আবারও মন্ত্রী, বিধায়কদের বেতন ও ভাতা বিপুল পরিমাণে বাড়ালো রাজ্যের তৃণমূল সরকার। ৪০ হাজার টাকা করে বাড়িয়ে বিধায়কদের মাসিক ভাতা সহ বেতন হল ১ লক্ষ ২১ হাজার টাকা, প্রতিমন্ত্রীদের ১ লক্ষ ৪৯ হাজার ৯০০ টাকা এবং পূর্ণমন্ত্রীদের ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। রাজ্যবাসী স্তম্ভিত। মানুষ যখন ভয়ঙ্কর মূল্যবৃদ্ধিতে দিশেহারা, নিশ্চিত রোজগার নেই, করবৃদ্ধি, ভাড়া বৃদ্ধিতে জেরবার হয়ে ভেবে পাচ্ছে না সংসার চালাবে কী করে, তখন সেই আর্থিক সঙ্কট লাঘবের কোনও চেষ্টা না করে নিতান্ত স্বার্থপরের মতো এঁরা নিজেরা নিজেদের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে নিলেন!স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, বিধায়ক-মন্ত্রীরা তো জনপ্রতিনিধি। জনগণ এঁদের নির্বাচিত করেছেন তাদের সুবিধা-অসুবিধা, সুখ-দুঃখ দেখার জন্য। অথচ সে সবের বদলে তাঁরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন নিজেদের বেতন বাড়াতে! এ প্রশ্নও উঠছে, যে জনগণকে দুরবস্থার মধ্যে ফেলে রেখে তাঁরা নিজেদের বেতন বিপুল পরিমাণে বাড়িয়ে নিলেন সেই টাকা তো এই বঞ্চিত জনগণের করের টাকা থেকেই আসছে। এঁদের কি তা হলে জনগণের প্রতিনিধি বলা চলে?
এই অমানবিক বেতনবৃদ্ধির সাফাই গাইতে মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় বলেছেন, দেশের অন্য রাজ্যগুলির বিধায়কদের সঙ্গে সমতা আনতেই তাঁরা বিধায়ক-মন্ত্রীদের এতটা বেতন বাড়ালেন। হায় রে, সমতার কী অদ্ভুত নজির! এই মুখ্যমন্ত্রীই হয় কথায় নয় কথায় ‘হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে’র নজির টানেন, আর বিধায়কদের বেতন বাড়ানোর বেলাতেই তিনি অন্য রাজ্যের নজির টানলেন! তা ছাড়া মুখ্যমন্ত্রীর শুধু বিধায়কদের বেতনের সমতা আনতেই অন্য রাজ্যের কথা মনে পড়ল! অন্য বহু রাজ্য যে শিক্ষা, চিকিৎসা, আর্থিক দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে সে কথা তাঁর মনে এল না কেন? সেই ক্ষেত্রে সমতা আনার কথা তো তাঁর মুখে কখনও শোনা যায়নি।
প্রশ্ন উঠেছে, মুখ্যমন্ত্রী কেন শুধু বিধায়কদের বঞ্চনাই দেখতে পেলেন? এ রাজ্যে আশা, অঙ্গনওয়াড়িতে যে লক্ষ লক্ষ কর্মী ভিক্ষাতুল্য অনুদানে কাজ করছেন তাদের আর্থিক বঞ্চনার কথা একবারের জন্যও কেন তাঁর মনে পড়ল না? এ রাজ্যের মিড-ডে মিল কর্মীদের মাসিক বেতন মাত্র দেড় হাজার টাকা। এই বঞ্চনা কি সরকারের চোখে পড়ে না? আরও বিস্ময়কর হল, তাঁদের ১২ মাসের বেতন দেওয়া হয় না। দেওয়া হয় মাত্র দশ মাস। তা হলে বাকি দু’মাস তাঁরা কী খেয়ে বাঁচবেন, মুখ্যমন্ত্রী কখনও ভেবে দেখেছেন? আরও বঞ্চনার বিষয়, এ রাজ্যে গত ১১ বছর ধরে মিড-ডে মিল কর্মীদের বেতন বাড়ানো হয়নি। বেতন বাড়ানো হচ্ছে না পৌর স্বাস্থ্যকর্মীদের। স্কুল-কলেজে হাজার হাজার অস্থায়ী শিক্ষক অধ্যাপক স্থায়ী অধ্যাপকদের তুলনায় অর্ধেকেরও কম বেতনে পড়াচ্ছেন। প্রশাসনের সমস্ত ক্ষেত্রে হাজার হাজার চুক্তিতে নিযুক্ত কর্মচারী অন্যায় রকমের কম বেতনে কাজ করছেন। তাঁদের বেতনে সমতা আনার কথা মুখ্যমন্ত্রী একই সঙ্গে ভাবলেন না কেন? অন্য রাজ্যের সরকারি কর্মচারীরা যখন পশ্চিমবঙ্গের কর্মচারীদের থেকে অনেক বেশি ডিএ পাচ্ছেন, সে ক্ষেত্রে তিনি অন্য রাজ্যের নজির মেনে সে ক্ষেত্রে সমতা আনার কথা ভাবলেন না কেন? লক্ষ লক্ষ শিক্ষক পদ শূন্য, নিয়োগ নেই, স্কুলে-কলেজে কে পড়াবে তার কোনও ঠিক নেই। এই যখন অবস্থা তখন মুখ্যমন্ত্রী সেই সব ক্ষেত্রে নিয়োগের জন্য টাকা বরাদ্দ না করে, মন্ত্রী-বিধায়কদের মাসিক বেতন দেড় লাখ টাকা করে দিলেন। চমৎকার রাজ্য শাসন! এ রাজ্যের অগ্রগতি রুখবে কে!
