জার্মানিতে থুরিঙ্গিয়া জেলার টাকেনথালে ‘আইকর’ (আইসিওআর)-এর পঞ্চম সম্মেলন ও তাদের আয়োজিত লেনিন সেমিনারে যোগ দিতে সম্প্রতি জার্মানি গিয়েছিলেন এস ইউ সি আই (সি) পলিটবুরো সদস্য কমরেড অমিতাভ চ্যাটার্জী। সেখানকার অভিজ্ঞতা গণদাবীর সঙ্গে তাঁর কথোপকথনে উঠে এসেছে। সেই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হল।
প্রশ্নঃ ‘আইকর’ সংগঠনটি সম্পর্কে একটু বলুন। কী উদ্দেশ্যে এটি গড়ে উঠেছে?
‘আইকর’ হল একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন। এর পুরো নাম ‘ইন্টারন্যাশনাল কো-অর্ডিনেশন অফ রেভলিউশনারি পার্টিজ অ্যান্ড অর্গানাইজেশনস’। বাংলায় বললে ‘বিশ্বের বিপ্লবী দল ও সংগঠন সমূহের সমন্বয়ক মঞ্চ’। এই সংগঠনটির আধার বা মেরুদণ্ড হিসেবে রয়েছে মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট পার্টি অফ ডয়েশল্যান্ড (ডয়েশল্যান্ড মানে জার্মানি), সংক্ষেপে এমএলপিডি। এমএলপিডি-র উদ্যোগ এবং আয়োজনেই এই সংগঠনটি গড়ে ওঠে ২০১০ সাল নাগাদ। আইকর-এর উদ্দেশ্য হল বিশ্বের দেশে দেশে যে সব কমিউনিস্ট পার্টি ও গণসংগঠন বিপ্লবের কথা বলে, সেই লক্ষ্যে কাজ করে, তাদের সবাইকে একত্রিত করা। এর মধ্য দিয়ে ওদের উদ্দেশ্য হল একটি আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট মঞ্চ গড়ে তোলা– যেমন এক সময়ে কমিনটার্ন ছিল, পরে কমিনফর্ম ছিল।
এ বার কি এমন কমিউনিস্ট মঞ্চ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা গেল?
না। এ বার আইকর নিজেই বলেছে যে, এই ধরনের মঞ্চ গড়ে তুলতে গেলে যারা তার সদস্য হবে তাদের মধ্যে নানা বিষয়ে মতৈক্য দরকার, যেটা আমাদের এখনও গড়ে ওঠেনি। ফলে এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের বিচ্ছিন্ন নানা সংগঠন ও পার্টিকে নিয়ে আইকরের কাজ চলছে। সংগঠনের যে সব নিয়ম-নীতি আছে, সেগুলির সঙ্গে সহমত হলে এর সদস্য হওয়া যায়। গত বছর দলের পক্ষ থেকে আমরা এমএলপিডি-র ডাকা সাম্রাজ্যবাদ-ফ্যাসিবাদবিরোধী আরেকটি সংগঠনের কংগ্রেসে যাই। সেখানে গিয়েই পার্টিগত ভাবে আমরা এই আইকর-এর সন্ধান পাই এবং তার সদস্য হই।
সম্মেলনে যে সব পার্টি বা গ্রুপ এসেছিল, তাদের মধ্যে ন্যূনতম মিল কোন জায়গায়? আলোচনার বিষয় কী কী ছিল?
এই সব পার্টি ও গ্রুপগুলির সকলেই সমাজতন্ত্রের সমর্থক এবং সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে। এটাই ন্যূনতম মিল তাদের মধ্যে।
আইকর তাদের পঞ্চম সম্মেলন উপলক্ষে আগে থেকেই আলোচনার কয়েকটি বিষয় ঠিক করে দিয়েছিল। সদস্যদের প্রত্যেককেই প্রথমে নিজের নিজের দেশ সম্পর্কে একটা রিপোর্ট রাখতে হয়– অর্থাৎ দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কী এবং তাতে তার দলের ভূমিকা কী। দ্বিতীয়ত, প্যালেস্টাইনে ইজরায়েলি হানাদারি নিয়ে বক্তব্য রাখতে বলা হয়। ৮ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে চার দিনের সম্মেলনের শেষে আরও চার দিনের ‘লেনিন সেমিনার’ আয়োজিত হয়েছিল মহান লেনিনের মৃত্যুশতবর্ষ উপলক্ষে। সেখানে লেনিনের বিভিন্ন শিক্ষা নিয়ে বক্তব্য রাখতে বলা হয় পার্টি ও গ্রুপগুলির প্রতিনিধিদের।
এসইউসিআই(সি) ছাড়া ভারতের আর কোনও দল বা সংগঠন সম্মেলনে যোগ দিয়েছিল?
