সিপিএম–কংগ্রেস জমানার পরম্পরায় বিরোধী–শূন্য পঞ্চায়েত গড়ার প্রহসনে নেমেছে তৃণমূল৷ মনোনয়ন পত্র পেশের একেবারে প্রথম দিন থেকেই যে বর্বর সন্ত্রাস তারা চালিয়েছে তা নজিরবিহীন৷
তৃণমূল নেত্রী ডাক দিয়েছেন বিরোধী–শূন্য পঞ্চায়েত গড়তে হবে৷ তাঁর কথাকে লুফে নিয়ে তাঁর দলের নেতারা বিরোধী–শূন্য পঞ্চায়েতের জন্য নানা পুরস্কারের ঘোষণা পর্যন্ত করে ফেলেছেন৷ আর কাটমানি, চুরি–দুর্নীতির ভাগ পাওয়ার আশায় নেতৃত্বের এই সব কথার সঠিক পাঠ নিতে তৃণমূল আশ্রিত মস্তান বাহিনী ভুল করেনি৷ রাজ্যের প্রায় সর্বত্র বিডিও, এসডিও অফিসগুলিতে বিরোধী দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন পত্র তোলা বা জমা দেওয়ার কাজে ঢুকতেই দেয়নি৷ তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি হুঙ্কার দিয়েছেন, তাঁদের টাঙানো মশারির ফাঁক গলে কোনও বিরোধী মনোনয়নের মশা গলতে পারবে না৷ এত ব্যাপক ‘উন্নয়ন’ যে রাস্তায় বিরোধীদের আটকাতে নাকি ‘উন্নয়নই’ দাঁড়িয়ে আছে অবশ্য হাতে পিস্তল, রাইফেল, পাইপগান, লাঠি, ছুরি, বল্লম কিংবা বোমা নিয়ে কেমন ধরনের ‘উন্নয়ন’ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, তা জনগণ স্বচক্ষে দেখছেন৷ মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে নিহতের সংখ্যা গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সন্ত্রাসে নিহতের সংখ্যাকে ছাপিয়ে গেছে৷ আহত, রক্তাক্ত সহস্রাধিক মানুষ৷ পুলিশ শুধু নীরব দর্শক নয়, শাসক দলের আজ্ঞাবহ হিসাবে বিরোধীদের আটকাতেই ব্যস্ত থেকেছে৷ শাসক দলের গুন্ডা বাহিনী এস ইউ সি আই (সি) সহ যে কোনও বিরোধী দলের লোক দেখলেই লাঠি, বোমা, বন্দুক নিয়ে চড়াও হয়েছে, পুলিশ দাঁড়িয়ে দেখেছে মাত্র৷ সাংবাদিকদের রক্ত ঝরতে দেখেও একচুল এগিয়ে দুষ্কৃতী বাহিনীকে দমন করেনি পুলিশ৷ থানা আর তৃণমূলের পার্টি অফিসের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷
রাজ্যে নির্বাচন কমিশন নামক কিছু আছে বলে বোঝাই যাচ্ছে না৷ নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা তো অনেক বড় কথা, প্রতিদিনের রক্তপাত সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশনার শাসকদলের তোতাপাখির মতোই বলে চলেছেন সব সুষ্ঠুভাবে চলছে কিন্তু বলছেন না, যে ব্লকগুলিতে আদৌ বিরোধী কাউকে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি, সেখানে সমস্ত ইচ্ছুক প্রার্থীর মনোনয়ন জমা নেওয়ার ব্যবস্থা করার দায় তাঁরা নেবেন কি না? নির্বাচন কমিশন বলেছিল, বিডিও অফিসে কেউ মনোনয়ন দিতে না পারলে মহকুমা শাসকের অফিসে তা দিতে পারবে৷ অথচ, কি বিডিও অফিস, কি এসডিও অফিস সর্বত্রই তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা মারাত্মক অস্ত্র–শস্ত্র নিয়ে বিরোধী প্রার্থীদের তাড়া করেছে৷ নির্বাচনী অফিসার, রিটার্নিং অফিসারদের টেবিল ঘিরে তৃণমূলের বাহিনী বসে থেকেছে যাতে কোনও মতেই তারা ছাড়া অন্য কেউ মনোনয়নপত্র দিতে না পারে৷
