কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের টিকা-নীতির বিরুদ্ধে একটি মারাত্মক অভিযোগ প্রথম থেকেই উঠছে– এই টিকা-নীতি বৈষম্যবাদী। কেন এই অভিযোগ? কারণ মোদির এতদিনকার ঘোষিত নীতি ছিল, কেন্দ্রীয় সরকার টিকা দেবে শুধু মাত্র ৪৫ বছর বা তার বেশি বয়সীদের। বাকিদের দায়িত্ব কেন্দ্র নেবে না। এর মধ্যে ১৮-৪৪ বছর বয়সীদের দায়িত্ব পালন করতে হবে রাজ্য সরকারকে। এই ঘোষণার পরই প্রশ্ন উঠেছিল, কেন? যেখানে অতিমারি রুখতে প্রয়োজন দেশের প্রতিটি মানুষের টিকাকরণ, সেখানে কোন বিচারে কেন্দ্রীয় সরকারের এমন সিদ্ধান্ত। শুধু সোশ্যাল মিডিয়া নয়, সর্বত্র এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হন সাধারণ মানুষ। এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর আহ্বানে সকলের জন্য বিনামূল্যে ভ্যাকসিনের দাবিতে অনলাইনে দেশব্যাপী স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়। এই কর্মসূচিতে প্রবল উৎসাহে সাড়া দেন মানুষ। প্রতিটি রাজ্য থেকে বিভিন্ন ভাষায় লক্ষ লক্ষ স্বাক্ষরিত দাবিপত্র অনলাইনে পাঠানো শুরু হয় প্রধানমন্ত্রীর দফতরে। অফলাইনেও বিভিন্ন প্রশাসনিক দপ্তরের সামনে করোনা বিধি মেনে বিক্ষোভ ডেপুটেশনের কর্মসূচি নেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরাও বৈষম্যবাদী টিকা নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। আন্তর্জাতিক স্তরেও বিজেপি সরকারের এই নীতির বিরুদ্ধে ধিক্কার ওঠে। বিভিন্ন রাজ্য সরকারও কেন্দ্রের উপর চাপ বাড়াতে থাকে।
শেষপর্যন্ত দেশজোড়া প্রতিবাদ ও বিদেশের নিন্দার মুখে পড়ে ৭ জুন প্রধানমন্ত্রী মোদি ঘোষণা করতে বাধ্য হন, ২১ জুন থেকে কেন্দ্রীয় সরকার ১৮ বা তদূর্ধ্বদের বিনামূল্যে টিকা দেবে। এই ঘোষণা করতে এত দেরি হল কেন? প্রথমেই কেন কেন্দ্রীয় সরকার বিনামূল্যে সার্বিক টিকাকরণের ব্যবস্থা করেনি? এর প্রধান কারণ, তাদের লক্ষ্য ছিল টিকা প্রস্তুতকারী কোম্পানিকে বিপুল মুনাফা পাইয়ে দেওয়া। বিষয়টি পরিষ্কার হবে, টিকার দামের দিকে তাকালে। কেন্দ্র জানিয়েছিল, টিকা প্রস্তুতকারী কোম্পানি থেকে তারা টিকা কিনছে ১৫০ টাকায়। ঐ টিকাই রাজ্যকে কিনতে হবে ৩০০-৪০০ টাকায়। আর বেসরকারি হাসপাতালকে কিনতে হবে হাজারেরও বেশি টাকায়। কেন্দ্র টিকা কিনে রাজ্যকে দিলে অর্ধেক টাকাতেই টিকা মিলতো। কেন তা হল না? এর একমাত্র কারণ টিকা প্রস্তুতকারী কোম্পানিকে বিপুল মুনাফা পাইয়ে দেওয়া। বিনামূল্যে টিকা দেওয়ার কথা ঘোষণার পরেও তা কার্যকর করতে কেন ১৪ দিন দেরি করল সরকার? ১৪দিনে আরও মুনাফা তুলে নিক পুঁজিপতিরা এটাই কি উদ্দেশ্য নয়?
প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, উৎপাদিত টিকার ৭৫ শতাংশ কেন্দ্র কিনলেও বাকি ২৫ শতাংশ কিনবে বেসরকারি হাসপাতাল। তারা এমনিতেই চড়া দামে টিকার ডোজ কিনছে। সরকার বলেছে, প্রতি ডোজের জন্য পরিষেবা বাবদ আরও ১৫০টাকা নিতে পারবে। কিন্তু এ তো সরকারি নির্দেশ। সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন উচ্চ হারে ফি আদায় করে চলছে, টিকার ক্ষেত্রেও তেমনি বেসরকারি হাসপাতাল সর্বোচ্চ মুনাফা করতে ইচ্ছা মতো চার্জ বসাতে পারে। জানা গেছে, বেসরকারি হাসপাতালে এই দাম হবে সার্ভিস চার্জ সহ কোভিশিল্ড ৭৮০ টাকা, কোভ্যাক্সিন১৪১০টাকা, স্পুটনিক ভি ১১৪৫ টাকা। এক দেশ এক আইনের কথা যারা বলেন, তারা মালিকের মুনাফার স্বার্থে কীভাবে নিজেদের নিয়মকে নিজেরাই ভাঙেন, এই ঘটনা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি হাসপাতালগুলির মধ্যে টিকা কেনার দৌড়ে এগিয়ে রয়েছে ৯টি বড় হাসপাতাল। ৫০ শতাংশ টিকা তারা নিজেরাই কিনে নিয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে অ্যাপোলো, ম্যাক্স হেলথ কেয়ার, রিলায়েন্সের এইচ এন হসপিটাল ট্রাস্ট, মেডিকা, ফর্টিস, গোদরেজ, মণিপুর হেল, নারায়ণা হৃদয়ালয়, টেকনোলজি ইন্ডিয়া ডামা। এদের দাপটে মাঝারি ও ছোট হাসপাতালগুলি টিকা ক্রয় থেকে পিছু হটছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, সাধারণ ভাবে মোদিজির টিকা-নীতি পুঁজিপতিদের স্বার্থে হলেও বিশেষ ভাবে তা একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থে।
কেন্দ্রীয় সরকার ১৮বছর বয়স পর্যন্ত বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দিতে রাজি হলেও সর্বশেষ খবর হল দেশে ভ্যাকসিনের অভাব রয়েছে ব্যাপক। বরাত দেওয়া ভ্যাকসিনের কোনওটা মিলবে আগস্ট -সেপ্টেম্বরে, কোনটা ডিসেম্বরে। এই হল প্রধানমন্ত্রীর কর্মতৎপরতার আসল চেহারা।
ভাষণ নয়, গালভরা প্রতিশ্রুতি নয়– মানুষ চায় সঠিক সময়ে সঠিক কাজ। এক্ষেত্রে সরকার ডাহা ফেল। দেখা যাচ্ছে, একমাত্র জোরদার আন্দোলনের চাপেই সরকারকে বাধ্য করা যায় দাবি মানতে। শক্তিশালী প্রতিবাদ-আন্দোলনের চাপেই প্রধানমন্ত্রী বাধ্য হয়েছেন বিনামূল্যে টিকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করতে। তাই, প্রধানমন্ত্রীকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিনের প্রতিশ্রুতি সময় মতো পালন করতে হবে, গয়ংগচ্ছ ভাব চলবে না– এই দাবিতে দেশ জুড়ে আন্দোলন জারি রাখতে হবে। দাবি তুলতে হবে, ১৮ বছরের কমবয়সীদের টিকা দেওয়ার অনুমতি পাওয়া গেলে, তাও দিতে হবে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে।