গণবিক্ষোভে উত্তাল শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কার যে শাসকরা সে দেশের সংখ্যালঘু তামিল, মুসলিমদের বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি উগ্র জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে ভোটে জিতে ক্ষমতা দখল করেছিল, তারাই এখন জনগণের বিক্ষোভের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী মহিন্দা রাজাপক্ষে, যিনি রাষ্ট্রপতির নিজের দাদা, তিনি পদত্যাগ করেই রেহাই পাননি, তাঁর প্রাসাদোপম বাড়িতেও বিক্ষোভ আছড়ে পড়ার ফলে নৌবাহিনীর ঘাঁটিতে আশ্রয় নিতে হয়েছে তাঁকে। শাসক দলের এক এমপি জনরোষের সামনে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন। সে দেশের মন্ত্রী এবং শাসক দলের নেতাদের হেনস্থার একাধিক ভিডিও সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি সরকারের হয়ে গলা ফাটাতেন যে সাংবাদিকরা তাঁদেরও জনরোষের মুখে পড়তে হচ্ছে। পুরো মন্ত্রিসভা আগেই পদত্যাগ করেছে। দেশ জুড়ে স্বতঃস্ফূর্ত গণবিক্ষোভের মধ্যে প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপক্ষে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে রনিল বিক্রমসিংঘেকে নিযুক্ত করেছেন। যদিও খোদ প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিটাই এখন প্রধান হয়ে উঠেছে। প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া সর্বদলীয় অন্তর্বতী সরকারের প্রস্তাব দিলেও তা কেউই গ্রহণ করেনি।
গত কয়েক মাস শ্রীলঙ্কা জুড়ে চলছে এক অভূতপূর্ব সংকট। মার্চ মাসের শেষ থেকে শুরু হয়েছে দিনে বারো তেরো ঘন্টার বেশি বিদ্যুৎ ছাঁটাই, কয়লা-পেট্রল-ডিজেল-কেরোসিন-রান্নার গ্যাস সহ সমস্ত জ্বালানির চরম অভাব। চলছে তীব্র খাদ্য সংকট। আর্থিক সংকটে একের পর এক কোম্পানি বন্ধ হয়ে অসংখ্য মানুষের কাজ চলে গেছে। মৎস্যজীবীরা তেলের অভাবে জলযান নিয়ে সমুদ্রে নামতে পারছেন না। স্থানীয়ভাবে কিছু শাকসবজি, মাছ ইত্যাদি উৎপাদন হলেও তা বাজারে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ির তেলও জোগাড় করা কার্যত অসম্ভব হয়ে উঠেছে। ফলে বহু জায়গায় মাছ, শাকসবজি পচে নষ্ট হচ্ছে। অথচ দেশে তার মূল্য বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। শিশুখাদ্যের তীব্র আকাল, ওষুধের ভয়াবহ অভাব দেখা দিয়েছে। এমনকি কাগজের অভাবে সমস্ত কেন্দ্রীয় পরীক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পড়াশোনা পর্যন্ত বন্ধ। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে অত্যাবশ্যক পণ্যবাহী জাহাজ বন্দরে নোঙর করে থাকলেও সরকারের টাকার অভাবে তা থেকে মাল খালাস করা যায়নি। শ্রীলঙ্কা সরকার নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে জানিয়েছে, কোনও বকেয়া বিদেশি ঋণ তারা শোধ করতে অপারগ।