বাঁকুড়া : খোদ সদর মহকুমা শাসকের অফিসের মধ্যে ৪ এপ্রিল এআরও টেবিলে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময়েই জেলা পরিষদে এস ইউ সি আই (সি) প্রার্থীকে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা মারধোর করে কাগজ ছিনিয়ে নেয়৷ তাদের মারে আহত প্রার্থীর প্রস্তাবককে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়৷ ওই অফিসের মধ্যেই মার খেয়েছেন দলের বাঁকুড়া শহর লোকাল কমিটির সম্পাদক শিশির কোলে৷ হেনস্থার শিকার হয়েছেন মনোনয়ন জমা দিতে যাওয়া মহিলা প্রার্থীরাও৷ বাঁকুড়ার ইন্দপুর, হিড়বাঁধ, শালতোড়া, সিমলাপাল ব্লক সহ নানা জায়াগায় এস ইউ সি আই (সি) প্রার্থীদের আক্রমণ করা হয়েছে৷ ছাতনায় জেলা পরিষদ প্রার্থী কৃপাসিন্ধু কর্মকারকেও সরকারি অফিসের মধ্যে নিগ্রহ করা হয়৷
পুরুলিয়া : কাশীপুরে ব্লক অফিসে মনোনয়নপত্র দিতে গেলে দলের কর্মীরা আক্রান্ত হন৷
কোচবিহার : দিনহাটাতে ৩ এপ্রিল ব্লক অফিসেই এস ইউ সি আই (সি)–এর মহিলা প্রার্থী কণা দাসের সঙ্গে অশালীন আচরণ করার পর তাঁকে জোর করে টোটোতে তুলে অপহরণের চেষ্টা করে তৃণমূল দুষ্কৃতীরা৷ তিনি চলন্ত গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়লে আহত হন, তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়৷ দিনহাটা এসডিও অফিসের মধ্যেই এস ইউ সি আই (সি) প্রার্থী মানিক বর্মন আক্রান্ত হন৷ এই জেলার সিতাই, শীতলকুচি, তুফানগঞ্জ, হলদিবাড়ি, কোচবিহার–১ ব্লক সহ জেলার সর্বত্রই মারাত্মক সন্ত্রাস চলছে৷ প্রার্থীদের বাড়িতে বাড়িতে হামলা হয়েছে৷
বীরভূম : ১৯টি ব্লক এবং সদর মহকুমা সহ তিনটি মহকুমা শাসকের অফিসই নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরুর প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত তৃণমূলের সশস্ত্র বাহিনীর দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে থেকেছে৷ মুরারই, সিউড়ি, নলহাটি, রামপুরহাটে ব্লক অফিসে পুলিশের সামনেই মার খেয়েছেন এস ইউ সি আই (সি) প্রার্থীরা৷ বীরভূমের জেলা শাসক এবং এসপি–র সঙ্গে দেখা করে দলের জেলা নেতৃত্ব নিরাপত্তার দাবি জানালে তাঁরাও অসহায়তার কথা জানান৷ ৭ এপ্রিল রামপুরহাটে এস ইউ সি আই (সি) প্রার্থীরা মিছিল করে এসডিও অফিসে যেতে চাইলে তাদের আটকেছে উচ্চপদস্থ অফিসারদের নেতৃত্বাধীন পুলিশ বাহিনী৷
পূর্ব বর্ধমান : আউসগ্রাম–১ ও ২–এর দু’জন জেলা পরিষদ প্রার্থী মনসা মেটে ও বোরহান মণ্ডলকে ৭ এপ্রিল জেলাশাসক দফতরের সামনে পুলিশের উপস্থিতিতে লাঠি–রড দিয়ে মেরে সমস্ত কাগজপত্র কেড়ে নেওয়া হয়৷
