শিল্পী-সাংস্কৃতিক কর্মীদের কর্মশালায় কমরেড প্রভাস ঘোষের বার্তা
প্রোগ্রেসিভ কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া (পিসিএআই) আয়োজিত জয়নগরের সর্বভারতীয় কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী কর্মীদের উদ্দেশে এসইউসিআই(সি)-র সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ ১৭ মার্চ এই বার্তাটি পাঠানঃ
আমি কমরেড প্রতাপ সামলকে কথা দিয়েছিলাম যে, আপনাদের শেষ দিনের অধিবেশনে আমি উপস্থিত থাকব। কিন্তু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় ডাক্তারদের নিষেধ মানতে হচ্ছে। আমি যেতে পারলাম না, এটা আমার কাছে খুবই বেদনার।
ঘাটশিলায় আপনাদের বিগত অধিবেশনে আমি উপস্থিত ছিলাম। মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা সম্পর্কে আমার যা উপলব্ধি, তার ভিত্তিতে আমি সেখানে শিল্পের বিভিন্ন শাখার উৎপত্তি, বিবর্তন এবং আজকের দিনে তার প্রয়োজন সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম। সম্ভবত আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ সেগুলি জেনেছেন, আমি এখন সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করতে চাইছি না। আজ আমি আপনাদের সামনে বিবেচনার জন্য কতগুলো বিষয় রাখব।
আপনারা জানেন, একটা শ্রেণিবিভক্ত সমাজে যেখানে পরস্পর বিরোধী শ্রেণির মধ্যে অনিরসনীয় দ্বন্দ্ব কাজ করে, সেখানে কেউই এমনকি শিল্প বা শিল্পী কেউই এর ঊর্ধ্বে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে থাকতে পারেন না। এ রকম একটা সমাজে সকলেই, না জেনে হোক বা জেনে হোক, হয় শোষক শ্রেণি না হয় শোষিত শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করে চলেন। সমাজ শ্রেণিবিভক্ত হওয়ার সময় থেকেই এটা শুরু হয়েছে। অতীতের সমস্ত সামাজিক আন্দোলনেই শিল্প এবং শিল্পীরা এই ভূমিকা পালন করেছেন, সামাজিক আন্দোলনের সাথে শিল্প সবসময় অবিচ্ছেদ্য ভাবে যুক্ত হয়ে থেকেছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে আপনারা দেখবেন, ধর্মের যখন প্রগতিশীল ভূমিকা ছিল, সেই সময়ের ধর্মীয় আন্দোলনেও শিল্প ভূমিকা পালন করেছে এবং বিকশিত হয়েছে। এর পরে ইউরোপে যখন বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে নবজাগরণের সূচনা হল, সামন্ততন্ত্র বিরোধী সংগ্রামের সেই পর্বেও শিল্প তার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে এবং তার মধ্য দিয়ে নিজেও বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে।
একই ভাবে সোভিয়েত এবং চিনের মহান সর্বহারা বিপ্লবের ক্ষেত্রেও শিল্প এবং শিল্পীরা গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা নিয়েছেন। সুতরাং ‘শিল্পের জন্যই শিল্প’, ‘শিল্প শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য’ অথবা সস্তা জনপ্রিয়তার পেছনে ছোটা, নাম-যশ-অর্থ রোজগারই শিল্পীর সাফল্য– এ সবই ভ্রান্ত, লোক ঠকানো, প্রতিক্রিয়াশীল ধ্যান-ধারণা, সমাজ প্রগতির প্রতিবন্ধক। এ সব জিনিস শিল্প এবং শিল্পী উভয়ের বিকাশকেই ব্যাহত করে।
আমাদের দেশে যখন বিদেশি সাম্রাজ্যবাদ শাসন করছে, সেই সময় দেশের মধ্যে নবজাগরণ আন্দোলন এবং তার ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলন সেই সময় শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রেই নয়, বিজ্ঞানে, সাহিত্যে এবং শিল্পের বিভিন্ন শাখায়– যেমন কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীত, লোকসঙ্গীত, নাটক, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, নৃত্য– এই সমস্ত ক্ষেত্রে একের পর এক উজ্জ্বল প্রতিভার জন্ম দিয়েছে। সেই সময় শিল্পীদের একটা অংশ সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে কমিউনিজমের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং অবিভক্ত সিপিআইতে যোগ দেন, যে দলটি প্রকৃত কমিউনিস্ট দল ছিল না। ফলে এই শিল্পীদের যথার্থ বিপ্লবী মতাদর্শের সন্ধান দেওয়া এবং সঠিক পথনির্দেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা ব্যর্থ হয়। যদিও স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রবাহে থেকে এই শিল্পীরা যথেষ্ট ক্ষমতা-যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন, কিন্তু একটা সময় তাঁদের বেশিরভাগই ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার তৈরি করা এবং নাম-যশ-অর্থ রোজগারের আকর্ষণে চলে যান, কেউ কেউ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
মহান মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ আমাদের পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৪৮ সালে, যখন স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ার শেষ হয়ে গিয়েছে। একটা বন্ধ্যা সময় শুরু হয়েছে এবং সমাজে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করেছে। আমাদের পার্টি সেই সময় একটা সাংস্কৃতিক ইউনিট গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিল, কিন্তু যোগ্য সংগঠকের অভাবে সেটা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। আজও সেই সময়ের কয়েকজন সৎ ও একনিষ্ঠ কর্মী আছেন, কিন্তু তাঁরা বৃদ্ধ হয়েছেন এবং শারীরিকভাবেও অক্ষম। যথেষ্ট আশা নিয়ে তাঁরা আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছেন, আপনাদের উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছেন।
কমরেড, আমি আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই, মুমূর্ষু পুঁজিবাদের এই বিষাক্ত পচাগলা পরিবেশে যখন আত্মকেন্দ্রিকতা, নিকৃষ্ট ব্যক্তিবাদ, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়, যৌন বিকৃতি গোটা সমাজকে ছেয়ে ফেলছে তখন বিপ্লবের পরিপূরক শিল্প সৃষ্টি করা এবং নিজেদের বিপ্লবী শিল্পী হিসাবে গড়ে তোলা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু আবার এটাই এই সময়ের আহ্বান, অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজন। মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারাকে একনিষ্ঠভাবে অধ্যয়ন করা, চর্চা করা এবং জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে তাকে প্রয়োগ করার মধ্য দিয়েই একমাত্র এটা করা সম্ভব। আর এই মহান আদর্শকে জীবনে প্রয়োগ করতে হলে আপনাদের শোষিত শ্রেণির দুঃখ-বেদনাকে অন্তরে অনুভব করতে হবে, তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে হবে এবং সমস্ত শ্রেণি সংগ্রাম ও গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে হবে।
নিজেকে বিপ্লবী শিল্পী হিসাবে গড়ে তুলতে চাইলে সবার আগে ব্যক্তিবাদের শৃঙ্খল থেকে নিজেকে মুক্ত করাটা অপরিহার্য। ব্যক্তিকে যৌথ চিন্তার সাথে, বৃহত্তর স্বার্থের সাথে একাত্ম হয়ে যেতে হবে। সর্বহারা সংস্কৃতির এই মান অর্জনের জন্য নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম প্রয়োজন। সর্বহারা শিল্প মানে শুধুমাত্র শোষিত মানুষের দুঃখ, যন্ত্রণা এবং শোষণের ছবি তুলে ধরা নয়, সর্বহারা শিল্প একজন ব্যক্তিমানুষের সামনে প্রকৃত মুক্তির পথনির্দেশ তুলে ধরবে।
অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে এটাও মনে রাখা দরকার যে, ভক্তিগীতি, লোকগীতি, নাচ, যাত্রাপালা, কবিগান, চিত্রকলা, ভাস্কর্য কীভাবে এক সময় মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে এবং ধর্মীয় আন্দোলনকে সাহায্য করেছে। একই ভাবে শিল্পের এই মাধ্যমগুলো স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়েও মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে, যদিও বক্তব্য বিষয় তখন ভিন্ন ছিল এবং ফর্মও আগের চেয়ে উন্নত হয়েছিল। আজও এই সব শিল্পের আবেদন আছে। বিপ্লবী শিল্পীদের এগুলো চর্চা করতে হবে এবং আজকের দিনে একে আরও উন্নত, বিকশিত করার জন্য, নতুন বক্তব্য আনার জন্য এর থেকে যা যা নেওয়া প্রয়োজন সেগুলো আত্মস্থ করতে হবে।
আমি যে ভাবে বুঝি সেটা হচ্ছে, সমাজের পরিবর্তনের সাথে সাথে শিল্পের বক্তব্য বিষয় পরিবর্তিত হলেও শিল্পের ফর্ম সাথে সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাল্টে যায় না, তাকে পাল্টাতে সময় লাগে দশকের পর দশক। এই সময়ে বহুদিন পর্যন্ত পুরোনো ফর্মের মধ্যে দিয়েই নতুন বিষয় আত্মপ্রকাশ করে।
শোষিত সর্বহারা শ্রেণি এবং বিপ্লবী মতাদর্শ সম্পর্কে আবেগঘন উপলব্ধি বিপ্লবী শিল্পীদের জন্য অপরিহার্য, কিন্তু শুধু সেটাই যথেষ্ট নয়। একই সাথে তাঁদের একনিষ্ঠ সাধনা, সর্বোচ্চ নিষ্ঠা, অক্লান্ত চেষ্টা এবং মুক্ত মন নিয়ে পরস্পরের থেকে শিখতে হবে যাতে তাঁরা নিজেদের শৈল্পিক মানকে বিপ্লবের স্বার্থে ক্রমশ আরও উন্নত, আরও বিকশিত করতে পারেন। একমাত্র এই পথেই একজন আকাঙিক্ষত সাফল্য অর্জন করতে পারবেন এবং বিপ্লব ও সমাজের পক্ষে যথার্থ ভূমিকা নিতে পারবেন।
আমি আপনাদের সাফল্য কামনা করছি।