পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যুৎ মাশুল কমানোর দাবিতে বিজেপি হঠাৎ কলকাতার ধর্মতলায় বিক্ষোভ দেখাল ১১ সেপ্টেম্বর৷ সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারও পেল৷ কিন্তু সত্যিই কি বিজেপি বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির বিরোধী?
জনজীবনে বিদ্যুতের ব্যবহার একান্ত অপরিহার্য৷ এমনিতেই চড়া মাশুল ও পরিষেবার নানা অব্যবস্থার কারণে দেশের দরিদ্র–মধ্যবিত্ত বিদ্যুৎ গ্রাহকদের জেরবার অবস্থা৷ তার উপর ১৯৪৮ সালের বিদ্যুৎ আইন বাতিল করে ২০০৩ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার নতুন বিদ্যুৎ আইন প্রণয়ন করে৷ পুরনো আইনে জনসাধারণের জন্য যতটুকু পরিষেবার ব্যবস্থা ছিল, সে সব তুলে দিয়ে বিদ্যুৎ পরিষেবার কোম্পানিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণের ব্যবস্থা করে দেয় বিজেপি সরকার৷ বিদ্যুৎ ব্যবস্থাটিকে উৎপাদন, পরিবহণ ও বণ্টন– এই তিনটি কোম্পানিতে ভেঙে দিয়ে প্রতিটি কোম্পানিকে কমপক্ষে ১৬ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ৩১ শতাংশ হারে মুনাফা করার ব্যবস্থা করে দেয় বিজেপি৷
বর্তমানে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে বিদ্যুৎ মাশুল বাড়ানোই শুধু নয়, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন মোদি সরকার বিদ্যুৎ আইন ২০০৩–এর উপর ‘সংশোধনী ২০১৮’ সংসদে এনেছে, যা আইনে পরিণত হলে কর্পোরেট বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো হবে৷ পাশাপাশি সাধারণ দেশবাসীর ঘাড়ে চাপবে মারাত্মক দামবৃদ্ধির বোঝা৷ সংশোধনীতে বলা হয়েছে, আগামী তিন বছরের মধ্যে দেশের সকলের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ মাশুল সমান করে দেওয়া হবে৷ অর্থাৎ বিদ্যুতের সাহায্যে ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করছে যে আদানি, আম্বানি, টাটা, বিড়লারা– তাদের মাশুল কমানো হবে, আর বিপিএল সহ সর্বস্তরের সাধারণ গ্রাহকদের মাশুল বাড়ানো হবে বিপুল হারে৷ এই বিলে বিদ্যুৎ–কে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রায় একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে৷ এর ফলে রাজ্য সরকারগুলি এতদিন অবস্থা অনুযায়ী যে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে পারত, কিংবা ভরতুকি দিত, তার আর উপায় থাকবে না৷ এই সংশোধনী আইনে পরিণত হলে দিল্লি রাজ্য সরকারের মতো গরিব গৃহস্থদের, কিংবা কিছু রাজ্যে গরিব কৃষকদের বিনামূল্যে বা স্বল্প মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে৷ বিদ্যুৎ কোম্পানি গ্রাহকদের পরিষেবা দেওয়ায় অবহেলা করলে তাদের জরিমানা করে গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থাও কার্যত তুলে দেওয়ার প্রস্তাব আছে ওই সংশোধনীতে৷ ২০০৩–এর আইনে যে তিনস্তরের কোম্পানির কথা ছিল, তাকে জেলা এমনকি থানা স্তরে ভেঙে দিয়ে স্তরে স্তরে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিয়ে নিচুস্তর পর্যন্ত মুনাফা লুটের পাকা বন্দোবস্ত রাখা হয়েছে সংশোধনীতে৷
বাস্তবে এসবের নিট ফল কী? সাধারণ গ্রাহকদের জন্য মাশুল বৃদ্ধি ঘটবে বিপুল পরিমাণে৷ অথচ সুষ্ঠু পরিষেবা দেওয়ার কোনও দায় কোম্পানিগুলোর থাকবে না৷ জনগণকে শুষে নিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের মুনাফা লুটের এই নীলনক্সা তৈরি করছে মোদি সরকার৷ তাহলে, কী করে এ–রাজ্যে বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির বিরুদ্ধে বিজেপি বিক্ষোভ দেখায়? ন্যূনতম সততা থাকলে তারা একাজ করত না৷
পশ্চিমবঙ্গের মানুষ জানেন, বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে সারা বাংলা বিদ্যুৎ গ্রাহক সমিতি (অ্যাবেকা) গ্রাহকদের সংগঠিত করে ধারাবাহিক ভাবে আন্দোলন করছে৷ রাজ্য জুড়ে বিক্ষোভ, ধরনা, অবরোধ, আইন অমান্য, গণ আমরণ অনশন, নিষ্প্রদীপ আন্দোলন, বিল বয়কট প্রভৃতি লাগাতার সংগঠিত হয়েছে৷ লাঠি–গুলির বন্যা বইয়ে সংগঠনের নেতা–কর্মীদের মিথ্যা মামলায় জেলে পুরেও পূর্বতন সিপিএম–ফ্রন্ট সরকার ন্যায়সঙ্গত এই আন্দোলন দমিয়ে দিতে পারেনি, বরং বহু দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে৷ একইভাবে বর্তমান তৃণমূল কংগ্রেস সরকারও অ্যাবেকার আন্দোলন দমন করতে পুলিশি অত্যাচার চালিয়ে গ্রাহকদের রক্তে হাত রাঙিয়েছে৷ কিন্তু আন্দোলনের চাপে ইচ্ছামতো মাশুল বৃদ্ধি করতে পারেনি৷ ন্যায়সঙ্গত দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে লাগাতার আন্দোলন পরিচালনার মধ্য দিয়ে দুর্দশাগ্রস্ত জনসাধারণ গভীর আস্থা স্থাপন করেছে অ্যাবেকার উপর৷ সেই কারণেই অ্যাবেকার আন্দোলন সফল করতে দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের উদ্যোগ ও সক্রিয়তা সহজেই চোখে পড়ে৷ ভয়াবহ বিদ্যুৎ মাশুল অবিলম্বে কমানোর দাবিতে অ্যাবেকার ডাকে ১৬ সেপ্টেম্বর রাজ্যের সকল জেলায় জেলাশাসক দপ্তরে ব্যাপক গ্রাহক বিক্ষোভ করে রাজ্য সরকার ও বিদ্যুৎ কোম্পানির উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টির কর্মসূচি সংগঠিত করেছে৷ ৩০ সেপ্টেম্বর ডাক দেওয়া হয়েছে কলকাতায় সিইএসসি দপ্তরে ব্যাপক গ্রাহক বিক্ষোভের৷ সর্বত্র বিপুল সাড়া পড়েছে৷
দাবি আদায়ে সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী এই আন্দোলনের দিক থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার হীন চেষ্টায় এবং এই ভাবে বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের সুবিধা করে দেওয়া ও সাধারণ গ্রাহকদের বিভ্রান্ত করার জন্য বিজেপি সাজানো আন্দোলন করছে এবং জনগণের সাথে প্রতারণা করছে৷ তাদের একমাত্র লক্ষ্য তৃণমূলকে সরিয়ে গদি দখল করা, যার সাথে সাধারণ গ্রাহকস্বার্থের কোনও সম্পর্ক নেই৷