পশ্চিম বর্ধমান : ৯ এপ্রিল দুর্গাপুর এসডিও অফিসে প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে গেলে দলের জেলা কমিটির সদস্য কমরেড দনা গোস্বামীকে পুলিশের সামনেই তৃণমূল দুষ্কৃতীরা আক্রমণ করে এবং যথেচ্ছ ভাবে কিল–চড়–ঘুষি–লাথি মারতে থাকে৷ পরে আবার দলের প্রার্থী এবং তার প্রস্তাবক যখন নমিনেশনপত্র পূরণ করছিলেন তখন তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা তাঁদের হুমকি দেয়, তারা এসডিওকে নিরাপত্তার অভাবের কথা জানালেও তিনি কোনও রকম নিরাপত্তা দেওয়ার বদলে তাদের অফিসের পিছনের সিঁডি দিয়ে বের করে দেন৷ আসানসোল এসডিও অফিসে এসইউসিআই (সি) প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র তৃণমূলের বাহিনী ছিঁডে দেয়, ধাক্কাধাক্কি করে, জামা ছিঁডে দেয়, একজন কর্মীকে তুলে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে৷
মুর্শিদাবাদ : জেলার সুতি, লালবাগ, হরিহরপাড়া, কান্দি, নবগ্রাম, খড়গ্রাম সহ সর্বত্রই এস ইউ সি আই (সি) প্রার্থীদের উপর আক্রমণ হয়েছে৷ ডোমকলে মহকুমা শাসক অফিসে জেলা পরিষদ প্রার্থী সামসুজ্জামান কাজলকে মারতে মারতে দোতলা থেকে নিচে ফেলে দেয় তৃণমূল দুষ্কৃতী বাহিনী৷ ৯ এপ্রিল পঞ্চায়েত নির্বাচনের নমিনেশন জমা দেওয়ার শেষ দিনে জেলায় জেলায় ব্লক ও মহকুমা অফিসগুলিতে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীবাহিনী ভয়ঙ্কর সন্ত্রাস চালায়, বিরোধীদের মারধর করে তাড়িয়ে দেয়৷ বহরমপুরের সদর এসডিও দপ্তরে হরিহরপাড়ার এস ইউ সি আই (সি) সহ বিরোধী দলের শত শত প্রার্থী আগের রাত থেকে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন৷ সকালে তৃণমূলের দুষ্কৃতীবাহিনী পুলিশের সামনেই ব্যাপক মারধর করে সকলকেই তাড়িয়ে দেয়৷ পুলিশ ছিল নীরব দর্শক৷ এস ইউ সি আই (সি) নেত্রী পূর্ণিমা কর্মকার অফিসের ভিতরে গেলে পুলিশের সামনেই তাঁর ব্যাগ টেনে নিয়ে তল্লাশি করে দুষ্কৃতীরা এবং তাঁকে জোর করে বার করে দেয়৷ বহরমপুর ব্লক অফিসের ভিতর দুষ্কৃতীরা দলের মহিলা প্রার্থীর কাগজপত্র কেড়ে নিয়ে লাঞ্ছনা করতে করতে বের করে দেয়৷ ভগবানগোলা–১ ব্লকে দলের মহিলা প্রার্থীকে বি ডি ও অফিসের ভিতরে তৃণমূলের পুরুষ দুষ্কৃতীরা হেনস্থা করে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করে৷ বেলডাঙ্গা–১ ব্লকে দলের লোকাল কমিটির সম্পাদক বাবর আলিকে মারতে মারতে তৃণমূলের গুন্ডাবাহিনী ব্লক অফিস চত্বর থেকে তাড়িয়ে দেয়৷ জঙ্গীপুর মহকুমা জুড়ে তৃণমূলের দুষ্কৃতী বাহিনী এলাকায় এলাকায় এমন সন্ত্রাস চালায় যে প্রার্থীরা বাড়ি থেকে বের হতে পারেননি৷ একই অবস্থা কান্দি মহকুমা জুড়ে৷ শাসকদল আশ্রিত গুন্ডারা এসডিও বা বিডিও অফিসের ধারেকাছে যেতে দেয়নি প্রার্থীদের৷ এই জেলার সর্বত্র দলের প্রার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শাসক দলের সশস্ত্র বাহিনী সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে, হুমকি দিয়েছে, চড়াও হয়ে মারধর করেছে৷
দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা : ৬ এপ্রিল দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ডায়মন্ড হারবার এসডিও অফিসে এস ইউ সি আই (সি) প্রার্থীরা জেলা পরিষদে মনোনয়নপত্র জমা দিতে গেলে তৃণমূল সাংসদ চৌধুরী মোহন জাটুয়ার নেতৃত্বে সশস্ত্র তৃণমূল বাহিনী পুলিশের সামনেই তাদের উপর হামলা চালায়৷ মথুরাপুর কেন্দ্রের জেলা পরিষদ প্রার্থী শিক্ষক লক্ষ্মণচন্দ্র মণ্ডল, মন্দিরবাজার কেন্দ্রের প্রার্থী অরবিন্দ প্রামাণিক সহ পাঁচজন গুরুতর আহত হন৷ অরবিন্দ প্রামাণিককে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়৷ জেলাপরিষদে কুলপি কেন্দ্রের প্রার্থী গোলক মণ্ডলকে তৃণমূল বাহিনী জোর করে তুলে নিয়ে যায়৷ ৭ এপ্রিল এসডিও অফিস চত্বরেই দলের ডায়মন্ডহারবার লোকাল কমিটির সম্পাদক কমরেড গৌতম মণ্ডলকে ব্যাপক মারধোর করা হয়৷ পুলিশের উপস্থিতিতেই ডায়মন্ডহারবার কোর্ট ও প্রশাসনিক সমস্ত ভবনের দখল তৃণমূল বাহিনীর হাতে চলে যায়৷ বজবজ–২ ব্লক সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে রাখে তৃণমূল দুষ্কৃতী বাহিনী৷ প্রাক্তন পঞ্চায়েত সমিতি সদস্য বাসুদেব কাবড়িকে ব্লক অফিসের মধ্যেই হেনস্থা করে তারা৷ ৭ এপ্রিল নোদাখালি থানার আইসির কাছে দলের লোকাল কমিটির পক্ষ থেকে এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করা হলে তিনি বলেন আমার হাত পা বাঁধা, কিছু করা যাবে না৷ ৯ এপ্রিল জেলার প্রশাসনিক হেডকোয়ার্টার কলকাতার আলিপুরে প্রচুর পুলিশের উপস্থিতিতেই তৃণমূল যথেচ্ছ তাণ্ডব চালিয়েছে৷
পশ্চিম মেদিনীপুর : ৬ এপ্রিল পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালের মনোহরপুর পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থীরা আক্রান্ত হন বিডিও অফিসের মধ্যেই৷ টাকা জমা দিয়ে ডিসিআর কাটার পরেও তাঁদের সব কাগজ ছিঁড়ে দেওয়া হয়৷ ৩ এপ্রিল পিংলা ব্লক অফিসে এস ইউ সি আই (সি) প্রার্থীদের উপর আক্রমণ হয়৷
পূর্ব মেদিনীপুর : হলদিয়া এসডিও অফিসে নন্দীগ্রাম জমিরক্ষা আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা নন্দ পাত্রকে লাঞ্ছনা করা হয়৷ ৬ এপ্রিল পাঁশকুড়া ব্লক অফিসে তৃণমূল দুষ্কৃতীরা লাঠি–রড় নিয়ে এস ইউ সি আই (সি) কর্মীদের উপর আক্রমণ চালায়৷ বেশ কয়েকজন কর্মী জখম হন৷ ৯ এপ্রিল তমলুকে এসডিও অফিসের সামনেই বাঁশ নিয়ে এস ইউ সি আই (সি) কর্মীদের আক্রমণ করে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা৷ বিলাস বেরা, প্রতিমা অধিকারী গুরুতরভাবে আহত হন৷