এ দেশ থেকে একটি নকশালপন্থী দল বা গ্রুপ গিয়েছিল। তার নাম সিপিআইএমএল-মাসলাইন। এদের পক্ষ থেকে দুজন প্রতিনিধি গিয়েছিলেন। এছাড়া ভারত থেকে আর কাউকে আমি দেখিনি।
সম্মেলনে আপনার বক্তব্য সম্পর্কে বলুন।
প্রথমেই দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আমি বলেছি যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচন দিয়েই তা শুরু করা উচিত। বলেছি, এ বারের লোকসভা নির্বাচনে ভারতে দুটো বুর্জোয়া ব্লক গড়ে উঠেছিল। একটা বিজেপির নেতৃত্বে ‘এনডিএ’, আরেকটা কংগ্রেসের নেতৃত্বে ‘ইন্ডিয়া’। সিপিআই, সিপিএম-এর মতো ভারতে যে সমস্ত তথাকথিত কমিউনিস্ট পার্টি আছে, তারা ইন্ডিয়া ব্লকে যোগ দিয়েছে বিজেপির বিরুদ্ধতা করার নামে। আমরা বলেছি, দুটো জোটই পুঁজিপতি শ্রেণির জোট। ফলে একটার সঙ্গে আরেকটার কোনও মৌলিক তফাৎ নেই। ফলে আমরা এই দুইয়ের কোনওটিতেই যোগ না দিয়ে নিজস্ব লাইনের ভিত্তিতে নির্বাচনে লড়েছি। আমরা বলেছিলাম যে, আমরা লড়ব সর্বহারা লাইনের ভিত্তিতে। এই নীতি নিয়ে চলে আমরা দেশের মোট ৫৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে ১৫১টিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি। সর্বত্রই আমরা দলের পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলন ও বিপ্লবের যে লাইন, তাকেই জনগণের কাছে নিয়ে গেছি এবং এই সমস্ত দলগুলোর পুঁজিবাদের সেবাদাস চরিত্র উদঘাটিত করেছি। সঙ্গে সঙ্গে বলেছি যে বর্তমানে আমরা গণআন্দোলনের স্তরে আছি। ফলে মানুষের নানা সমস্যা নিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলাই এখন কর্তব্য।
যুক্ত আন্দোলনের কথা আমরা বলি। সবসময়েই আমরা যুক্ত আন্দোলনের পক্ষে। কিন্তু যুক্ত আন্দোলন হবে কার সঙ্গে? যারা আন্দোলন করে তাদের সঙ্গে তো! ঘরে বসে যারা শুধু বিবৃতি দেয়, তাদের দিয়ে তো আন্দোলন হবে না! তা হলে কারা আন্দোলনের রাস্তায় আছে এটা দেখতে হবে, এবং আমরা তাদের সাথে ঐক্য করতে রাজি। এর ভিত্তিতেই আমরা লড়েছি এবং জনসাধারণের সাড়া পেয়েছি। মানুষ আমাদের সমর্থন করেছে।
আপনি যে আলোচনা করলেন, তার কোনও বিরোধিতা হয়নি?
প্রথম কথা, এটা করার রেওয়াজ ওখানে নেই। ওখানে যে যার মত প্রকাশ করবে। আমি তো ওখানে কোনও দলের বিরুদ্ধে কিছু বলিনি। ওখানে যারা এসেছে– যেমন তুরস্ক থেকে এসেছে পাঁচ-ছ’টা গ্রুপ– প্রত্যেকেরই প্রত্যেকের বিরুদ্ধে বক্তব্য আছে। কিন্তু সেটা আলোচনা করার জায়গা ওটা নয়। আইকরের নিয়মাবলিতেই বলা আছে, পার্টি বা গ্রুপগুলির মধ্যে মতবিরোধ থাকতেই পারে, কিন্তু সে সব নিয়ে এখানে আলোচনা হবে না, বা এই মতবিরোধ আইকরের সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রেও বাধা হবে না।
বিশ্বে ফ্যাসিবাদের মাথাচাড়া দেওয়া প্রসঙ্গে আমি বললাম, ১৯৪৮ সালে আমাদের পার্টি প্রতিষ্ঠার সময়েই দলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছিলেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির সামরিক শক্তির পরাজয় ঘটেছে, কিন্তু ফ্যাসিবাদের পরাজয় ঘটেনি। ফ্যাসিবাদ বিশ্বের সমস্ত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হিসাবে সেগুলির অঙ্গে পরিণত হয়েছে। বুর্জোয়া শ্রেণিই পুঁজিবাদের বর্তমান প্রবল সংকটের সময় সকল দেশেই ফ্যাসিবাদের রাস্তা নিচ্ছে।
আইকর-এর সম্মেলন থেকে কী উঠে এল? নির্দিষ্ট কোনও কর্মসূচি হয়েছে কি আগামীর জন্য?