এমন পরিস্থিতি তৈরি হল কেন? কোভিডের আগে সে দেশে পর্যটন ব্যবসার রমরমা চলছিল। বহুজাতিক বিভিন্ন কোম্পানি এই ব্যবসায় বিনিয়োগ করে বিপুল মুনাফাও করেছে। কোভিডে এই ব্যবসা মার খেয়েছে, সেটাকেই প্রধান কারণ বলে করপোরেট সংবাদমাধ্যম প্রচার করছে। কিন্তু এটাই সব নয়। ভারি শিল্প, ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে দুর্বল শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে চা, কফি, রবার, মশলা বাগান একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ব্রিটিশ কলোনি থাকার সময় থেকেই। ১৯৪৮-এ স্বাধীনতার পর কিছু বছর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের প্রভাব ও দেশে শক্তিশালী বামপন্থী আন্দোলনের প্রভাবে শ্রীলঙ্কার সরকার জনগণকে কিছুটা রিলিফ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তখন শ্রীলঙ্কা সরকার চা-কফি-রবার ইত্যাদির বাগান জাতীয়করণ করেছিল। ১৯৭৭-এর পর বামপন্থী আন্দোলন দুর্বল হতেই শাসক বুর্জোয়া শ্রেণির সেবাদাস হিসাবে তৎকালীন সরকার ‘খোলা বাজার নীতি’ নিয়ে আসে। বর্তমানে বাগিচা ফসল উৎপাদনের বড় অংশই বৃহৎ বিদেশি পুঁজি এবং তাদের দেশি অংশীদারদের দ্বারা পরিচালিত। চাষের জমির একটা বিরাট অংশ এই কাজে ব্যবহৃত হওয়ায় খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কাকে আমদানির উপর অনেকটা নির্ভর করতে হয়। করোনা মহামারিজনিত লকডাউনের কারণে পর্যটন ব্যবসা মারাত্মকভাবে মার খেয়েছে। কৃষিজাত বাগিচা ফসলগুলির রপ্তানি থেকে আয় ক্রমাগত কমেছে। অথচ চড়া দামে খাদ্যশস্য এবং শিল্পদ্রব্য আমদানি তাদের করতেই হয়েছে। সাম্প্রতিক কালে পেট্রোপণ্যের দাম বিপুলভাবে বাড়ায় সে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। ২ কোটি ২০ লক্ষের সামান্য বেশি জনসংখ্যাযুক্ত এই দেশের বিদেশি ঋণ ৩৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি (এক বিলিয়ন মানে ১০০ কোটি)। এই ঋণের অধিকাংশই জাপানের পুঁজি প্রভাবিত এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক, মার্কিন প্রভাবাধীন আইএমএফ ও মূলত মার্কিন-ইউরোপিয়ান নানা লগ্নি বন্ডের থেকে নেওয়া। এছাড়াও আছে চিন ও ভারতের দেওয়া ঋণ। সংকটের জন্য শ্রীলঙ্কার টাকার (রুপি) মূল্য কমতে কমতে এক ডলার প্রায় ৩৪০ রুপিতে দাঁড়িয়েছে। বিদেশি মুদ্রার ভাঁড়ারও প্রায় শূন্য। এই যে বিপুল ঋণ সরকার নিয়েছে, তা কি সাধারণ মানুষের উপকারে লেগেছে? বিদেশি ঋণদাতাদের শর্ত মেনে সরকার অন্যান্য বুর্জোয়া দেশের মতোই বহুজাতিক কোম্পানিগুলির জন্য দেশের পরিকাঠামো ক্ষেত্রকে পুরোপুরি খুলে দিয়েছে। ফলে দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে অতিপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে খরচের বদলে পর্যটনের উন্নতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা দৃঢ় করার অজুহাতে রাস্তা, ফ্লাইওভার তৈরির হিড়িক পড়ে গেছে। আজকের বিশ্বায়নের ফরমুলায় দেশে দেশে এটাকেই উন্নয়ন বলে চালানো হচ্ছে। শ্রীলঙ্কাও সেই বিশ্বায়নের ফাঁদে পড়েছে। এই বিপুল পরিকাঠামো উন্নয়ন খরচ এখন যোগ হয়েছে শ্রীলঙ্কার ঋণের সাথে। এছাড়া বুর্জোয়া ব্যবস্থার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসাবে শ্রীলঙ্কা সরকারও অর্থনীতির সামরিকীকরণ করতে চাইছে। সে জন্য বাজেটের ১০.৩ শতাংশ তারা সামরিক খাতে ব্যয় করছে। যা সমস্ত জনকল্যাণমুখী খরচের থেকে বহুগুণ বেশি। সামরিক বাজেট বৃদ্ধির প্রেক্ষাপট তৈরি করতে দেশের তামিলভাষী মানুষ, মুসলমান, খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে শত্রুর আসনে বসিয়ে তীব্র জাতিঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে সরকারি দলের মদতে। এছাড়া প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে আকস্মিকভাবে ২০২১-এর এপ্রিল মাসে সমস্ত কেমিক্যাল সারের উপর সামগ্রিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে সমস্ত চাষে একমাত্র জৈব সার ব্যবহারের করার ফরমান দেন। তিনি কত পরিবেশবান্ধব এই চমক দিতে গিয়ে অপরিকল্পিত এই পদক্ষেপে দেশের কৃষি উৎপাদন, বিশেষত ধান এবং খাদ্য ফসলের চাষ মারাত্মকভাবে মার খায়। এরপর অক্টোবরে তিনি হঠাৎ এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে রাসায়নিক সারের আমদানির জন্য বেসরকারি মালিকদের ছাড়পত্র দেন। কৃষকদের জন্য সারে ভর্তুকি তুলে দেন তিনি। মূলত ভারত থেকে প্রচুর তরল নাইট্রোজেন সার আমদানি করে চড়া দামে কোম্পানিগুলি সে দেশের বাজারে ছাড়তে থাকে। এর ধাক্কায় নতুন করে ৫ লক্ষের বেশি কৃষিজীবী মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে নেমে গেছে।
২০২০ সালের পর কোভিডজনিত আর্থিক ক্ষতি থেকে দেশকে টেনে তোলার অজুহাতে পুঁজিপতিদের বিপুল কর ছাড় দিতে শুরু করে সরকার। পর্যটনকে রপ্তানি হিসাবে গণ্য করে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কর এই ক্ষেত্রের বৃহৎ ব্যবসায়ীদের জন্য মকুব করে দিয়েছে তারা। ফলে সরকারি কোষাগার ক্রমাগত দেউলিয়া হয়েছে। এই কারণে কোভিডজনিত দুঃসময়ে যখন দেশের সাধারণ মানুষ হাহাকার করছেন, ঠিক সেই সময় অন্য পুঁজিবাদী দেশের মতোই শ্রীলঙ্কার ধনকুবেরদের গায়ে এর কোনও আঁচড়ই পড়েনি। বরং তারা এই সময় বাড়তি মুনাফা করেছে। ২০২১-এর এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যেই শীর্ষ ৯ জন ধনকুবেরের আয় হয়েছে ৩৬৪ বিলিয়ন শ্রীলঙ্কান রুপি। তাদের মুনাফা বেড়েছে ১৮৯ শতাংশ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে শাসকদের সীমাহীন দুর্নীতি ও স্বজনপোষণ। বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপক্ষের দাদা ছিলেন এতদিন প্রধানমন্ত্রী, পরিবারের সাতজন সদস্য মন্ত্রিত্ব সহ নানা সরকারি পদ অলঙ্কৃত করেছেন। এই মন্ত্রীদের সম্বন্ধে যেমন বেআইনি সম্পত্তির পাহাড় গড়ার অভিযোগ আছে, তেমনই অন্য যারাই ক্ষমতায় বসেছেন তাঁদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে বিলাসী জীবন ও বিপুল সম্পত্তি বানানোর। শাসকদল এসএলপিপি (শ্রীলঙ্কা পোদুজনা পেরামুনা) উগ্র সিংহলি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। আসলে এসএলপিপি একা নয়, এই উগ্র সিংহলি জাতীয়তাবাদে ভর করেই দীর্ঘ সময় ধরে শ্রীলঙ্কার শাসকরা জনগণের ক্ষোভকে চাপা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। ১৯৮০-র দশকের শেষভাগ থেকে শ্রীলঙ্কায় যে সরকারই এসেছে তারা ক্রমাগত জনগণের সামাজিক সুরক্ষা খাতে খরচ ছাঁটাই করেছে। এর ধাক্কায় জনগণের মধ্যে দারিদ্র, সুষম খাদ্য-পুষ্টির অভাব, বেকারত্ব যখন বেড়ে চলেছে, শ্রীলঙ্কার শাসকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তামিল জনগোষ্ঠীর বিরোধে ইন্ধন দিয়ে জনগণের দৃষ্টিকে মূল সমস্যা থেকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তামিলদের উন্নয়নের প্রধান দাবিগুলিকে অবহেলা করে তাদের উপর ১৯৮৩ থেকে ‘৮৭-‘৮৮ পর্যন্ত ভয়াবহ নির্যাতন নিপীড়ন চালিয়েছে সরকার। বর্তমান শাসকরাও কোনও না কোনওভাবে ২০২০-র নির্বাচনের আগেও মূলত ভাষাগত এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর (তামিল, মুসলিম ও খ্রিস্টান) বিরুদ্ধে উগ্র জাতীয়তাবাদের জিগির তুলেই রাজাপক্ষের দল ক্ষমতা দখল করেছিল।