উত্তর চব্বিশ পরগণা : সন্দেশখালিতে জেলা পরিষদ প্রার্থী হিসাবে ৫ এপ্রিল তন্ময় বাসুকী মনোনয়ন জমা দেন৷ পরদিন তৃণমূলের প্রায় ৪০ জনের সশস্ত্র বাহিনী তাঁর বাড়ি আক্রমণ করে এবং তাঁকে তৃণমূলের কালীনগর বাজার অফিসে তুলে নিয়ে যায়৷ তাঁর বাড়ির মহিলারা বাধা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হন৷
নদীয়া : ২ এপ্রিল নদীয়ার হরিণঘাটায় বাধা দেওয়া হয় এসইউসিআই (সি) প্রার্থীদের৷ ৯ এপ্রিল মহিষবাথানে করিমপুর–২ ব্লক অফিসে দলের প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে গেলে শাসক দলের দুষ্কৃতীরা তাঁদের উপর চড়াও হয়ে মারধর করে ও মনোনয়নপত্র ছিঁড়ে দেয়৷ চাপড়া ব্লকে চরম সন্ত্রাস সৃষ্টি করে তৃণমূল কংগ্রেস আশ্রিত দুষ্কৃতীরা এস ইউ সি আই (সি)–র কাউকেই মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেয়নি৷
সাধারণ মানুষের প্রশ্ন এই প্রবল সন্ত্রাস চালিয়ে তৃণমূল যে নজির সৃষ্টি করছে, তার পরবর্তী ফল কী? এ রাজ্যে বড় বিরোধী বলে পরিচিত সিপিএম তার পায়ের তলায় জমি হারিয়েছে৷ কংগ্রেসের অবস্থা আরও সঙ্গীন৷ সংবাদ মাধ্যমের প্রচারে বিজেপির ফানুস যত ফুলে ফেঁপে উঠুক না কেন, সংগঠনের জোর তার ধারে কাছে নেই৷ পুলিশ প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে, সশস্ত্র ভৈরব বাহিনীর বেপারোয়া আক্রমণে বিরোধীদের মনোনয়ন জমা দিতে না দিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বহু আসনে তৃণমূল জিতে গেছে৷ লোভ দেখিয়ে কিছু বেকার যুবককে তৃণমূল নেতারা মস্তানির কাজে নামিয়েছেন৷ পঞ্চায়েতের মাধ্যমেই যেহেতু নানা সুবিধা বিতরণ হয়, নানা কাজের টাকা খরচ হয়, সেইসব সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার টোপ দিয়ে আগামী লোকসভা বিধানসভা নির্বাচনে গ্রামীণ ভোটব্যাঙ্ককে ধরে রাখার হিসাবও তারা কষেছে৷ কিন্তু তার জন্য যে মারাত্মক পথ তৃণমূল নিয়েছে তা কি এখানেই আটকে থাকবে? সরকারি প্রকল্পের চুরির ভাগ, ১০০ দিনের কাজের মেরে দেওয়া মজুরির ভাগ, তোলার ভাগ, নানা সুবিধার ভাগ নিয়ে এখনই তৃণমূলের মধ্যেই খেয়োখেয়ির রাজনীতিতে রক্ত ঝরছে, প্রাণ যাচ্ছে৷ এরপর আজ না হয় কাল, না হয় কিছু দিন বাদে, জমানা বদলালে এই সন্ত্রাস আরও ভয়াবহ রূপ নিয়ে তাদের দলের দিকেই ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে৷ আরও রক্ত ঝরবে, আরও অসংখ্য মানুষ এই খেয়োখেয়িতে প্রাণ দেবেন৷