অনেক সিদ্ধান্ত হয়েছে। বহু প্রস্তাব পাশ হয়েছে। কলকাতার আর জি কর আন্দোলনের সমর্থনেও প্রস্তাব গহণ করা হয়েছে। আর একটা বিষয় এসেছে। জার্মানিতে সদ্য যে নির্বাচন হয়ে গেল, সেখানে এমএলপিডি লড়াই করেছে। সেই নির্বাচনে, ওদের মতে একটা ফ্যাসিস্ট পার্টি এএফডি (অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি) ৩০ শতাংশ ভোট পেয়েছে, যেটা ওদের পক্ষে খুব উদ্বেগের।
জার্মানিতে এই যে দক্ষিণপন্থী দল ৩০ শতাংশ ভোট পেয়েছে আপনি বললেন, এটা কেন হল এই সম্পর্কে কিছু তাঁরা বলেছেন?
আলাদা করে বলেননি। তবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, এর অর্থ জনগণের মধ্যে দক্ষিণপন্থার প্রভাব আছে। এটা লক্ষণীয়। তাঁরা এই নিয়ে উদ্বেগপ্রকাশ করেছেন এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রয়োজনীয়তা কত বাড়ছে সেটা ব্যাখ্যা করেছেন।
এশীয় অঞ্চলের আগামী কর্মসূচি নিয়ে কি কোনও কথা হয়েছে?
না। আইকরের প্রতিটি মহাদেশ অনুযায়ী আলাদা আলাদা বডি আছে। এশিয়ার মধ্যে এখনও পর্যন্ত যাদের আমরা ওখানে পেয়েছি– আমরা ছাড়া মাসলাইন ছিল, বাংলাদেশ থেকে বাসদ আছে এবং নেপাল থেকে দুটি পার্টি আছে। আশার কথা, বাংলাদেশ থেকে বাসদ (মার্ক্সবাদী) দলটিও এ বার আইকরের সদস্য হয়েছে।
আর শ্রীলঙ্কাও তো ছিল ওখানে?
শ্রীলঙ্কা ছিল, কিন্তু ওখানকার কোনও অফিসিয়াল প্রতিনিধিত্ব ছিল না। যিনি ছিলেন, তিনি ব্রিটেনে থাকেন। শ্রীলঙ্কার পার্টির প্রতিনিধি হিসাবে অবজারভার হয়ে তিনি ওখানে ছিলেন, ডেলিগেট হিসেবে নয়।
গোটা বিশ্বেই সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন আজ খুব দুর্বল। এ ব্যাপারে কি এমএলপিডির লোকজন বা আইকরে যারা ছিলেন তাঁদের কোনও বক্তব্য আছে?
সেই দুর্বলতা কাটানোর জন্যই তো এত আয়োজন। এই দুর্বলতারপ্রধান কারণ, বিশ্বে কমিউনিস্ট নেতৃত্ব নেই। ওরা আইকরের মতো ফোরাম বা প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলে তার মধ্য দিয়ে বিশ্বের কমিউনিস্টদের ঐক্যবদ্ধ করতে চাইছে এই লাইনটাকে আনার জন্য। এ সম্পর্কে এমএলপিডি-র বক্তব্য এবং লাইনের সঙ্গে আমাদের পার্টির বহু বক্তব্যই মিলে যায় এবং আপনারা জানেন, গত মার্চে দু’দিনের জন্য এমএলপিডি-র সর্বোচ্চ নেত্রী সহ এক প্রতিনিধিদল কলকাতায় এসেছিলেন। আমাদের কেন্দ্রীয় অফিসে তাঁরা দু’দিন ধরে বৈঠক করেছেন। শেষ দিনে তাঁরা দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের সঙ্গে কথা বলেন। সেই বৈঠকে পলিটবুরো সদস্য কমরেড অসিত ভট্টাচার্য, কমরেডসৌমেন বসু, কমরেড অশোক সামন্ত ও আমি ছিলাম। আলোচনায় দেখা গেছে, বহু প্রশ্নেই আমরা একমত। কমিউনিস্ট আন্দোলন শক্তিশালী করা, বিশ্বে একটা কমিউনিস্ট নেতৃত্ব আন্তর্জাতিকভাবে দাঁড় করানো, এটাই এই সম্মেলনের লক্ষ্য।
সোভিয়েতের পতন নিয়ে এদের কোনও মতামত আছে?
