২৮ মার্চ যখন দেশের রাস্তায় রাস্তায়, কলে-কারখানায়-বন্দরে-শহরে-গ্রামে মানুষ ধর্মঘট করতে গিয়ে গ্রেফতার হচ্ছে, পুলিশি অত্যাচারের সম্মুখীন হচ্ছে তখন তাদেরই ভোটে নির্বাচিত, তাদেরই করের টাকায় পোষিত বিরোধী এবং সরকার পক্ষের বিধায়করা বিধানসভায় এমন এক ন্যক্কারজনক ঘটনায় মেতে থাকলেন যা জনগণের স্বার্থের সাথে সম্পর্কশূন্য শুধু নয়, সভ্য মানুষের আচরণেরও সম্পূর্ণ বিরোধী। একটি বিষয় নিয়ে বিরোধীপক্ষের বিধানসভায় আলোচনার দাবি এবং স্পিকারের তা নাকচ করে দেওয়াকে কেন্দ্র করে যেভাবে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে উভয় পক্ষের বিধায়করা হাতাহাতি-মারামারি বাধালেন এবং তাতে কারও নাকের হাড় ভাঙল, কারও জামা ছিঁড়ল, কেউ পাঁজরে চোট পেলেন, তা বিধানসভার সদস্যদের নয়, পাড়ার গুন্ডাদের পক্ষেই শোভা পায়। অথচ ওই দিন ধর্মঘটের বিষয় ছিল ভোজ্য ও জ্বালানি তেল, রান্নার গ্যাস, ওষুধ সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসের ব্যাপক দামবৃদ্ধি এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যে ভাবে জলের দামে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে তার প্রতিবাদ। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি ২৮-২৯ মার্চ দেশজোড়া এই ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। দেশের কৃষক সংগঠনগুলি এবং নানা গণসংগঠনগুলি এই ধর্মঘটকে সমর্থন জানিয়েছিল। জনপ্রতিনিধিরা কিন্তু দাবিগুলি নিয়ে বিধানসভায় কোনও আলোচনার দরকারই মনে করলেন না।
স্বাভাবিক ভাবেই সাধারণ নাগরিকদের মনে প্রশ্ন উঠেছে, সব রকমের সভ্যতা, শালীনতা, দায়িত্ববোধকে ছুঁড়ে ফেলে তাঁরা এমন অসভ্যতায় মাতলেন কী করে? জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেও এই সব বিধায়করা কি সত্যিই নিজেদের জনগণের প্রতিনিধি মনে করেন? জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে তাঁদের দায়িত্ব কি তাঁরা স্মরণে রাখেন? সেদিন তো তাঁদের দায়িত্বই ছিল বাইরের রাস্তায় শোষিত মানুষ, শ্রমজীবী মানুষ তাঁদের দাবিগুলি নিয়ে যে লড়াই চালাচ্ছেন, সেই লড়াইকেই বিধানসভার ভিতরে পৌঁছে দেওয়া। পরিবর্তে তাঁরা যা করলেন তাতে সাধারণ মানুষ লজ্জায় মাথা নিচু করলেও বিধায়কদের আচরণে তার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না।
বিধায়ক হিসাবে যাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন তাঁদের দায়িত্ব জনগণের অভাব-অভিযোগ, আশা-আকাঙ্খা, দাবিগুলি বিধানসভায় তুলে ধরা, যুক্তি দিয়ে সেগুলিকে প্রতিষ্ঠা করা, তার পক্ষে ব্যবস্থা নিতে সরকারকে বাধ্য করা, জনস্বার্থে নতুন আইন তৈরি করা, জনস্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর পুরনো আইন বাতিল করা। ইদানিং বিধায়কদের ভূমিকা দেখে অবশ্য বোঝার উপায় নেই যে, এই সব দায়িত্ব পালন করতেই তাঁরা বিধানসভায় পা রেখেছেন। অথচ তাঁরা এই দায়িত্ব যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে পালন করবেন, এই কথা ভেবেই তো সরকারি ভাঁড়ার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। বিধায়কদের বিপুল হারে ভাতা, অঢেল সুযোগ-সুবিধা ও পেনশনের ব্যবস্থা তো এই অজুহাতেই। অথচ দেশের অধিকাংশ মানুষ কী ভাবে দিন কাটাচ্ছে তা তো তাঁদের অজানা নয়। বিরাট অংশের মানুষের রোজগার নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের দাম প্রতিদিন বাড়ছে। বেকার ছেলেমেয়েরা একটা কাজের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। জনগণের উপর পুঁজিপতি শ্রেণির শোষণ অতীতের সব মাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে এ-সবের বিরুদ্ধে কী ভূমিকা পালন করছেন তাঁরা!
