিজেদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে। তারা যথাযথ পরিমাণে ক্ষতিপূরণও পায়নি যার সাহায্যে নিজেদের ভালভাবে পুনর্বাসিত করতে পারে। তাদের অধিকাংশই এখন দিনমজুর বা পরিযায়ী শ্রমিক। অনেকেই শহরের ফুটপাথের বাসিন্দা।
বর্তমানেও জঙ্গল ও তৎসংলগ্ন এলাকার গরিব সাধারণ জনগণ জীবন-জীবিকার জন্য জঙ্গলের উপর গভীরভাবে নির্ভরশীল। সাংস্কৃতিক ও পরম্পরাগত সম্পৃক্ততা এবং নিজস্ব স্বার্থবোধ থেকেই তারা জঙ্গলকে রক্ষা করে আসছে। জঙ্গল ও তৎসংলগ্ন এলাকার ৯০ শতাংশ গরিব মানুষ বেঁচে থাকার প্রয়োজনে জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল।
ব্রিটিশ আমলে বনজ দ্রব্য থেকে মুনাফা অর্জনের জন্য বৃহৎ ব্যবসায়ী ও তাদের স্বার্থরক্ষাকারী সরকারি কর্তৃপক্ষের হাতে জঙ্গল ধ্বংস শুরু হয়ে এখনও পর্যন্ত চলেছে। ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ভারতে ২৩ লক্ষ হেক্টর বনাঞ্চল হারিয়ে গেছে (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮ মে ২০২৪)। গত ২৬ জুলাই ২০২৩ বন (সংরক্ষণ) সংশোধনী বিল-২০২৩ সংসদের বাদল অধিবেশনে লোকসভায় পাশ করিয়ে নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। আইনে পরিণত হওয়ার সাথে সাথেই (১২ আগস্ট, ২০২৩) ওড়িশার রায়গদা জেলার সিজিমালি পাহাড়ে বেদান্ত গোষ্ঠী বনভূমির দখল নিতে যায়। অপর এক প্রকল্পের জন্য আদানি গোষ্ঠী ওড়িশার রায়গড়া ও কালাহান্ডি জেলার কুত্রুমালি পাহাড়ে বনভূমির দখল নেওয়ার চেষ্টা করে। গ্রামবাসীরা প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে এবং বনভূমি ধ্বংস রুখে দেয়। ছত্তিশগড়ের হসদেও জঙ্গল ধ্বংসের কথা এবং স্থানীয় আদিবাসী ও গরিব গ্রামবাসীদের প্রতিরোধের কথা বহুল প্রচারিত ঘটনা। ২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ভারতে মোট বৃক্ষ অঞ্চলের ক্ষতির ৯৫ শতাংশ প্রাকৃতিক বনভূমির মধ্যে ঘটেছে (গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ রিপোর্ট, খান গ্লোবাল স্টাডিজ, ২২এপ্রিল ২০২৪)।
বনাঞ্চলের সংকুচিত হওয়া একটি বিশ্বব্যাপী ঘটনা। পৃথিবী জুড়ে ‘‘১৯৯০-২০১০ এর মধ্যে বছরে গড়ে ১৫.৫ মিলিয়ন হেক্টর, ২০১০-২০১৫ এর মধ্যে গড়ে ১২ মিলিয়ন হেক্টর বন, ২০১৫-২০২০ এর মধ্যে প্রতি বছর গড়ে ১০ মিলিয়ন হেক্টর় বন ধ্বংস হয়েছে।’’ (ফরেস্টেশন ফ্যাক্টস অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্ট’ ২০২৪ (গ্লোবাল ডেটা) ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, টোনার বাজ)। ‘‘বন ধ্বংসের চারটি প্রধান কারণ হল– ১) কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বাড়ি তৈরির জন্য। ২) কৃষিজমির জন্য জঙ্গল সাফ করা হয়েছে। (এর মধ্যে রয়েছে কৃষি-সম্পর্কিত শিল্প, যেমন পেপার মিল এবং চিনি শোধনাগার)। ৩) গবাদি পশুর জন্য চারণভূমি তৈরি করতে বন পরিষ্কার করা হয়েছে। ৪) দাবানলে পুড়ে যাওয়া বন।’’ (ওই)।
বিশ্বব্যাপী বন ধ্বংসের বিরুদ্ধে আন্দোলন বিস্তৃতি পাচ্ছে ও শক্তিশালী হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত প্রধানত দরিদ্র বনবাসী এবং আদিবাসীরাই প্রতিবাদ করছেন, আন্দোলন গড়ে তুলছেন। পরিবেশকর্মী ও পরিবেশ সচেতন নাগরিক যারা কর্পোরেটদের মুনাফার লালসা থেকে জঙ্গলকে রক্ষার আন্দোলন গড়ে তুলছেন তাঁরা এই আন্দোলনকেও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার অন্দোলনের পরিপূরক আন্দোলন হিসাবে সবদিক থেকে সাহায্য করছেন। বিরসা মুন্ডার জীবন-সংগ্রাম আদিবাসী, চিরাচরিত বনবাসীদের অধিকার রক্ষার আন্দোলনের সৈনিকদের প্রেরণার উৎস। সাথে সাথে পরিবেশকম¹ ও পরিবেশ সচেতন নাগরিকদের কাছেও বিরসা মুন্ডার জীবন-সংগ্রাম অত্যন্ত প্রেরণাদায়ক। বিরসা মুন্ডার ১২৫তম মৃত্যুবার্ষিকী এবং ১৫০ তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর জীবন-সংগ্রামকে জল-জমি-জঙ্গল রক্ষার মধ্য দিয়ে পরিবেশ রক্ষা তথা মানবসভ্যতা রক্ষার সংগ্রামে পরিণত করার ডাক দিয়েছে জন অধিকার সুরক্ষা কমিটি সহ জঙ্গলবাসী ও জঙ্গল রক্ষার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা।