বিপ্লবী চন্দ্রশেখর আজাদের আত্মবলিদান মুক্তিকামী মানুষের কাছে এক আলোকবর্তিকা

বিপ্লবী চন্দ্রশেখর আজাদের ৯২তম আত্মবলিদান দিবস স্মরণে

স্বাধীনতা সংগ্রামী চন্দ্রশেখর আজাদের আত্মবলিদান দিবস ২৭ ফেব্রুয়ারি। ১৯৩১ সালের ওই দিনে উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদে আলফ্রেড পার্কে ব্রিটিশ পুলিশের সাথে বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ে তিনি শহিদের মৃত্যুবরণ করেন। জীবনের শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ‘আজাদ’-ই রয়ে গেছেন।

১৯২১ সাল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন চলছে। সেই আন্দোলনকে দমন করতে ব্রিটিশ পুলিশ ব্যাপক অত্যাচার নামিয়ে এনেছে, সর্বত্র ধরপাকড় শুরু হয়েছে। আন্দোলনকারীদের দ্বারা জেলখানাগুলি ভরে গেছে। বেনারস থেকে অন্যদের সাথে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৫ বছরের বেশ মজবুত শরীরের এক ছেলেকে। আদালতে তাঁকে হাজির করা হলে ম্যাজিস্ট্রেট জিজ্ঞাসা করলেন–‘তোমার নাম কী?’ ছেলেটি নির্ভয়ে জবাব দেন–‘আজাদ’। ‘বাবার নাম কী?’ তিনি সাহসের সাথে উত্তর দেন– ‘স্বাধীনতা’। বিরক্ত হয়ে ম্যাজিস্ট্রেট আবারও জিজ্ঞাসা করলেন–‘তোমার বাড়ি কোথায়?’ এবারও দৃঢ়তার সঙ্গে জবাব এল–‘জেলখানা’।

রেগে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে শাস্তি হিসেবে ১৫টি বেত্রাঘাত এবং ১৫ দিনের কারাদণ্ডের আদেশ দিলেন। বেতের আঘাতে তাঁর সারা শরীর কেঁপে উঠছিল, শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল, কিন্তু প্রতিবারই তার মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছিল। পরের দিন ‘প্রভা’ পত্রিকার প্রথম পাতায় খবর প্রকাশিত হয় ‘বীর বালক আজাদ’ শিরোনামে এক সংবাদ। সেই খবর সর্বত্র দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ভারতের সমস্ত স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে তিনি ‘আজাদ’ নামে পরিচিত হন। স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ এই ছেলেটির নাম চন্দ্রশেখর আজাদ। মানবজাতির প্রতি তাঁর অসীম ভালোবাসা ও দরদি মন, সামাজিক দায়িত্ববোধ, অপরাজেয় ইচ্ছাশক্তি, সাহসিকতা, ত্যাগ, নিষ্ঠা, জীবন শৃঙ্খলা, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব প্রভৃতি চারিত্রিক গুণাবলির জন্য তিনি ১৯২০-র দশক জুড়ে উত্তর ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের আপসহীন ধারার অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

১৯১২-র পর থেকে ব্রিটিশ ভারতের নতুন রাজধানী দিল্লি সহ উত্তর ভারতে আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে সংগঠন বিস্তারের জন্য রাসবিহারী বসু, যোগেশ চ্যাটার্জী, শচীন সান্যাল, রাজেন্দ্র লাহিড়ী, বটুকেশ্বর দত্ত, যতীন দাস সহ অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর গোষ্ঠীর বেশ কিছু বিপ্লবী উত্তর ভারতে যান। তাঁরা উত্তরভারতের বিপ্লবীদের সাথে মিলিত হয়ে নতুন রূপে, নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেন। এরই পাশাপাশি মূলত ১৯১৫ সালের পর থেকেই গান্ধীজি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন এবং অহিংস পদ্ধতিতে আন্দোলন পরিচালনা করা শুরু করেন।