পার্লামেন্টারি ব্যবস্থার গোড়ার দিকে পুঁজিবাদ যখন একচেটিয়া স্তরে পৌঁছে সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র অর্জন করেনি তত দিন রাজনৈতিক দলগুলি পুঁজিপতি শ্রেণির কোনও না কোনও গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করলেও জনস্বার্থকে আজকের মতো এমন করে পুরোপুরি ছুঁড়ে ফেলে দেয়নি। তখন কিছুটা হলেও জনস্বার্থে তাদের কাজ করতে হত। সেদিন প্রতিবাদের অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের যে পতাকা তারা তুলে ধরেছিল, আজ সে-সব কিছুকেই তারা পদদলিত করছে। আজ পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদী স্তরে পৌঁছে পুঁজির ব্যাপক কেন্দ্রীভবন ঘটানোর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রকে একচেটিয়া পুঁজির লেজুড়ে পরিণত করেছে।
অন্য দিকে বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া দলগুলি তাদের দল চালানো, নির্বাচনী খরচ চালানো, নেতাদের বিলাসী জীবন চালানোর জন্য পুঁজিপতিদের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারে শাসক এবং বিরোধী দলে কোনও ফারাক নেই। যে পুঁজিপতি শ্রেণির টাকায় তাঁদের দল চলে, তারই অঢেল খরচে নির্বাচিত হয়ে তাঁরা রাজার মতো জীবনযাপন করেন, সেই পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে তাঁরা কি আদৌ জনস্বার্থের পক্ষে দাঁড়াতে পারেন? তা ই কি বিধানসভায় কি লোকসভা-রাজ্যসভায় কোনও রকম বিরোধিতা ছাড়াই অনায়াসে একের পর এক শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ মানুষের স্বার্থবিরোধী আইন পাশ হয়ে যায়। জনগণের ভোটে নির্বাচিত এই সব প্রতিনিধিরা কেউ হাত তুলে সমর্থন করেন, কেউ নিরপেক্ষতার ভান করেন, কেউ প্রবল বিরোধিতার নাটক করে ওয়াক আউটের নাম করে আইন পাশের রাস্তা সহজ করে দেন। অন্য দিকে জনস্বার্থের সাথে সম্পর্কহীন বিষয়গুলিকেই গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে দেখিয়ে তুলকালাম বাধান, মারামারি করেন, পরস্পরকে গালিগালাজ করেন। এই ভাবে জনগণের চোখে ধুলো দিয়েই তাঁরা রাজনীতির কারবারি হয়ে ওঠেন। এ জিনিস শুধু এই প্রথম ঘটল না, কিছু দিন আগেই একবার কংগ্রেস পরে আবার সিপিএম বিধায়করা একই কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, তামিলনাড়ূ প্রভৃতি নানা রাজ্যের বিধানসভায় যেমন এমন কাণ্ড ঘটেছে, তেমনই লোকসভাতেও বারে বারে কাগজ ছোঁড়াছুড়ি, ধাক্কাধাক্কির ঘটনা নিয়মিত ঘটে চলেছে। বাস্তবিক এই দলগুলির রাজনীতিতে জনস্বার্থই নেই তো, কার হয়ে তাঁরা তর্ক-বিতর্ক, আলাপ-আলোচনা করবেন। নীতির লড়াই কোথাও নেই, দুর্নীতির সংঘাত আছে। জনগণের সম্পদ কে কতখানি লুঠ করতে পারবে তারই প্রতিযোগিতা চলছে। আর যুক্তি যখন থাকে না, তখন পেশিশক্তিই হয়ে ওঠে একমাত্র ভরসা।
এই সব রাজনৈতিক দলগুলি আজ যেমন পুঁজিপতি শ্রেণির ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছে, তেমনই রাজনীতিকে জনগণের সম্পদের অবাধ লুঠপাটের হাতিয়ারে পরিণত করে ফেলেছে। তাই রাজনীতিতে সৎ, দরদি, সংগ্রামী মানুষের পরিবর্তে বাহুবলী, সমাজবিরোধীদের ভিড় বাড়ছে। কোটি কোটি টাকায় বিক্রি হচ্ছে বিধানসভা লোকসভার প্রার্থীপদ। ফলে রাজনীতিতে নীতি-আদর্শের কোনও বালাই থাকছে না। সেদিন বিধায়করা নাকি বগটুই গণহত্যা নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন! যদি সত্যিই তা চাইতেন তা হলে এই আচরণ করতেন? আর আলোচনা কি-ই বা করতেন তাঁরা! যাঁরা সেদিন মারপিট করলেন তারা অনেকেই কিছুদিন আগেও অন্য দলের ‘সম্পদ’ ছিলেন। সুবিধা বুঝে জামা বদলেছেন। আর যে দলেই তাঁরা যান না কেন, যারা যেখানে ক্ষমতায় রয়েছে, সেখানে বগটুইয়ের মতো ঘটনা ঘটিয়েছেন। দলবদল আজ রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই এঁদের বিরোধ নীতিগত নয়, সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থেই। এই বিরোধের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতি হচ্ছে জনস্বার্থের, কারণ এর ফলে সেটাই পিছনে চলে যায়।
পুঁজিবাদী এই সমাজব্যবস্থা আজ পচে গিয়েছে। ইতিহাসের নিয়মে একদিন এই পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা এসেছিল। আজ সেই নিয়মেই তার ভূমিকা শেষ হয়ে গিয়েছে। শোষণ, লুণ্ঠন, দুর্নীতি, প্রতারণা, মিথ্যাচারকে ভিত্তি করে টিকে থাকা এই ব্যবস্থাকে যারাই সেবা করবে সেই রাজনৈতিক দল ও তার নেতাদের প্রতারক ও দুর্নীতিপরায়ণ না হয়ে উপায় নেই। এই ব্যবস্থায় একমাত্র যথার্থ শ্রমিক শ্রেণির দলের প্রতিনিধিরাই কিছুটা হলেও মানুষের জন্য ভূমিকা পালন করতে পারেন। পাঁচ বছর অন্তর একবার করে সরকার বদলে পুঁজিবাদের এই চরিত্র বদল করা যাবে না। মানুষের বাঁচার দাবিগুলি নিয়ে সংগ্রামী বামপন্থার রাস্তায় প্রবল গণআন্দোলন গড়ে তোলাই আজ পরিস্থিতি পরিবর্তনের একমাত্র রাস্তা।