৫ আগস্ট মহান মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের ৪৯তম স্মরণদিবস। এই উপলক্ষে তাঁর অমূল্য শিক্ষা থেকে একটি অংশ প্রকাশ করা হল।
… এ দেশে কমিউনিস্ট পার্টি নামধারী দলটির জন্মের পর থেকে সংগ্রামের ইতিহাস, অর্থাৎ সংগ্রাম পরিচালনার কায়দা ও পরিচালনার সময়কার দৃষ্টিভঙ্গি পর্যালোচনা করে এবং দেশের মূল রাজনৈতিক অবস্থা এবং রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ধারণ করবার জন্য এই পার্টিটি যতবার মূল রণনীতি নির্ধারণ করবার চেষ্টা করেছে, অর্থাৎ মূল বিপ্লবী তত্ত্ব গ্রহণ করবার চেষ্টা করেছে, সেই সমস্ত তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে এবং দলের নেতা ও কর্মীদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রাত্যহিক আচরণের ক্ষেত্রে সংস্কৃতিগত মান…লক্ষ করে– এই দলটি যে গঠনের শুরু থেকেই কমিউনিজমের তকমা এঁটে একটি পেটিবুর্জোয়া পার্টির মতো আচরণ করে এসেছে– এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েই কেবলমাত্র আমরা ভারতবর্ষের সর্বহারা শ্রেণির বিপ্লবী দল, অর্থাৎ মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী দল হিসাবে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-কে গড়ে তুলেছি। কারণ, মার্ক্সবাদ অনুযায়ী আমরা জানি, দল শুধুমাত্র কতগুলো ব্যক্তিবিশেষের সমষ্টি নয়, শ্রেণিবিভক্ত সমাজে যে কোনও রাজনৈতিক দলই কোনও না কোনও শ্রেণির দল। অর্থাৎ উৎপাদনের বিকাশের একটি বিশেষ ঐতিহাসিক স্তরে একটি দেশে যে শ্রেণিগুলির অস্তিত্ব বর্তমান থাকে তার কোনও না কোনও একটির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আদর্শগত ও নৈতিক আশা-আকাঙক্ষাগুলিকে বাস্তবে রূপায়িত করার রাজনৈতিক অস্ত্রই হচ্ছে সেই শ্রেণির রাজনৈতিক দল। তা হলে, দল বলতে মার্ক্সবাদীরা বুঝে থাকে শ্রেণি দল, যা একটা বিশেষ শ্রেণিগত বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি এবং সমস্যা বিশ্লেষণ ও সমাধানের ক্ষেত্রে বিশেষ শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী চিন্তাগত প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির ওপরেই গড়ে উঠে, সে সম্বন্ধে দলের নেতা ও কর্মীরা সচেতন থাক বা না থাক, যেটা দলকে এবং দলের মূল বিচার-বিশ্লেষণকে এবং দলের নেতা ও কর্মীদের জীবনের প্রতিটি সমস্যার ক্ষেত্রে প্রাত্যহিক আচরণের সংস্কৃতিগত ও রুচিগত দিকটিকেও প্রভাবিত করে চলেছে।
… একটি দেশে একটিই সত্যিকারের শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী দল বা মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী দল গড়ে উঠতে পারে, একাধিক শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী দল থাকতে পারে না। যদি দেশের দুই প্রান্তে দু’টি সত্যিকারের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠে, তা হলে দু’জনেরই মূল দৃষ্টিভঙ্গি, বিচার-বিশ্লেষণ পদ্ধতি ও উদ্দেশ্য এক হওয়ার জন্য তারা উভয়েই মিলিত হয়ে গিয়ে একটি পার্টি গড়ে তুলবে। কমিউনিস্ট পার্টি নামে দেশের অভ্যন্তরে একটি পার্টি থাকা সত্ত্বেও সাম্যবাদের আদর্শে অপর একটি পার্টি গঠনের যৌক্তিকতা একমাত্র তখনই বর্তায় যদি ইতিহাস ও দ্বন্দ্বমূলক যুক্তিবিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে দেখা যায় যে, কমিউনিস্ট পার্টি নামে সেই বিশেষ দলটি শ্রমিক শ্রেণির নামের আড়ালে আসলে পেটিবুর্জোয়া বা বুর্জোয়া স্বার্থ সংরক্ষণ করে চলেছে। সুতরাং, ভারতবর্ষে