অবশ্যই আছে। বুকলেট আছে, আলোচনা ও লিখিত বক্তব্য আছে। কিছু বইপত্র আমি এনেছি।
প্যালেস্টাইন-ইজরায়েল যুদ্ধ নিয়ে কোনও নিন্দা প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে কি?
এটা নিয়ে আমি একটু বলি। প্যালেস্টাইন নিয়ে একটি দিবস ওরা ঘোষণা করে। সেদিন সন্ধ্যাবেলা কনফারেন্সের পর ওই হলেই শুধু প্যালেস্টাইন নিয়ে একটি আলোচনার ব্যবস্থা হয়। তার আগে প্যালেস্টাইনের উপর নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হওয়ার পর প্যালেস্টাইনের প্রতিনিধিরা বলতে শুরু করেন এবং হামাসের প্রশ্নে এমএলপিডির সঙ্গে তাঁদের একটা বিরোধ দেখা দেয়। আগেও আমরা জেনেছি যে, প্যালেস্টাইনের হামাসের যে ইজরায়েলের ওপর হানা, সেটা এমএলপিডি ভালো চোখে দেখেনি। তারা মনে করছে, হামাস একটা মৌলবাদী শক্তি এবং তার বিরুদ্ধে একটা নিন্দা হওয়া দরকার। কিন্তু প্যালেস্টাইনের প্রতিনিধিরা হামাসকে নিন্দা করার প্রস্তাব সমর্থন করেননি। বলেছেন, সবটাই প্যালেস্টাইনের প্রতিরোধ সংগ্রামের মধ্যে পড়ে। হামাসকে এখানে আলাদা করে নিন্দা করার জায়গা নেই। ফলে আলোচনা সেখানে কিছুটা থমকে যায়। আমাদের বক্তব্য ছিল, যে, হামাস মৌলবাদী শক্তি যদি হয়ও, এখন তার সমালোচনা করা ঠিক নয়। তার বিরুদ্ধে লড়াই হবে আদর্শগত ও সংস্কৃতিগত ক্ষেত্রে, কিন্তু হামাসকে নিন্দা করে নয়। হামাস যদি মৌলবাদী ধ্যান-ধারণা আনতে চায়, তা হলে প্যালেস্টাইনের লড়াই চালাতে চালাতেই হামাস সম্পর্কে এই বিতর্ক, মুসলিম মৌলবাদের বিরুদ্ধে বিতর্ক আদর্শগত লড়াই হিসাবে থাকবেই।
আরেকটা জিনিসও বলে রাখা দরকার। আইকরের রেজোলিউশনে আছে, কোনও আদর্শগত বিষয়ে ভোটাভুটিতে সিদ্ধান্ত হবে না। এ ক্ষেত্রেও কিন্তু আমাদের সঙ্গে মিল দেখা যাচ্ছে। আদর্শগত মতবিরোধে ভোটাভুটিতে নয়, তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্তে আসতে হবে। যদি সিদ্ধান্তে না পৌঁছনো যায়, না যাবে। কিন্তু ভোট দিয়ে হবে না। এটাই কমিউনিস্ট নীতি হওয়া উচিত এবং কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষাও তাই।
এমএলপিডির সঙ্গে যে আলোচনা হল তাতে আগামী দিনে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক গড়ে তোলারকোনও সম্ভাবনার আভাস কি পাওয়া গেছে?