দুঃখের হলেও সত্য তৃণমূল আজ যে অবাধ সন্ত্রাস চালাতে পারল তার জমি তৈরি হয়েছে সিপিএম নেতৃত্বের বামপন্থা বিসর্জন দিয়ে যেন তেন প্রকারেণ ক্ষমতা ধরে রাখার রাজনীতির মধ্য দিয়েই৷ তাঁদের অবাম রাজনীতি বামপন্থাকে দুর্বল করায় দক্ষিণপন্থার উত্থানের সুযোগ ঘটেছে৷ পঞ্চায়েত আইনে আগে ছিল নির্বাচনের সময় পুলিশ–প্রশাসন পুরোপুরি নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে৷ প্রশাসনকে ব্যবহার করে ভোটে জেতার বাসনায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সিপিএম নেতৃত্ব নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করে আইন এমনভাবে পরিবর্তন করে যাতে, রাজ্য সরকারই নির্বাচনের সময় প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে৷ সিপিএম নেতৃত্বের কৃতকর্মের জন্যই তৃণমূল এই আইনের সুযোগ নিয়েই প্রশাসনকে যথেচ্ছ ব্যবহার করতে পেরেছে৷
যে কোনও বুর্জোয়া শাসক দলই তাদের জনবিরোধী কাজের পরিণামে শেষ পর্যন্ত জনগণের উপর আস্থা রাখতে পারে না৷ জনগণকে ভয় পায়৷ তৃণমূল কংগ্রেসও জনগণকে ভয় পাচ্ছে৷ কারণ তারা ভাল করেই জানে ‘উন্নয়ন’ নেতাদের বাণীতে আছে৷ তা রাস্তাতে গড়াগড়ি খায় না৷ উন্নয়ন বাস্তবে হলে মানুষের জীবনের তার ছাপ দেখতে পাওয়া যায়৷ আজ তাদের শাসনে সেই ছাপ দূরের কথা রিক্ত–নিঃস্ব মানুষ প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে, কোথায় উন্নয়ন? কোথায় কাজ, কোথায় গ্রামের উন্নতি? গ্রামের মানুষের কাজ নেই৷ একশো দিনের কাজের টাকা নিয়ে চলছে সীমাহীন দুর্নীতি৷ চাষির ফসলের ন্যায্য দামের জন্য সরকার কিছুই করেনি৷ তৃণমূল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল ফিরিয়ে আনবে, কিন্তু আজও এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়নি৷ সিপিএম জমানার মতোই বিদ্যুতের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে৷ সমস্ত গ্রামে আজও বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি৷ গ্রামীণ এলাকার রাস্তাঘাট, পানীয়জল, গ্রামীণ এলাকার চিকিৎসা সমস্যার এতটুকু সুরাহা হয়নি৷ আর মানুষ চোখের সামনে দেখছে তৃণমূল নেতাদের লুঠতরাজ৷ তারা প্রশ্ন তুলছে৷ এই সব প্রশ্নকেই ভয় পাচ্ছে তৃণমূল৷ তাই এতটুকু ঝুঁকি না নিয়ে ভোটটাই করতে দিতে রাজি নয় তারা৷
কংগ্রেস–সিপিএম জমানার যে অভিশপ্ত দিনগুলির পরিবর্তনের আশা করে মানুষ তৃণমূলকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল, বিগত সাত বছরে সেই আশা চূর্ণ–বিচূর্ণ হয়ে গেছে৷ এস ইউ সি আই (সি) বারবার এই সত্যকে তুলে ধরেছে যে, ভোটের বাজারে নানা রঙের দল দেখে ভুললে সর্বনাশ হবে সাধারণ মানুষেরই৷ ভোটে পছন্দমতো প্রার্থীকে বাছতে পারার মতো অতি ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার হোক, খেয়ে–পরে সুষ্ঠুভাবে বাঁচার অধিকারই হোক বা তা অর্জন করার একটাই পথ– গণআন্দোলন৷ ভোটকে সুস্থভাবে করাতে গেলেও এ ছাড়া পথ নেই৷
70 Year 34 Issue13 April, 2018