প্রকাশ্য সমাবেশ
২৬ নভেম্বর, বেলা ১২টা৷ জামশেদপুর শহরের জি টাউন ক্লাব ময়দান কানায় কানায় পূর্ণ৷ ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শ্রমিক কৃষক দরিদ্র নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষের ভিড়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছে মাঠের সামনের এবং দুদিকের রাস্তা৷ লাল পতাকায় সুসজ্জিত এবং স্লোগানে মুখরিত একের পর এক মিছিল তখনও আসছে৷ বিরাট মঞ্চের এক দিকে রাখা এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর প্রতিষ্ঠাতা, এ যুগের অন্যতম মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করলেন সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ৷ মাল্যদান করলেন বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)–র সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী এবং একে একে বিভিন্ন প্রদেশের রাজ্য সম্পাদকরা৷ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড কে রাধাকৃষ্ণের ভাষণের পরে প্রকাশ্য সমাবেশের সভাপতি, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড সত্যবান প্রধান বক্তা কমরেড প্রভাস ঘোষকে আহ্বান জানালেন তাঁর বক্তব্য রাখার জন্য৷
কমরেড প্রভাস ঘোষ বলতে শুরু করলেন, ভারতের বৃহৎ বুর্জোয়া দল বিজেপি, কংগ্রেস, বামপন্থী দল সিপিএম, সিপিআই এবং অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলো সকলে যখন আগামী নির্বাচনে কে কুর্সি দখল করবে, কে কুর্সি রক্ষা করবে এবং কে কোথায় কটা সিট পাবে তার হিসেব কষছে এবং সংবাদমাধ্যমে এই সব দলের কাজের ফিরিস্তি, ভবিষ্যতে কী করবে সেই প্রতিশ্রুতির জোর প্রচার চলছে, তখন কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তার ভিত্তিতে একমাত্র বিপ্লবী দল হিসাবে আমরা আলোচনা করছি– ভারতের শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্ত জনগণ, যারা শোষণে শোষণে জর্জরিত, অত্যাচারিত তাদের জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে কীভাবে গণআন্দোলন ও শ্রেণিসংগ্রাম গড়ে তোলা যায় এবং এই ভাবে আগামী দিনে পুঁজিবাদ বিরোধী বিপ্লবী প্রস্তুতি সংগঠিত করা যায়৷ এ ছাড়া, আমাদের আদর্শগত, রাজনীতিগত, নীতি–নৈতিকতাগত দিকগুলি যাতে সমস্ত দিক থেকে আরও শক্তিশালী করা যায়, এটাই ছিল এই তৃতীয় পার্টি কংগ্রেসে আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু৷ তিনি বলেন, আমাদের দল নির্বাচনভিত্তিক দল নয়, বিপ্লবী দল৷ আমাদের দল বিশ্বাস করে, নির্বাচনের দ্বারা জনগণের কোনও মৌলিক সমস্যার সমাধান হবে না৷ এটা মার্কসবাদ–লেনিনবাদ, কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা৷ তিনি বলেন, ১৯৫২ সাল থেকে দেশে বহু পার্লামেন্ট নির্বাচন হয়েছে, বহু দিন কংগ্রেস রাজত্ব করেছে গরিবি হঠাও–এর প্রতিশ্রুতি দিয়ে, বিজেপিও রাজত্ব করছে আচ্ছে দিনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে৷ কিন্তু বাস্তবে কী হয়েছে এবং কী হচ্ছে তা দেশের ভুক্তভোগী মানুষ খুব ভাল জানেন৷
কমরেড প্রভাস ঘোষ দেশের পুঁজিপতিদের আকাশছোঁয়া সম্পদ বৃদ্ধির তথ্য দিয়ে দেখান, গত সত্তর বছরে উন্নয়ন কেবল শিল্পপতি, কোটিপতিদেরই হয়েছে৷ এই সব দলগুলো এই পুঁজিপতিদের প্রতিনিধি৷ বিপরীতে কোটি কোটি সাধারণ মানুষ আজ নিরন্ন, ক্ষুধার্ত, বেকার৷ তারা আত্মহত্যা করছে, না খেয়ে মারা যাচ্ছে, অভাবের জ্বালায় সন্তানকে বিক্রি করছে৷ এস ইউ সি আই (সি) এই মানুষদের প্রতিনিধি, তাদের জন্য সংগ্রাম করছে৷ তিনি বলেন, সমাজ শ্রেণি বিভক্ত৷ একদিকে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি শ্রেণি, যাদের লক্ষ্য সর্বোচ্চ মুনাফা৷ আর এক দিকে কোটি কোটি দরিদ্র বেকার বুভুক্ষু শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্ত৷ তিনি বলেন, রাজনীতিও দুটো৷ একটা শিল্পপতিদের রাজনীতি, লুণ্ঠনের পক্ষের রাজনীতি, তাদের রক্ষা করার রাজনীতি৷ আর একটা হল, শোষিত জনগণের জন্য লড়াই করার, বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার রাজনীতি৷ প্রথম প্রকারের রাজনীতির পক্ষে কংগ্রেস বিজেপি সহ দলগুলি৷ আর পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের, লড়াইয়ের রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব করছে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)৷
তিনি বলেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আজ চরম সংকটের কবলে৷ ভারতও তার থেকে রেহাই পায়নি৷ পুঁজিবাদে এই সংকটের সমাধান নেই৷ সমাধান একমাত্র সমাজতন্ত্র৷ সত্তর বছরের সোভিয়েত সমাজতন্ত্রে বেকার ছিল না, ছাঁটাই ছিল না৷ শিক্ষা–চিকিৎসা ছিল বিনামূল্যে৷
তিনি বলেন, বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির একটি লক্ষ্য– ভোট৷ তাই ভোট এলেই তারা রাম মন্দিরের স্লোগান তোলে৷ তিনি বলেন, এখন নরেন্দ্র মোদি আর রাহুল গান্ধীর মধ্যে কম্পিটিশন চলছে, কে কত বেশি মন্দিরে যেতে পারে৷ এর আর একটি লক্ষ্য জনগণের ঐক্যকে বিভক্ত করা, যাতে পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে৷
কমরেড প্রভাস ঘোষ বলেন, আমরা নির্বাচনে নামব, কিন্তু বামপন্থাকে বিসর্জন দিয়ে নয়৷ আমরা সিপিএম–সিপিআইয়ের মতো কংগ্রেসকে সেকুলার তকমা দিই না৷ এই দলগুলি কয়েকটা সিট পাওয়ার জন্য কংগ্রেসের লেজুড়বৃত্তি করছে৷ আমরা এই রাজনীতি করি না৷ তিনি বলেন, নির্বাচন একটা প্রহসন ছাড়া কিছু নয়৷ এটা যে প্রহসন, ভোটের দ্বারা যে মানুষের জ্বলন্ত সমস্যাগুলির সমাধান হয় না, বিপ্লবই যে একমাত্র পথ, এই কথা বোঝানোর জন্য এবং জনগণকে সচেতন করার জন্য আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি৷ তিনি বলেন, জনগণকে রাজনীতি বুঝতে হবে, কে শত্রু, কে মিত্র চিনতে হবে৷ কোন দল শোষক শ্রেণির হয়ে কাজ করছে, কোন দল শোষিত মানুষের হয়ে কাজ করছে, এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দল বিচার করতে হবে৷ এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর নেতৃত্বে দেশজুড়ে গণআন্দোলন গড়ে তোলার জন্য তিনি দেশের শ্রমিক কৃষক নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত মানুষকে আহ্বান জানান৷
উপস্থিত শ্রোতাদের সামনে কমরেড প্রভাস ঘোষের বক্তব্য হিন্দিতে তুলে ধরেন ঝাড়খণ্ড রাজ্য সংগঠনী কমিটির সদস্য কমরেড সুমিত রায়৷ আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে সভা শেষ হয়৷