বিনামূল্যের ১৩২০টি জীবনদায়ী ওষুধ হাসপাতালে সরবরাহ বন্ধ করে দিল তৃণমূল সরকার

১ এপ্রিল রাজ্যের জনগণকে ‘এপ্রিল ফুল’ করল তৃণমূল সরকার৷ বোকা বানাল পশ্চিমবঙ্গবাসীকে৷ বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়ার সরকারি প্রতিশ্রুতি কার্যত প্রত্যাহার করে নিল৷

ওই দিন থেকে রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলিতে দেওয়া বিনামূল্যে ওষুধের সংখ্যা বিপুল পরিমাণে কমিয়ে দেওয়া হল৷ জেলা হাসপাতালগুলিতে ওষুধের সংখ্যা ৭৫ শতাংশ কমানো হল৷ মহকুমা ও ব্লক হাসপাতালগুলিতে বিনামূল্যে ওষুধের সংখ্যা আরও কমানো হয়েছে৷ বাস্তবে বিনামূল্যে ওষুধ পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছে৷ তাহলে সরকারের এত ঢাক–ঢোল পিটিয়ে ফ্রি–তে ওষুধ দেওয়ার ঘোষণা কেন?

বন্ধ করা ওষুধগুলির বেশিরভাগই জীবনদায়ী৷ কেমোথেরাপি থেকে শুরু করে স্ট্রোকের পরে রোগীকে বাঁচানোর জরুরি ওষুধ সমস্তই রয়েছে এই তালিকায়৷ এ ধরনের ১৬০০টি জীবনদায়ী ওষুধ কমিয়ে করা হয়েছে ৪৮০৷ শুধু তাই নয়, এই ৪৮০টি ওষুধের মধ্যে কোন হাসপাতালে কোন ওষুধ থাকবে, তা ঠিক করবে জেলা এবং মেডিকেল কলেজ স্তরের হাসপাতালই৷ অর্থাৎ ৪৮০টি ওষুধও সব হাসপাতালে পাওয়া যাবে না৷

বেশিরভাগ মানুষের জন্য নেওয়া বিনামূল্যে ওষুধ প্রকল্প মর্জিমাফিক সরকার বন্ধ করতে পারে কি? এক স্বাস্থ্য অধিকর্তার সাফাই, ‘দামি ওষুধ বাদ দিয়ে পাঁচজন সাধারণ রোগীর মূলত যে সব ওষুধের প্রয়োজন হয়, তাই রাখা হয়েছে’৷ চিকিৎসকদের প্রশ্ন, তাহলে শিশুদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় আইসোলাইটের মতো সলিউশন বাদ কেন? তার উত্তরে স্বাস্থ্য অধিকর্তা জানান, সলিউশন তৈরি করে নিলেই হল৷ প্রশ্ন উঠেছে, নার্স বা ডাক্তারদের পক্ষে কি সরকারি হাসপাতালের পরিকাঠামোয় শিশুদের সংক্রমণ বা সেপসিস নিয়ন্ত্রণ করতে তড়িঘড়ি সলিউশন বানানো সম্ভব? এর উত্তর অবশ্য স্বাস্থ্যকর্তারা দেননি৷

সারা দেশের মতো এ রাজ্যেও গরিব মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, বাড়ছে কাজ হারানো মানুষের সংখ্যা৷ ছাঁটাই হচ্ছে অসংখ্য মানুষ৷ দু’বেলা খাবার জোটানোই কঠিন হয়ে পড়ছে বহু মানুষের৷ সেখানে হাসপাতালের ওষুধ বন্ধ হলে, সাধারণ মানুষের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবার আর কী অবশিষ্ট রইল? সরকারি হাসপাতালে পরিকাঠামোগত নানা অসুবিধা সত্ত্বেও হতভাগ্য এই মানুষগুলিকে সেখানেই ছুটতে হয়৷ ভোর থেকে উঠে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে বাসে–ট্রেনে–ভুটভুটি চেপে জেলা কিংবা ব্লক হাসপাতালে রোগী নিয়ে পৌঁছনোর মরীয়া চেষ্টা করে তারা৷ হাতে পয়সা নেই, সরকারি হাসপাতালে পৌঁছালে ডাক্তারবাবু যা হোক কিছু একটা ব্যবস্থা করবে, নিখরচায় কিছু ওষুধ পাওয়া যাবে, অন্তত প্রিয়জনের প্রাণ বাঁচানো যাবে, এমনই আশা করে দূর–দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন রোগীর আত্মীয়–পরিজনরা৷ তাদের আশা নিরাশায় পরিণত হচ্ছে সরকারের এই অমানবিক সিদ্ধান্তে৷

বেসরকারি হাসপাতালে সরকারের যেটুকু রাশ ছিল, তাও উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে৷ রোগীর পরিজনদের নিংড়ে নেওয়ার ছাড়পত্র জোগাড় করেছে বেসরকারি হাসপাতালগুলি৷ কোনও কোনও কর্পোরেট হাসপাতালে চিকিৎসক রোগীদের কত বেশি পরীক্ষা–নিরীক্ষা, কত অপারেশন করাতে পারছে, তার ভিত্তিতে  মাইনে চালু করার নীতিও সরকার মেনে নিয়েছে৷ চিকিৎসকের মতো একটা মহৎ পেশাকে দালালের স্তরে নামিয়ে আনার বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের প্রচেষ্টার বিরোধিতা না করে কার্যত তাতে রাবার স্ট্যাম্প লাগিয়েছে সরকার৷

এই নীতির ফল হিসাবেই আমরি কিংবা অ্যাপোলোর মতো কর্পোরেট হাসপাতালে মর্মান্তিক শিশুমৃত্যুর ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে৷ সরকার বলেছিল, বেসরকারি হাসপাতালগুলির ফি স্ট্রাকচার এমন থাকবে, যাতে যারা বেসরকারি হাসপাতালে যেতে বাধ্য হবে, তাদের পরিবার নিয়ে পথে বসতে না হয়৷ কিন্তু তা কথাতেই থেকে গেছে৷ একদিকে সরকারি হাসপাতালে নানা তুঘলকি সিদ্ধান্ত, অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালের রক্তচোষা নীতি রোগীর পরিজনদের অসহায় অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে৷

(৭০ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা ২০ এপ্রিল, ২০১৮)