অবশ্যই। এই যে আইকর সংগঠনটার আমরা সদস্য হলাম এবং সদস্য হয়ে থাকতে চাইছি, একে সমস্ত ভাবে সহযোগিতা করছি, আইকরের এশিয়া গ্রুপে আমরা আছি– সবটাই তো সেই লক্ষ্যে। সেই সম্ভাবনাকে আরও শক্তিশালী করা আমাদেরও লক্ষ্য। আমাদের সঙ্গে আমেরিকা, স্পেনের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তির যোগাযোগ হয়েছে। ভেনেজুয়েলার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গেও কথাবার্তা চলছে।
জার্মানিতে আর কোন কোন দেশের কোন কোন গ্রুপ বা পার্টি বা ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা হল?
আলাদা করে কোনও গ্রুপের সঙ্গে আমি আলোচনায় বসিনি। আমি ওই হাউসে থেকে কার কী মত বোঝার চেষ্টা করেছি। পার্টির প্রতিনিধি হিসাবে কম জনই এসেছেন। যেমন বিস্ময়ের সঙ্গে আমরা দেখলাম, রাশিয়া থেকে এসেছে দুটি গ্রুপ। রাশিয়া থেকে এক তরুণ এসেছেন, যিনি নিজেকে রাশিয়ান মাওয়িস্ট বলে পরিচয় দিচ্ছেন। আরেকজন এসেছেন আরসিডব্লিউপি (রাশিয়ান কমিউনিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টি) থেকে, যাদের বক্তব্য আমরা রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর গণদাবীতে ছেপেও ছিলাম। আরসিডব্লিউপি থেকে এই গ্রুপটা বেরিয়ে এসেছে। আমি কারণ জিজ্ঞাসা করলে বললেন, আরসিডব্লিউপি শুরুতে আক্রমণবিরোধী অবস্থান নিলেও পরে রাশিয়ার বুর্জোয়া শ্রেণির পক্ষে তাদের একটা অংশ চলে যায়। রুশ জাত্যাভিমান মাথাচাড়া দেয়। ফলে এঁরা তখন বেরিয়ে আসেন। চিনেরও একটি গ্রুপের সন্ধান পেয়েছি। তারা নিজেদের বলছে– মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট-মাওয়িস্ট । কমিউনিস্ট পার্টি অফ কেনিয়া এসেছিল। সদ্য গণদাবীতে কেনিয়ার গণআন্দোলন নিয়ে লেখা হয়েছে। কেনিয়া থেকে আসা ছেলেটির নাম বেনেডিক্ট ওয়াজিরা। আমি তার সঙ্গে আলাদা করে গিয়ে কথা বলি। সে আমার কাছে ভারত সম্পর্কে জানতে চায়।
একটা কথা এখানে বলে রাখি, ভারতবর্ষকে আমরা যে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র বলি, এটাই কিন্তু এমএলপিডির আমাদের প্রতি আকর্ষণের প্রধান কারণ। এমএলপিডিও মনে করে ভারত সাম্রাজ্যবাদী দেশ। এ ভাবে চিন্তা করে, এমন মানুষ কিন্তু ওখানে খুব বেশি পাইনি। এই বিষয়টা লেনিন সেমিনারে আমি আরেকটু ব্যাখ্যা করেছি।
আর কোনও দলের খোঁজ কি পাওয়া গেছে যাদের সঙ্গে আমাদের দলের দৃষ্টিভঙ্গিগত মিল আছে?