যে আট-ন’টি দল প্রত্যেকেই নিজেকে শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী দল বলে জাহির করছে, নিজেদের মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী বলে প্রচার করছে, এদের প্রতিটিই কমিউনিস্ট পার্টি হতে পারে না। তা হলে, হয় এদের মধ্যে যে কোনও একটি পার্টি কমিউনিস্ট পার্টি, অথবা এদের কোনওটিই নয়। যদি এদের মধ্যে কোনও একটি দল সত্যিকারের শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী দল থেকে থাকে, আমাদের সেটিকে ইতিহাস ও সঠিক বৈজ্ঞানিক বিচার-বিশ্লেষণের সাহায্যে চিনে নিতে হবে।
আর, যদি সঠিক বৈজ্ঞানিক বিচারে দেখা যায়, দেশে এখনও সত্যিকারের মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী দল গড়েই ওঠেনি, তা হলে যাঁরা বিপ্লব চান, যাঁরা বর্তমান অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন, সামাজিক অবিচার এবং সাংস্কৃতিক সংকটের হাত থেকে মুক্তি চান, শোষিত শ্রেণিগুলিকে তথা দেশকে মুক্তি দিতে চান, তাঁদের সঠিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে একটি সত্যিকারের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলতে হবে। কেন না, আজকের দিনে মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী দল ছাড়া একটি দেশে বিপ্লবী সংগ্রাম গড়ে তোলা যায় না, তাকে সফলতার দিকে নিয়ে যাওয়া যায় না এবং বিপ্লবের পর তাকে সংহত করে শেষ পর্যন্ত শ্রেণিহীন সাম্যবাদী সমাজও গড়ে তোলা যায় না। ফলে, ভারতবর্ষের শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য, যে শোষণমূলক সমাজব্যবস্থাটি আমাদের বুকের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আমাদের বিকাশের পথটিকে, সমাজের অপ্রতিহত অগ্রগতির পথটিকেই রুদ্ধ করে বসে আছে তাকে ভেঙে ফেলে সমাজের অবাধ বিকাশের পথটিকে খুলে দেবার জন্য বিপ্লব আমাদের চাই এবং এই বিপ্লবের জন্য বিপ্লবী দলও আমাদের চাই। আর, হাজারো রকমের বিপ্লবী (!) তত্ত্ব এবং প্রচারের ডামাডোলের ভিতর থেকেই, কাজটি যত কঠিন হোক না কেন, সত্যিকারের কমিউনিস্ট পার্টি কোনটি, সেটি আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে।
বিপ্লবী দল বিচারের সঠিক পদ্ধতি
এখন, একটি দল শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী দল কি দল নয়– এই জটিল বিচারটি করব আমরা কিসের সাহায্যে? সে কি দলের নেতাদের গরম গরম বিপ্লবী বুলি দিয়ে? তা হলে তো সত্যিকারের শ্রমিক শ্রেণির দল বিচারের কোনও উপায়ই থাকবে না! কারণ, বিপ্লবী বুলি আওড়াতে তো কেউই আমরা পিছিয়ে নেই। লেনিন আমাদের শিখিয়েছেন, একটি বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া বিপ্লব হতে পারে না এবং এই জন্যই একটি বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া একটি সত্যিকারের বিপ্লবী দল গড়ে উঠতে পারে না। লেনিন যখন বলেছেন বিপ্লবী তত্ত্ব, তখন তিনি একটি দলের শুধু রাজনৈতিক প্রোগ্রাম এবং পলিসি বোঝাতে চাননি, তিনি বিপ্লবী তত্ত্ব বলতে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কর্তৃক জীবনের প্রতিটি দিক সম্পর্কে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারণাগুলিকে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে কো-অর্ডিনেট (সংযোজিত) করে একটি পুরো জ্ঞানের পরিমণ্ডলকেই (এপিস্টেমোলজিক্যাল ক্যাটাগরি) বুঝিয়েছেন। তা হলে, কোনও দল বিচারের ক্ষেত্রে প্রথমত, দলটির বিপ্লবী রাজনৈতিক তত্ত্বটিকে