মুখ্যমন্ত্রী কথিত এ রাজ্যের ‘বঞ্চিত’ মন্ত্রী-বিধায়কদের আর্থিক পরিস্থিতি কি নুন-আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থায়? মন্ত্রী-বিধায়করা কি রাজ্যের সাধারণ মানুষকে জানাবেন, অনেক রেখেঢেকেও তাঁদের সম্পত্তির কী পরিমাণ তাঁরা নির্বাচন কমিশনের কাছে দাখিল করেছেন? এডিআর (অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিসার্চ) বহুবার নির্বাচন কমিশনের তথ্য উদ্ধৃত করে দেখিয়েছে, নির্বাচিত বিধায়ক-সাংসদদের ৮০ শতাংশেরও বেশি কোটিপতি। বাকিরাও আশেপাশে। এই সমস্ত মন্ত্রী-বিধায়কদের অঘোষিত সম্পত্তির পরিমাণ যে বিপুল তা তাঁদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রাতেই পরিষ্কার। এখন নির্বাচনে জিততে শাসক বা বিরোধী সব রাজনৈতিক দলই কোটি কোটি টাকা ঢালে। স্বাভাবিক ভাবেই বিপুল টাকা বিনিয়োগ করে জেতা বিধায়কদের বেশিরভাগেরই লক্ষ্য থাকে এই বিনিয়োগকে বহু গুণ বাড়িয়ে ফিরিয়ে আনা। জনপ্রতিনিধি হিসাবে দেশসেবা, জনসেবার ছিটেফোঁটাও এই ভোটসর্বস্ব দলগুলির রাজনীতিতে কোথাও নেই। এ ছাড়া পাঁচ বছর ধরে আইনি-বেআইনি বিচিত্র পথে কোটি কোটি টাকা কামানোর দুর্নীতি চক্র চলছে। এহেন বিধায়কদের যদি বঞ্চিত বলা হয়, তা হলে বঞ্চনা শব্দের মানেই বদলে যায়।
বিধায়কদের বেতনবৃদ্ধি, ভাতা বৃদ্ধি কেবল তৃণমূলের শাসনেই হচ্ছে তা নয়। সিপিএমের ৩৪ বছরের শাসনে বারবার বিধায়কদের, বেতন-ভাতা বাড়ানো হয়েছে। এসইউসিআই(কমিউনিস্ট)-এর বিধায়ক দেবপ্রসাদ সরকার, প্রবোধ পুরকাইত, জয়কৃষ্ণ হালদার, পরবর্তী কালে বিধায়ক তরুণ নস্কর তার বিরোধিতা করেছেন। সংসদে কংগ্রেস সরকার যখন সাংসদদের বেতন ভাতা বাড়িয়েছে এসইউসিআই(সি) সাংসদ ডাঃ তরুণ মণ্ডল তার বিরোধিতা করে বর্ধিত বেতন নিতে অস্বীকার করেছেন। সংসদে তিনি ছিলেন এ বিষয়ে একক সোচ্চার কণ্ঠ। যে বিজেপি এ রাজ্যের বিধায়কদের বেতনবৃদ্ধির বিরুদ্ধে বলছে, সেই বিজেপির সাংসদরা সংসদে সেদিন বেতনবৃদ্ধির সমর্থনে দাঁড়িয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও সাংসদদের বেতন ও ভাতা বাড়িয়েছেন। আর মুখ্যমন্ত্রী অন্য যে রাজ্যগুলির নজির টানলেন তার বেশিরভাগই তো বিজেপি, কংগ্রেস এবং সিপিএম শাসিত। ফলে বিরোধী কারও ক্ষেত্রেই এই অন্যায় বেতনবৃদ্ধির প্রতিবাদ নীতিভিত্তিক নয়, কংগ্রেস-সিপিএম নেতারা যে এর প্রতিবাদ করছেন তা নিছকই রাজ্যে তাঁদের কোনও বিধায়ক নেই বলে।
চরম অমানবিক, দৃষ্টিকটু এবং স্বৈরাচারী কায়দায় জনপ্রতিনিধিদের বেতন বাড়ানোর ঘটনায় সাধারণ মানুষ প্রবল ক্ষুব্ধ। শুধু ক্ষোভ নয়, সর্বত্র বিধায়ক-মন্ত্রীদের প্রশ্ন করতে হবে, কেন তাঁরা জনগণকে চরম দুরবস্থার মধ্যে ফেলে রেখে এমন স্বার্থপরের মতো নিজেদের বেতন বাড়িয়ে নিলেন? তাই সর্বত্র দাবি উঠুক– রাজ্যের বিধায়কদের যদি দুর্দশাগ্রস্ত সাধারণ মানুষ, বঞ্চিত সরকারি কর্মচারী, আধা সরকারি কর্মচারী মানুষের প্রতি কোনও সহমর্মিতা থাকে তবে যতক্ষণ না তাঁদের বেতন মানুষের বেঁচে থাকার মতো হচ্ছে, যত দিন পর্যন্ত তাঁদের বিধানসভা এলাকায় একজন মানুষও অভুক্ত, অর্ধভুক্ত থাকবে ততদিন নিজেদের বেতন বাড়ানো থেকে তাঁরা বিরত থাকুন। যদি তাঁরা প্রকৃত জনপ্রতিনিধি হন, তা হলে এই অনৈতিক বেতনবৃদ্ধি প্রত্যাখ্যান করুন।