এখানে বিভিন্ন গ্রুপের যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের সাথে কথাবার্তা বলার চেষ্টা করেছি। হয়তো কোনও একটা ভগ্নাংশে, কোনও একটা খণ্ডাংশে আমাদের সাথে মিল আছে। কিন্তু আজ বিশ্বে কমিউনিস্ট আন্দোলন তো ছন্নছাড়া, একদমই বিপর্যস্ত। এমএলপিডি-ই একমাত্র একটা সংগঠিত দল এবং তাদের সমস্ত বিষয়ে নিজস্ব বক্তব্য আছে। নিজেদের দেশ, বিদেশ, আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলন, অতীত বর্তমান সবকিছু নিয়েই তাদের বিশ্লেষণ আছে, অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট বক্তব্য আছে এবং তারা বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বই বের করেছে। এই যেমন, যাঁরা আমাদের পুরোনো কর্মীতাঁরা জানেন, শিবদাস ঘোষ এশিয়া, আফ্রিকার নবজাগ্রত বুর্জোয়া দেশগুলি সম্পর্কে একটা বিশ্লেষণ রেখেছেন। এমএলপিডি বলছে, এদের মধ্যে অনেক দেশই এখন রিসার্জেন্ট ইম্পিরিয়ালিস্ট পাওয়ার। এই বিশ্লেষণের সঙ্গে আমরা অনেকাংশে একমত হলেও, বাকি অনেকে মানতে রাজি নয়।
এ বার লেনিন সেমিনার। সেখানকার অভিজ্ঞতা কিছু বলুন।
লেনিনসেমিনারে আমি প্রথমেই বললাম যে, লেনিনের কাছ থেকে প্রথম নিতে হবে পার্টি গঠনের দিকটা। লেনিন নিজের দেশে তা করে দেখিয়েছেন এবং আমাদের পার্টিও সেই রীতিটা অনুসরণ করে গড়ে উঠেছে। কিছু মানুষ এক জায়গায় এল, বসে কিছু প্রস্তাব নিল– তার দ্বারা একটা কমিউনিস্ট পার্টি তৈরির কথা ঘোষণা করে দিল– এটা কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের মার্ক্সীয় নীতি নয়। এর আগে জীবনের সর্বদিক ব্যাপ্ত করে, এমনকি প্রেম-ভালবাসা ও যৌনতা সম্পর্কেও একটা ব্যাপক আদর্শগত সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে এবং এটা আমাদের নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষ সুনির্দিষ্ট ভাবে দেখিয়েছেন। আর একটা জিনিস উনি দেখিয়েছেন যে, লেনিন যখন বলছেন বিপ্লবের জন্য একটা সঠিক বিপ্লবী পার্টি, একটা সঠিক বিপ্লবী তত্ত্ব দরকার তখন বিপ্লবী তত্ত্ব বলতে লেনিন শুধুমাত্র রণনীতি ও রণকৌশলগত নীতি (স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড ট্যাক্টিক্স) বোঝাননি। এই বিপ্লবী তত্ত্ব বলতে বোঝায় জীবনের সর্বদিক ব্যাপ্ত করে সংগ্রাম। মার্ক্সবাদকে এখানে জীবনদর্শন হিসাবে নিতে হবে। সে জন্য আমাদের পার্টিতে তিন ধরনের সদস্যপদ আছে– অ্যাপ্লিক্যান্ট মেম্বার, মেম্বার এবং আরেকটা হচ্ছে পার্টির সঙ্গে আইডেন্টিফিকেশনের উপর ভিত্তি করে প্রফেশনাল রেভলিউশনারির স্তর– স্টাফ মেম্বার।
দ্বিতীয়ত বলেছি, সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে। আমি দেখেছি, ভারতবর্ষকে সাম্রাজ্যবাদী বলাতে, এখানে ভারত থেকে যাঁরা এসেছেন তাঁরা তো বটেই, অন্য জায়গা থেকেও যাঁরা এসেছেন তাঁরাও বিস্মিত হয়েছেন। কেন আমি বুঝতে পারছি না। লেনিন সাম্রাজ্যবাদ বলতে কী বলেছেন? লেনিন সাম্রাজ্যবাদ বলতে বলেছিলেন মনোপলি ক্যাপিটালিজম। তা হলে মনোপলি ক্যাপিটালিজম, একচেটিয়া পুঁজিবাদ গড়ে উঠেছে কি না– এটার উপরে নির্ভর করে দেশটা সাম্রাজ্যবাদী কি না। এই কথাটা আমি বলেছি, সবাই শুনেছে।