১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটে। তখন চন্দ্রশেখর আজাদের বয়স ১৩ বছর। তিনি তখন বেনারসের কাশী বিদ্যাপীঠের সংস্কৃত বিভাগের ছাত্র। এই ঘটনা তাঁর মনে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদানের জন্য তাঁর ইচ্ছা প্রবল হয়ে ওঠে। ১৯২১ সালে গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন শুরু করলে নির্দ্বিধায় আজাদ সেই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগদান করেন এবং কারাবরণ করেন। এই আন্দোলন যখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দ্রুত ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করছিল, তখন হঠাৎ চৌরিচৌরায় জনতার উপর পুলিশের গুলি চালানোয় ক্ষিপ্ত জনতার হাতে কয়েকজন কনস্টেবলের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে গান্ধীজি আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে আন্দোলনকারী জনতা, বিশেষ করে ছাত্র-যুবদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও চরম হতাশা এবং কংগ্রেসের কার্যনীতির প্রতি অবিশ্বাসের মনোভাব দেখা দেয়। আজাদের মনেও গান্ধীজির় আপসপন্থী কর্মকাণ্ডের প্রতি অনাস্থা দেখা দেয়।

ইতিমধ্যে উত্তর ভারতে গড়ে উঠেছে বিপ্লবী সংগঠন ‘হিন্দুস্থান রিপাবলিকান আর্মি’ (এইচআরএ)। বেনারসে এই সংগঠনের দায়িত্বে ছিলেন প্রণবেশ চ্যাটার্জি এবং মন্মথনাথ গুপ্ত। চন্দ্রশেখর আজাদ প্রণবেশ চ্যাটার্জির সংস্পর্শে আসেন।

উত্তর ভারতে এইচআরএ-এর কর্মকাণ্ড দ্রুততার সাথে বাড়তে থাকে। বিপ্লবীরা সরকারি কোষাগার লুঠ করে তহবিল সংগ্রহের পরিকল্পনা করেন। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯২৫ সালের ৯ আগস্ট উত্তরপ্রদেশের কাকোরি ও আলমনগর স্টেশনের মাঝামাঝি জায়গায় লক্ষৌগামী ট্রেন থামিয়ে সরকারি কোষাগারের টাকা লুঠ করা হয়। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এটি ‘কাকোরি ট্রেন ডাকাতি’ নামে পরিচিত। ১৯২৬ সালে কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলায় রামপ্রসাদ বিসমিল, আসফাকউল্লা খান, রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ী এবং ঠাকুর রোশন সিংয়ের মৃত্যুদণ্ড, পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড হয়। ব্রিটিশ পুলিশ শুধুমাত্র ধরতে পারেনি এই মামলার অন্যতম প্রধান আসামী চন্দ্রশেখর আজাদকে। তিনি পুলিশের চোখে ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পলাতক জীবন যাপন করছিলেন।

কাকোরি ঘটনার পরে পুলিশ এবং প্রশাসনের তৎপরতা অনেক গুণ বেড়ে যায়। বিপ্লবীরা একের পর এক গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়ার ফলে সংগঠনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। কিন্তু হার না মানা অদম্য মনোবল এবং অপরাজেয় ইচ্ছা শক্তি নিয়ে আজাদ সংগঠনের পুনর্গঠনের দায়িত্ব একা নিজের কাঁধে তুলে নেন এবং গ্রেপ্তারি এড়াতে সংগঠনের কর্মকাণ্ড শাহজাহানপুর থেকে সরিয়ে পশ্চিম উত্তর প্রদেশের ঝাঁসিতে স্থানান্তরিত করেন। এখানে সদাশিব রাও মলকাপুরকর, বিশ্বনাথ বৈশ্বম্পায়ন, ভগবানদাস মাহোর প্রমুখদের নিয়ে কাজ শুরু করেন। এইভাবে উত্তর ভারতে সংগঠনের কর্মকাণ্ড বিস্তারের প্রক্রিয়াতেই ভগৎ সিং, শুকদেব, রাজগুরু সহ পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের সাথে তাঁর পরিচয় হয়।

ভগৎ সিংয়ের সংস্পর্শে আসার পর আজাদের চিন্তাজগতেও আমূল পরিবর্তন সাধন হয়। প্রথম জীবনে আজাদের চিন্তাধারা আর্য সমাজের ধর্মীয় চিন্তাধারার দ্বারা প্রভাবিত ছিল এবং তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশদের অপসারণ। কিন্তু ভগৎ সিংয়ের সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচয়ের পর তিনি বুঝতে পেরেছিলেন শুধুমাত্র ব্রিটিশ শোষণ থেকে মুক্তি অর্জনই শোষিত নিপীড়িত মানুষের মুক্তি নিশ্চিত করতে পারে না। শুধুমাত্র সমাজতন্ত্রই মানুষের প্রকৃত মুক্তি আনতে পারে এবং ধনী ও দরিদ্রের বৈষম্যের অবসান ঘটাতে পারে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে চন্দ্রশেখর আজাদ, ভগৎ সিং সহ দলের অন্যান্য বিপ্লবীরা ১৯২৮ সালে দিল্লির ফিরোজশাহ কোটলাতে একত্রিত হয়ে সভা করে সমাজতন্ত্রকেই নিজেদের দলের উদ্দেশ্য হিসেবে ঘোষণা করেন এবং দলের নামের সঙ্গে ‘সোস্যালিস্ট’ শব্দ জুড়ে ‘এইচআরএ’ থেকে পরিবর্তন করে ‘এইচএসআরএ’ (হিন্দুস্থান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন) রাখেন। এখানে সর্বসম্মতিক্রমে চন্দ্রশেখর আজাদ দলের প্রথম সর্বাধিনায়ক নির্বাচিত হন। সমাজতান্ত্রিক মতবাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে যৌথ কর্মপ্রক্রিয়া পরিচালনার জন্য একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। দলের সংবিধানে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন করে ব্যক্তিহত্যা ও গুপ্ত কর্মকাণ্ডের পরিবর্তে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বৃহত্তর জনতাকে সংগঠিত করে গণ আন্দোলন গড়ে তুলে সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থানের প্রস্তুতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

বিশ শতকের শেষের দিকে ব্রিটিশ শাসক ভারতীয় জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ ও প্রতিবাদী আন্দোলনকে দমন করার উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে ‘পাবলিক সেফটি বিল’ ও ‘ট্রেড ডিসপিউট বিল’ নামে দুটি কালা বিল পেশ করে। দেশজুড়ে সর্বত্রই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়়। ‘এইচএসআরএ’-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯২৯ সালের ৯ এপ্রিল অ্যাসেম্বলি চলাকালীন সেখানে ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত বোমা নিক্ষেপ করে বিলের প্রতিবাদ ধ্বনিত করেন। এই পুরো পরিকল্পনাটি করা হয়েছিল চন্দ্রশেখর আজাদের নেতৃত্বে। এই ঘটনা ব্রিটিশের ভিতকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এরপর ব্রিটিশ পুলিশ একে একে বিপ্লবীদের গ্রেপ্তার করতে থাকে এবং ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে মামলা শুরু করে, যা ‘লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে খ্যাত। বিচারে ভগৎ সিং, শুকদেব ও রাজগুরুর ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। ১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ লাহোর সেন্ট্রাল জেলে এই তিন বিপ্লবী হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়িতে জীবনাহুতি দেন।

লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালীন চন্দ্রশেখর আজাদ আত্মগোপন করে ছিলেন। ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে জীবিত বা মৃত ধরার জন্য বিপুল পরিমাণ আর্থিক পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। এসব সত্ত্বেও নিজের জীবন বিপন্ন করে সংগঠনকে পুনর্গঠন এবং ভগৎ সিং সহ বিপ্লবীদেরজেল থেকে মুক্ত করার নানাপ্রকার পরিকল্পনা তিনি করছিলেন। এই উদ্দেশ্য থেকে গণেশ শঙ্কর বিদ্যার্থীর সঙ্গে তিনি সীতাপুর জেলে দেখা করেন এবং তাঁর পরামর্শ মতো ১৯৩১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে এলাহাবাদে দেখা করতে যান। উদ্দেশ্য ছিল নেহরুর মারফৎ গান্ধীজিকে রাজি করিয়ে আসন্ন গান্ধী-আরউইন মিটিংয়ে বিপ্লবীদের মুক্তির প্রসঙ্গ উপস্থাপন করা। কিন্তু আপসপন্থী নেহরু আজাদের এই প্রস্তাবে রাজি হননি এবং তাঁকে সেখান থেকে চলে যেতে বলেন। এতে একবুক ভরা নিরাশা নিয়ে আজাদ এলাহাবাদের আলফ্রেড পার্কে (বর্তমানে চন্দ্রশেখর আজাদ পার্ক) এইচএসআরএ-এর একজন সদস্য সুখদেব রাজের সাথে দেখা করতে আসেন। কিন্তু একজন বিশ্বাসঘাতক গোপনে পুলিশকে খবর দিলে আলফ্রেড পার্কে আজাদকে পুলিশ ঘিরে ফেলে এবং তাঁকে আত্মসমর্পণ করতে বলে। আজাদ আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করেন এবং একা পুলিশের সঙ্গে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হন। একদিকে একটি মাত্র পিস্তল নিয়ে অসীম সাহসী বিপ্লবী আজাদ, অপরদিকে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ব্রিটিশ পুলিশ। আজাদ অত্যন্ত বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেন, কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেননি। পিস্তলে একটি মাত্র গুলি বেঁচে থাকতে নিজের মাথায় গুলি চালিয়ে আত্মাহুতি দেন এবং শহিদের মৃত্যুবরণ করেন।