বিচার করে দেখতে হবে। দেখতে হবে, যে রাজনৈতিক তত্ত্বটিকে তারা বিপ্লবী বলে প্রচার করছে তা আসলে বিপ্লবী কি না। অর্থাৎ তাদের বিপ্লবী তত্ত্বটি আমাদের সমাজব্যবস্থার অভ্যন্তরে বিপ্লবের যে জটিল প্রক্রিয়াটি চালু রয়েছে তার যথার্থ ও বাস্তব প্রতিফলন কি না। দ্বিতীয়ত, দেখতে হবে, দলটির আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে নিজস্ব কোনও বিশ্লেষণ আছে কি নেই এবং যদি থাকে তা হলে সেটি যথার্থ মার্ক্সবাদসম্মত বিশ্লেষণ কি না। তৃতীয়ত, এগুলো দেখার সাথে সাথে দল বিচারের ক্ষেত্রে আরও দেখতে হবে, প্রতিটি ঘটনা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সেই দলের বিচারধারা (মেথডোলজিক্যাল অ্যাপ্রোচ) কী এবং দলের মূল রণনীতি, প্ল্যান, প্রোগ্রাম এবং সংগ্রাম পরিচালনার কৌশল কোন শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে এবং চতুর্থত দেখতে হবে, সেই দলের নেতা ও কর্মীদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে আচরণ এবং চলবার রীতিনীতি কোন শ্রেণির সংস্কৃতিগত মান প্রতিফলিত করছে। এখানে মনে রাখতে হবে, নেতা ও কর্মীদের পরস্পরের মধ্যে ও জনতার সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে গোঁড়ামি ও যুক্তিহীন আচরণে প্রশ্রয়দান, নানা বুর্জোয়া কুসংস্কারের প্রভাব, অন্ধতা, একগুঁয়েমি, উচ্ছৃঙ্খলতা, হামবড়া ভাব, মিথ্যা বলার অভ্যাস– এগুলো থাকলে বুঝতে হবে, বুর্জোয়া ও সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রভাব দলের নেতা ও কর্মীদের মধ্যে পুরোমাত্রায় বর্তমান।
তা হলে দেখা গেল, দল বিচারের ক্ষেত্রে মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী দ্বন্দ্বমূলক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী যেমন পার্টির বিপ্লবী তত্ত্বকে প্রথমে বিচার করতে হবে, তেমনি সাথে সাথে সেই দলের চিন্তা ও বিচারপদ্ধতি এবং দলের নেতা ও কর্মীদের প্রাত্যহিক ব্যবহারের মধ্যে সংস্কৃতিগত মান যা তাঁরা প্রতিফলিত করছেন, তাকেও বিচার করে দল সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে। কারণ, মনে রাখতে হবে, বুর্জোয়া মানবতাবাদ থেকে উন্নততর সাংস্কৃতিক মান, অর্থাৎ সর্বহারা সংস্কৃতিগত মান অর্জন করা ব্যতিরেকে এই তত্ত্ব সম্পর্কে বিচার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তার প্রয়োগও সঠিক হতে পারে না। মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন, স্ট্যালিন এবং মাও-এর মূল বিচারধারা সম্পর্কে যাঁরা জানেন, তাঁরাই আমাদের এ কথা বুঝতে সক্ষম হবেন। এখানে আর একটি কথাও মনে রাখতে হবে। প্রাত্যহিক জীবনে প্রয়োগ ছাড়া মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ সম্পর্কে শুধুমাত্র বই পড়া জ্ঞান, অথবা মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্বের সংযোজন ছাড়া শুধুমাত্র শোষিত মানুষের আন্দোলনগুলি পরিচালনার মধ্য দিয়ে অর্জিত যে জ্ঞান– এই দুটোই মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ সম্পর্কে আংশিক জ্ঞান মাত্র। সমস্ত মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদীরাই জানেন, এই দুটোকে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে সংযোজিত করতে পারলেই কেবলমাত্র মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ সম্পর্কে একটি সামগ্রিক তত্ত্বের ধারণা অর্জন করা সম্ভব। সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উন্নততর সাংস্কৃতিক মান অর্জন করতে না পারলে এ দুটো আংশিক জ্ঞানকে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে সঠিকভাবে সংযোজন করে চৌকস জ্ঞানের অধিকারী হওয়া, অর্থাৎ তত্ত্ব বিচারের ক্ষমতা অর্জন করা কখনই সম্ভব হতে পারে না। এই দিকগুলি সম্পর্কে খেয়াল রেখেই দল বিচারের দূরূহ কাজটি আমাদের সম্পন্ন করতে হবে।
এ ছাড়া আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও দল বিচারের সময় খেয়াল রাখতে হবে। দেখতে হবে, পার্টিটি কী পদ্ধতিতে, কোন ধরনের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে এবং তার নেতৃত্ব সম্বন্ধে ধারণাটি কী? সেটি কি পেটিবুর্জোয়া পার্টিগুলির মতই আনুষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক (ফরমাল ডেমোক্রেটিক)নেতৃত্বের ধারণা, নাকি গণতান্ত্রিক একেন্দ্রীকরণ, অর্থাৎ প্রোলেটারিয়ান গণতন্ত্র ও কেন্দ্রীকরণের নীতির সংমিশ্রণের মারফত গড়ে ওঠা সেটি একটি যৌথ নেতৃত্বের ধারণা। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, বুর্জোয়া বিপ্লব যেহেতু উৎপাদনের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানার ভিত্তিতে উৎপাদিকা শক্তি, উৎপাদন পদ্ধতি ও উৎপাদনের বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন এবং এক অর্থে ব্যক্তির বিকাশ ও ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠার বিপ্লব, সেইহেতু বুর্জোয়া গণতন্ত্র, তা যত আদর্শস্থানীয় (মডেল) গণতান্ত্রিক ফর্মেরই হোক না কেন, সেখানে গণতান্ত্রিক ফর্ম-এর মধ্য দিয়ে আসলে ব্যক্তিনেতৃত্বই কাজ করে থাকে। এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে ব্যক্তিই হল কেন্দ্রবিন্দু এবং এ সম্বন্ধে সচেতন উপলব্ধি না থাকলেও বাস্তবে এক ব্যক্তি বা বিভিন্ন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই এই গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রক্রিয়াটি গড়ে ওঠে। ফলে বুর্জোয়া গণতন্দ্রে আসলে গণতন্ত্রের নামে ব্যক্তিনেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হওয়ার ফলে এই গণতন্দ্রের চরিত্র হয়ে পড়ে ‘ফর্মাল’। অন্য দিকে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব যেহেতু ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানা এবং শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে উৎপাদনের ওপর যৌথকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিপ্লব, সেইহেতু শ্রমিক শ্রেণির গণতন্দ্রে নেতৃত্বের ধারণা হচ্ছে যৌথ নেতৃত্বের ধারণা।
যৌথ নেতৃত্ব বলতে কী বোঝায়
এই যৌথ নেতৃত্বের ধারণা বলতে কী বোঝায়? লেনিন বলেছেন, দলের সকল সদস্যের যৌথ জ্ঞানই হচ্ছে যৌথ নেতৃত্ব। অর্থাৎ শুধুমাত্র রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়েই নয়, জীবনের প্রতিটি সমস্যা সম্পর্কে পার্টির সমস্ত সভ্যের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার দ্বন্দ্ব-সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে যে যৌথজ্ঞান গড়ে ওঠে সেই যৌথজ্ঞানের বিশেষীকৃত রূপে (কংক্রিট ফর্ম) প্রকাশ হচ্ছে যৌথ নেতৃত্ব। চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ওপর আলোচনায় আমি এটাকে আরও একটু ব্যাখ্যা করে বলেছি, এ যুগে কোনও একটি দল আভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে ব্যক্তিনেতৃত্ব ও ব্যক্তিবাদের অবসান ঘটিয়ে একমাত্র তখনই এই যৌথ-নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম, যখন পার্টির সমস্ত নেতা ও কর্মীর চিন্তাভাবনার দ্বন্দ্ব-সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে যে যৌথজ্ঞান গড়ে ওঠে সেটার ব্যক্তিকরণ ও বিশেষীকৃত প্রকাশ ঘটেছে, অর্থাৎ একজন নেতার মধ্য দিয়ে এই যৌথ নেতৃত্বের সর্বোত্তম রূপে ব্যক্তিকরণ ঘটেছে। কারণ, দলের নেতা ও কর্মীদের চিন্তাভাবনা ও অভিজ্ঞতার দ্বন্দ্ব-সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে যে যৌথজ্ঞান দলের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠে সেই নেতৃত্ব, অর্থাৎ ‘অথরিটি’র ধারণা, কোনও মতেই বিমূর্ত (অ্যাবস্ট্রাক্ট) হতে পারে না। আর, এইজন্যই যৌথ-নেতৃত্বের অভ্যুত্থান ঘটেছে এ কথার বাস্তব প্রমাণ হল যে, সে ক্ষেত্রে কোনও না কোনও একজন নেতার মধ্য দিয়ে এই যৌথজ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ রূপে ব্যক্তিকরণ (পার্সনিফিকেশন) ঘটেছে।
বিষয়টিকে একটু ব্যাখ্যা করে বললে আপনাদের পক্ষে বোঝা সুবিধা হবে। ধরুন, আপনি-আমি যে চিন্তা করি, যাকে আমরা ব্যক্তিচিন্তা বলি, সেটা কী? একজন ব্যক্তির মধ্য দিয়ে সামাজিক চিন্তার যে ভাবে ব্যক্তিকরণ ঘটে, তাকেই আমরা ব্যক্তিচিন্তা বলি। ঠিক তেমনিই পার্টির নেতা, কর্মী, সাধারণ সভ্য ও সমর্থকদের ও শ্রমিক শ্রেণি এবং জনসাধারণের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে সম্মিলিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা জন্ম নিচ্ছে, সংগ্রামের মধ্যে সম্পর্কযুক্ত প্রত্যেকের মধ্যেই সেই চিন্তা ও অভিজ্ঞতার ব্যক্তিকরণ ঘটছে। কিন্তু, যে হেতু আমরা জানি, এই বস্তুজগতে কোনও দুটো বিষয় (ফেনোমেনা) একেবারে হুবহু এক হতে পারে না, সেই একই কারণে পার্টির সমস্ত সভ্য ও নেতাদের সম্মিলিত সংগ্রামের দ্বারা অর্জিত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের উপলব্ধি সকলের মধ্যে এক হতে পারে না। যার মধ্য দিয়ে এই যৌথ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সর্বশ্রেষ্ঠরূপে ব্যক্তিকরণ ঘটে, তিনিই যৌথ নেতৃত্বের বিশেষীকৃত রূপ হিসাবে দেখা দেন। রাশিয়ান বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে লেনিন এবং চিনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে মাও সে-তুঙ-এর অভ্যুত্থান সেই সমস্ত পার্টিগুলিতে যৌথ নেতৃত্বের বিশেষীকৃত প্রকাশ ছাড়া কিছুই নয়। তা হলে দেখা যাচ্ছে, যৌথজ্ঞানের প্রকাশ ঘটেছে মানে, দলের সমস্ত নেতা ও কর্মী, ব়্যাঙ্ক অ্যান্ড ফাইল, শ্রমিক শ্রেণি ও জনসাধারণের সম্মিলিত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে যৌথজ্ঞান গড়ে ওঠে, দলের সর্বোচ্চ কমিটির কোনও একজন নেতার মধ্য দিয়ে তার সর্বশ্রেষ্ঠ রূপে ব্যক্তিকরণ ঘটেছে। দলের সম্মিলিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কোনও একজন নেতার মধ্য দিয়ে যখন এইভাবে সর্বোত্তম রূপে ব্যক্তিকরণ হয়, নেতৃত্বের বিকাশের একমাত্র সেই স্তরেই দলের অভ্যন্তরে ‘গ্রুপইজম’ এবং নেতৃত্বের ক্রিয়াকলাপের মধ্যে ব্যক্তিনেতৃত্ব ও বুর্জোয়া ব্যক্তিবাদের প্রভাবকে সম্পূর্ণ রূপে খতম করা সম্ভব এবং দলের অভ্যন্তরে এই অবস্থার উদ্ভব হলেই একমাত্র বলা চলে যে, দলটি প্রোলেটারিয়ান গণতন্দ্রের নীতিকে চালু করতে এবং যৌথ নেতৃত্বের জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছে। দলীয় নেতৃত্বের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত মনে রাখতে হবে, দলটির অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক একেন্দ্রীকরণের নীতির দোহাই পেড়ে ও যৌথ নেতৃত্বের নামে আসলে আনুষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক নেতৃত্বই কাজ করে চলেছে।
এই যৌথজ্ঞান বলতে শুধুমাত্র অর্থনীতিগত বা রাজনীতিগত ধ্যানধারণাগুলিকেই বোঝায় না, জীবনের সর্বস্তরে– অর্থাৎ শিল্প-সাহিত্য থেকে শুরু করে সামাজিক, পারিবারিক সম্পর্ক পর্যন্ত ব্যক্তিগত ধারণা ও আচরণের সমস্ত স্তরে– একটি সংযোজিত, সুসংবদ্ধ এবং সামগ্রিক (কোঅর্ডিনেটেড অ্যান্ড কম্প্রিহেনসিভ) ধারণাকে বুঝিয়ে থাকে। পার্টিকর্মী ও নেতাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদকে ভিত্তি করে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে যৌথজ্ঞান গড়ে ওঠে, সেটাই পথনির্দেশ হিসাবে প্রতিটি কর্মী ও নেতার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সমস্ত ধ্যানধারণা ও আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করে। আবার, এই যৌথজ্ঞানের দ্বারা সমৃদ্ধ হয়ে বাস্তবে সামাজিক জীবনে তাকে প্রয়োগ করতে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিটি নেতা ও কর্মীর অভিজ্ঞতার সাথে যৌথজ্ঞানের যে প্রতিনিয়ত সংঘাত ঘটে, তার দ্বারা আবার এই যৌথজ্ঞান সমৃদ্ধ হয় এবং নেতা ও কর্মীদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও রুচির মানও ক্রমাগত উন্নত হতে থাকে।
মনে রাখতে হবে, পার্টির অভ্যন্তরে নেতা ও কর্মীদের পরস্পর সম্বন্ধ দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতির এই সম্পর্কের দ্বারা পরিচালিত না হলেই সে সম্পর্কের চরিত্র হয়ে পড়ে যান্ত্রিক। এবং এই অবস্থা পার্টির মধ্যে থাকলে বুঝতে হবে, পার্টির অভ্যন্তরে ব্যক্তিবাদকে খতম করা দূরের কথা, বরং ব্যক্তিবাদ পার্টির আভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসাবে কাজ করে চলেছে এবং এই অবস্থায় পার্টিটি নামে কমিউনিস্ট পার্টি হলেও বুর্জোয়া বা পেটিবুর্জোয়া পার্টির মতোই আনুষ্ঠানিক গণতন্ত্র ও কেন্দ্রিকতার সংমিশ্রণে কার্যত যান্ত্রিক ও আমলাতান্ত্রিক উপায়ে কেন্দ্রীভূত পার্টিতে পর্যবসিত হয়েছে। এই অবস্থায় অবশ্যম্ভাবীরূপে পার্টির উচ্চস্তরে ব্যুরোক্রেটিক নেতৃত্বের জন্ম হয়ে থাকে। ফলে, এই অবস্থায় পার্টি নেতাদের মধ্যে বিপ্লবী রাজনৈতিক চরিত্রের পরিবর্তে শুধু যে আমলাতান্ত্রিক মনোভাব গড়ে ওঠে তাই নয়, পার্টি নেতারা নিকৃষ্ট ধরনের ব্যক্তিবাদের খপ্পরে পড়তে বাধ্য হন এবং পার্টিটি কার্যত দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। তার একদিকে থাকে আমলাতান্ত্রিক এবং বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত একদল নেতা ও তাত্ত্বিক, অন্য দিকে কর্মীদের মধ্যে অন্ধতা ও অন্ধ আনুগত্যের ফলে থাকে অন্ধভাবে অনুসরণকারী সৎ, ডেডিকেটেড, নিষ্ঠাবান অথচ উগ্র কর্মীর দল।
ফলে বুঝতে পারছেন, এই অবস্থায় পার্টির অভ্যন্তরে তত্ত্ব এবং কর্মের পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় থাকতে পারে না। ফলে তত্ত্ব হয়ে পড়ে মনগড়া এবং বাস্তববিবর্জিত (অ্যাবস্ট্রাক্ট), আর কার্যকলাপ হয়ে পড়ে অন্ধ ও উগ্র ধরনের। এখন, সিপিআই, সিপিআই(এম) এবং নকশালপন্থী গ্রুপগুলির কার্যকলাপ, সংগঠনপদ্ধতি, কর্মীদের চেতনার মান প্রভৃতির দিকে লক্ষ করলেই বুঝতে অসুবিধে হবে না যে, ঠিক এই অবস্থাই এদের সকলের মধ্যে বর্তমান।
‘কেন ভারতবর্ষের মাটিতে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) একমাত্র সাম্যবাদী দল’ বই থেকে