শ্রীলঙ্কার মতো ভৌগোলিক-সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দ্বীপরাষ্ট্রকে নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের আকর্ষণ বেশি এবং তা নিয়ে টানাটানি আছে। যতদিন বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক শিবির ছিল, শ্রীলঙ্কার শাসকরা বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদীদের কবল থেকে কিছুটা রেহাই পেতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চিনের সাথে মিত্রতার মধ্য দিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখত। কিছু কিছু সমাজতান্ত্রিক স্লোগান দিয়ে তারা নিজের দেশের জনগণকেও ভুলিয়ে রাখতে চাইত। পরবর্তীকালে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের দুর্বলতার কারণে মার্কিন-ব্রিটিশ পুঁজি এই দেশে তাদের প্রভাব বাড়াতে থাকে। ভারত মহাসাগর, আরব সাগর, বঙ্গোপসাগর হয়ে জাহাজ চালাচলের রাস্তা পুরোপুরি নিজেদের দখলে রাখতে শ্রীলঙ্কা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজি মালিকরাও নিজের প্রভাবাধীন অঞ্চল হিসাবে শ্রীলঙ্কাকে পেতে শ্রীলঙ্কার তামিল জনগোষ্ঠীর বিচ্ছিন্নতার মনোভাবকে উস্কানি দিয়ে সেখানে ঢুকতে চায় এবং শ্রীলঙ্কা সরকারের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। পরে সে দেশের সরকার নতি স্বীকার করলে ভারত সরকারই তামিল উগ্র জাতীয়তাবাদী সংগঠন এলটিটিই-কে দমন করার নামে শ্রীলঙ্কায় সরাসরি সেনা পর্যন্ত পাঠায়। এই আবহে ১৯৮৭ সালে ভারত-শ্রীলঙ্কা চুক্তিকে শ্রীলঙ্কার জনগণের বড় অংশ দাদাগিরি হিসাবেই দেখেছে। তাদের কাছে এটা ছিল জাতীয় অবমাননার নামান্তর। সে ক্ষত আজও শুকোয়নি। এদিকে ভারতের পুঁজিপতিরা কখনও সার, কখনও বিদ্যুৎ বা অন্য ক্ষেত্রে বিপুল লগ্নি করেছে। এখন আদানি গোষ্ঠী নানা পথে বিপুল বিনিয়োগ নিয়ে শ্রীলঙ্কায় ঢুকছে। সমাজতন্ত্র বিসর্জন দিয়ে সাম্রাজ্যবাদীতে পরিণত পুঁজিবাদী চিনও শ্রীলঙ্কায় বন্দরের নিয়ন্ত্রণ সহ নানা বিনিয়োগে ঢোকার জন্য ভারতের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা ভারত, অস্টে্রলিয়া, জাপানকে সাথে নিয়ে যে কৌশলগত অক্ষ গড়ে তুলতে চাইছে সেক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কায় চিনের প্রভাববৃদ্ধি তাদের পক্ষে ক্ষতিকর। ফলে এই অক্ষ এবং চিনের প্রবল টানাটানির মধ্যে পড়ে যায় শ্রীলঙ্কা। চিন চাপ দিতে থাকে আইএমএফ-এর সাথে তাদের সম্পর্ক ত্যাগ করতে হবে। তার জন্য চিন নিজে (৬৫০ কোটি ডলার) এবং বাংলাদেশ ও মায়ানমারকে দিয়ে ঘুরপথে সহজ শর্তে শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দিয়েছে। ভারতও তার প্রভাব বজায় রাখতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাই এবারের সংকটের সময় দেখা গেল ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী সর্বাগ্রে ছুটে গেছেন। ভারত সরকার ২৫০ কোটি ডলার ঋণও পাঠিয়ে দিয়েছে। তিনি এমনকি সাংবাদিকদের সাক্ষী রেখে পেট্রলপাম্পে লাইন দিয়ে থাকা মানুষের সাথেও কথা বলেছেন। অথচ ফ্রন্টলাইন পত্রিকার সাংবাদিক লিখছেন, শ্রীলঙ্কায় যখন আন্দোলন শুরু হল সে দেশের জনগণের মধ্যে ভারত বিরোধিতার সুর ছিল স্পষ্ট। ভারত সরকার যতই শ্রীলঙ্কার তামিল জনগোষ্ঠীর ত্রাতা সাজার চেষ্টা করুক, এই জনগোষ্ঠীও ভারত সরকারের উপর ক্ষুব্ধ। যে কারণে গণবিক্ষোভ ফেটে পড়তেই এখন ভারত সরকার বলতে শুরু করেছে সরকার নয়– আমরা শ্রীলঙ্কার জনগণের সাথে মৈত্রী চাই। চিনও তার সুর নরম করে একটু স্থিতিশীলতা চাইছে।
শ্রীলঙ্কার মানুষ আজ রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছেন। তাঁরা বহু বিপদের ঝুঁকি নিয়েও লড়ছেন। কিন্তু এই আন্দোলন কতদূর যাবে তা নির্ভর করবে এর রাজনৈতিক দিশার উপর। গত মার্চ মাসে যখন শুরু হয়েছে তখন থেকেই এই আন্দোলনকে বুর্জোয়া সংবাদমাধ্যম অরাজনৈতিক হিসাবে দেখাতে চাইছে। প্রথম দিকে জোরদার ভাবে শুরু হয়েও কিছুদিন পর যখন এই আন্দোলন কিছুটা ঝিমিয়ে গিয়েছিল তখন বৃহৎ সংবাদ মাধ্যম এটাকে সোস্যাল মিডিয়ার আন্দোলন আর কিছুটা যেন পিকনিকের মতো অবস্থান-ধর্না বলে তুলে ধরছিল। জনগণ যাতে রাস্তায় না নামে, অথচ জ্বালাময়ী বত্তৃতার মধ্য দিয়ে কিছুটা ক্ষোভ বেরিয়ে গিয়ে আবার স্থিতিশীলতায় ফিরে আসে এজন্য এই ‘হাসট্যাগ ৩৯’ নাম দিয়ে এর পিছনে টাকা ঢালছিল বড় কোম্পানিগুলিও। যার তীব্র প্রতিবাদ করে ‘সিলোন কমিউনিস্ট ইউনিটি সেন্টার’ বলেছিল, আরব বসন্তের উদাহরণ টেনে এই আন্দোলনকে নির্বিষ করার যে চেষ্টা হচ্ছে তা থেকে জনগণকে সচেতন থাকতে হবে। তারা প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিকে প্রধান দাবি করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানায়। এই দল বামপন্থী শক্তিগুলি এবং সৎ মানুষদের এগিয়ে এসে জাতিবাদী, সাম্প্রদায়িক মানসিকতামুক্ত হয়ে একত্রে লড়বার আহ্বান জানিয়েছে।
দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষ কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করে রক্ত দিতে প্রস্তুত। এদিকে শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বামপন্থী-সাম্যবাদী আন্দোলনের দুর্বলতার জন্য শ্রীলঙ্কার জনগণের এই আত্মত্যাগকে সঠিক লক্ষ্যে পোঁছানো যাবে কিনা সেটা যে কোনও মুক্তিকামী মানুষকেই ভাবাচ্ছে। সে দেশে একজন প্রেসিডেন্টের বদলে হয়ত আর একজন প্রেসিডেন্ট আসবে। কিন্তু জনগণের জীবনের মূল সমস্যার সমাধান হবে না, যদি না এই লড়াই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একটা সঠিক মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দল সে দেশে শক্তি অর্জন করে পুঁজিবাদী শোষণচক্র থেকে মুক্তির রাস্তায় লড়াইকে নিয়ে যেতে পারে। আশার কথা হল সরকারের চক্রান্তকে ব্যর্থ করে সে দেশের সিংহলি, তামিল, বৌদ্ধ, মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান সহ সমস্ত জনগোষ্ঠী একযোগে লড়াইয়ে নেমেছেন। এই ঐক্য সুদৃঢ় হোক– এই আশা নিয়েই ভারতের মুক্তিকামী মানুষ প্রতিবেশী দেশের সাধারণ মানুষের লড়াইকে কুর্নিশ জানাচ্ছে।