আজাদ কেবলমাত্র দলের সেনাপতিই ছিলেন না, এই দল নামক বিপ্লবী পরিবারের অগ্রজও ছিলেন। তিনি সকলের প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ও ব্যবহার্য জিনিসপত্রের প্রতি তীক্ষ্ণ নজরও রাখতেন। কার জামাকাপড় নেই, কার জুতো ছিঁড়ে গেছে, কার ওষুধপত্র দরকার ইত্যাদি সমস্ত কিছুর খবর তিনি রাখতেন। তাঁর অপর এক বিপ্লবী সাথী যশপাল লিখেছেন, ‘‘আজাদের নিয়ম ছিল যতক্ষণ পর্যন্ত না অন্যান্য সাথীরা খেয়ে নিচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি খেতেন না। …আজাদ সবথেকে শেষে খেতেন, আর যখন খাবারের অভাব থাকতো তখন বলে দিতেন খিদে নেই।”

বিপ্লবের প্রয়োজনে হত্যা করা কখনও জরুরি হতে পারে, কিন্তু ব্যক্তিগত বা দলের টাকা জোটানোর প্রয়োজনে হত্যা করাকে তিনি অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখতেন। এ সম্পর্কে তিনি বলতেন, ‘‘আমাদের দল আদর্শবাদী বিপ্লবী দল। দেশভক্তদের দল, হত্যাকারীদের দল নয়। টাকা-পয়সা না থাকতে পারে, আমরা না খেয়ে গ্রেপ্তার হয়ে ফাঁসিতে ঝুলে পড়তে পারি, কিন্তু এমন ঘৃণিত কাজ আমরা করতে পারি না।” এমনই ছিল রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি আজাদের অবিচল আস্থা ও নিষ্ঠা। অথচ এই ধরনের মহান বিপ্লবী চরিত্রগুলিকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ আখ্যা দিয়ে অপমানিত করা কতটা বেদনাদায়ক ও লজ্জার ব্যাপার। প্রতিটি যুগে সাধারণ মানুষের প্রতি গভীর দরদবোধ ও অকৃত্রিম ভালোবাসা এমন মহৎ বিপ্লবীদের তৈরি করে, যারা মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার জন্য লড়াই করে, দৃঢ়তার সঙ্গে ফাঁসির দড়িকে গলায় পড়ে শহিদ হয়। অথচ স্বাধীন ভারতের বুর্জোয়া শাসকেরা এই মহান বীরদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে তুলে ধরে যাতে এঁদের সংগ্রামের উত্তরাধিকার কেউ বহন না করে এই উদ্দেশ্যে।

বর্তমানে পুঁজিবাদের চরম ভোগবাদী, আত্মকেন্দ্রিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের যুগে সামাজিক দায়বদ্ধতা যখন দ্রুত ক্ষয় হচ্ছে, নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধহীন মানসিকতা ক্রমশ বাড়ছে সেই সময়ে চন্দ্রশেখর আজাদের মতো মহান শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি দেবার সত্যিকারের উদ্দেশ্য হল তাঁর জীবন সংগ্রাম ও আত্মবলিদান থেকে শিক্ষা নিয়ে, তাঁর স্বপ্ন ‘মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণের অবসানের’ লক্ষ্যে পুঁজিবাদ বিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পূর্ণ করার মধ্যেই রয়েছে যথার্থ উত্তরাধিকার।

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ২৭ সংখ্যা ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২