তৃতীয়ত, যুদ্ধ নিয়ে বলেছি। লেনিন সেমিনারে ওরা যে সমস্ত প্রস্তাব দিয়েছিল, তার মধ্যে সর্বত্রই ছিল ‘ডেঞ্জার অফ ওয়ার্ল্ড-ওয়ার’ বা বিশ্বযুদ্ধ বাধার আশঙ্কা, পারমাণবিক যুদ্ধ বাধার আশঙ্কা কী ভাবে বাড়ছে। আমি দেখালাম, লেনিন কোথাও বলেননি, ‘ইম্পিরিয়ালিজম জেনারেটস ওয়ার্ল্ড-ওয়ার’। লেনিন বলেছেন, ‘ইম্পিরিয়ালিজম জেনারেটস ওয়ার’– সাম্রাজ্যবাদ যুদ্ধের জন্ম দেয়। সেই যুদ্ধ থেকে বিশ্বযুদ্ধ হতে পারে। তা ছাড়া, তোমরা পারমাণবিক যুদ্ধের কথা বারবার বলছ। আমি মনে করি এটা ঠিক নয়।
আজকের দিনে নিউক্লিয়ার ওয়ারের সম্ভাবনা কতটুকু এটাও বিচার করা উচিত। কারণ, এই যে রাশিয়া ইউক্রেনকে ধমকি দিল–সে তার বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগ করবে। করেছে কি? করেনি। কেন করেনি? কারণ রাশিয়া জানে, সে যদি সে সব প্রয়োগ করে তা হলে ইউক্রেনও করবে। নিজেই করবে অথবা ন্যাটোর মাধ্যমে করবে। ভারত পাকিস্তান পরস্পরের বিরুদ্ধে হুমকি দেয়। কিন্তু তারা কি কোনওদিন একে অপরের বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগ করেছে? করবে না। কারণ তারা জানে একই অস্ত্র দু’জনেরই আছে। ফলে ‘নিউক্লিয়ার ওয়ার’‘নিউক্লিয়ার ওয়ার’ বলে একটা আতঙ্ক সৃষ্টি করা আমাদের দিক থেকে ঠিক নয়। এটা করলে আমরা একটা শান্তিবাদী অ্যাপ্রোচে পড়ে যাব এবং তখন আমরা আপসে চলে যাব, হাত জোড় করে শান্তি চাইব। এ আমরা সমর্থন করতে পারি না। এটা বলার পরেই ইটালি থেকে একজন বয়স্ক কমরেড আমার কাছে আসেন। বলেন, তোমার বক্তব্য অন্যদের থেকে আলাদা। আমি তাঁর ঠিকানা নিলাম। পরে যোগাযোগ করব।
সম্মেলনে মোট কতগুলি দেশ থেকে প্রতিনিধি এসেছিলেন?
৩২টি দেশ থেকে।
সামগ্রিক ভাবে আপনার অনুভূতি কেমন, বলুন।
সামগ্রিক ভাবে বলতে গেলে, আমাদের পার্টির গ্রহণযোগ্যতা এবং আমাদের সম্পর্কে জানার আগ্রহ সকলের মধ্যেই বেড়েছে। একটা কথা এখানে বলতে চাই, আজ দেশে দেশে সত্যিকারের কমিউনিস্ট পার্টির প্রয়োজন বিশেষ ভাবে অনুভূত হয়েছে আমাদের কাছে। এ ক্ষেত্রে একটা জিনিস পরিষ্কার ভাবে আমি ওখানেও বলেছি, প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার জন্য লেনিনীয় নীতির ভিত্তিতে কমরেড শিবদাস ঘোষ যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ রেখেছেন, পথ দেখিয়েছেন, সেটা গ্রহণ ও অনুসরণ করতে হবে। এ না হলে প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি গড়েও উঠবে না, কোনও পার্টি গড়ে উঠলেও তাকে রক্ষা করা যাবে না। এটাই ওখানে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আমি কয়েকজনকে বলেছি।
সম্মেলন আর সেমিনার– দুটো কি একই জায়গায় হয়েছিল?
হ্যাঁ। থুরিঙ্গিয়া জেলার টাকেনথালে।
মোট কতজন ছিলেন ওখানে?
প্রায় ৭০০ জনের মতো ছিলেন। এমএলপিডির স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে বয়স্কদের পাশাপাশি তরুণ-তরুণীরাও ভাল সংখ্যায় ছিলেন।
কমরেড অমিতাভ চ্যাটার্জী বলেন, এবার জার্মানিতে তাঁর সাথী হিসাবে সঙ্গে ছিলেন কমরেড এমিল বাওয়ার। ১৭ তারিখ আউসবার্গে এমিলের বাসস্থান এলাকায় তাঁর উদ্যোগে একটি ঘরোয়া সভা হয়। সেখানেও তাঁকে ভারতবর্ষ নিয়ে বলতে হয়। তিনি বলেন, আমি দেখলাম, এমএলপিডিও মাস কালেকশন করে এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রাস্তায় জনগণের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে ও তার মধ্যে দিয়ে যোগাযোগ বাড়ায়। আরও বলেন, জার্মানির অভিজ্ঞতায় আমি বুঝলাম, কমরেড শিবদাস ঘোষের আদর্শ ছাড়া আজকের দিনে দেশে দেশে সত্যিকারের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব।